একাধিক প্রার্থীতে আ.লীগ-বিএনপিতে বিবাদ

একাদশ জাতীয় নির্বাচন: চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি)

ইল্শেপাড় রিপোর্ট
মুসলিম সম্প্রদায়ের আবেগতাড়িত হাজীগঞ্জ ঐতিহাসিক বড় মসজিদ ও শাহরাস্তিতে হযরত রাস্তি শাহ্ (রহ.) মাজার অপরদিকে হিন্দু সম্প্রদায়ের তীর্থস্থান হিসেবে খ্যাত মেহের কালীবাড়ী মন্দিরের ঐতিহ্য নিয়ে চাঁদপুর-৫ আসন (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি)। ঐতিহাসিক নিদর্শন হিসেবে হাজীগঞ্জ উপজেলার অলিপুরে রয়েছে ৩ শ’ বছরের পুরনো মোঘল সম্রাট শাহ আলমগীর ও শাহসুজা জামে মসজিদ। ডাকাতিয়া নদী বিস্তৃত চাঁদপুর-৫ আসনের মাঝ দিয়ে তৈরি হয়ে ছিলো আসাম বেঙ্গল রেলওয়ের যোগাযোগ ব্যবস্থা। ব্রিটিশ শাসকরা এ পথেই চাঁদপুর থেকে স্টিমারযোগে গোয়ালন্দ ঘাট হয়ে কোলকাতার সাথে বাণিজ্য করতো।
চাঁদপুর-৫ (হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি) আসনে সম্ভাব্য একাদশ সংসদ নির্বাচনের ট্রেন ছুটলেও ভোটের মাঠে দেখা যাচ্ছে আওয়ামী লীগের মনোনয়ন প্রত্যাশীদের। বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীদের দেখা না গেলেও ভোটাররা সমীকরণ করছে কি হবে এবারের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। তবে সম্ভাব্য এ আওয়ামী লীগ কিংবা বিএনপি যে দলই নির্বাচনে জয়লাভ করুক সেটা নির্ধারণ হবে কেবল ভোটের পরে। এখন শুধু উভয় দলের গৃহবিবাদ নিয়ে শঙ্কিত উভয় দলের কর্মী-সমর্থকদের।
অতীত রেকর্ড বলছে বিএনপির ভোট ব্যাংক হিসেবে খ্যাত হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তির এ আসনে ’৯১ ও ২০০১ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন বিএনপি প্রার্থী এম এ মতিন। ’৯৬ সালের নির্বাচনে মুক্তিযুদ্ধের সেক্টর কমান্ডার মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম ৩শ’ ২০ ভোটের ব্যবধানে এমপি নির্বাচিত হয়েছিলেন।
তারপর ছন্দপতন হয় বিএনপিতে। ২০০৮ সালের নির্বাচনকে ঘিরে সাবেক এমপি এম এ মতিন ও মনোনয়ন প্রত্যাশী শিল্পপতি ইঞ্জিনিয়র মমিনুল হক প্রকাশ্যে দলীয় কোন্দলে জড়িয়ে পড়েন। বিএনপির অভ্যন্তরীণ বিভেদ কাজে লাগিয়ে এ আসনে ভাগ্য খুলে যায় ফের আওয়ামী লীগ প্রার্থী মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের। তিনি ৩৩ হাজার ১৭ ভোটের ব্যবধানে জোট প্রার্থী ইঞ্জিনিয়র মমিনুল হককে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হন। আর ২০১৪ সালের দশম সংসদ নির্বাচনে মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন তৃতীয়বারের মতো।
হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি এ দু’টি উপজেলা নিয়ে চাঁদপুর-৫ আসন। কৃষিনির্ভর এই সংসদীয় আসনে নির্বাচন কমিশনের হালনাগাদ ভোটার তালিকা অনুয়ায়ী মোট ভোটার ৩ লাখ ৯৩ হাজার ৩শ’ ৮৭ জন। এদের মধ্যে পুরুষ ভোটার ১ লাখ ৯৮ হাজার ১শ’ ৮৪ জন ও নারী ভোটার ১ লাখ ৯৫ হাজার ২শ’ ৩ জন।
১৯৯৬ এবং ২০০৮ সালে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর রফিকুল ইসলাম সার্বজনীন গ্রহণযোগ্যতা ধরে রাখতে সক্ষম হলেও এবার তিনি কিছুটা ব্যর্থ হয়েছেন। সাধারণ জনগণ কিংবা বিরোধী দলে নয়, তার নিজ দল আওয়ামী লীগের কাছেই গ্রহণযোগ্যতা কমেছে। ত্যাগী আওয়ামী লীগের তৃণমূল নেতাকর্মীদের দাবি এ আসনের দু’টি উপজেলার তার ঘনিষ্ট কয়েকজন সমালোচিত নেতার গ্যাঁড়াকল থেকে এ সংসদ সদস্য বের হয়ে আসতে পারেননি। ঢাকায় অবস্থানকারী সংসদ সদস্য রফিকুল ইসলামকে নির্বাচনী এলাকায় আমন্ত্রণ জানানো হয় শুধুমাত্র কোন উদ্বোধন বা ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপনের জন্য এমন অভিযোগ তার নিজ দলের নেতা কর্মীদের।
অপরদিকে নাম প্রকাশের অনিচ্ছুক স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতারা বলেন, নেতাকর্মীদের অনৈতিক কোন কাজে প্রশ্রয় দেন না এমন কারণে সাধারণ মানুষের কাছে ক্লিন ইমেজ ব্যক্তি সম্পন্ন হিসেবে পরিচিতি পেয়েছেন মেজর (অব.) রফিকুল ইসলাম। এমন সব গুণের পরও স্থানীয় আওয়ামী লীগের অনেকের কাছে অপছন্দের ব্যক্তি এখন তিনিই।
আগামি একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে মেজর (অব.) রফিকুল ইসলামের দলীয় মনোনয়ন ঠেকাতে বর্তমানে একাধিক প্রার্থী মাঠে নেমেছেন। এ আসনে প্রার্থী হতে প্রস্তুত- সংরক্ষিত নারী সদস্য অ্যাড. নুরজাহান বেগম মুক্তা, পাওয়ার সেলের মহা-পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ হোসেন, বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স এসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ইঞ্জিনিয়ার সফিকুর রহমান, কৃষক লীগ নেতা সফিকুল আমিন ফিরোজ, হাজীগঞ্জ উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান অধ্যাপক আব্দুর রশিদ এবং পরিবার পরিকল্পনা অধিদপ্তরের মহা-পরিচালক (অতিরিক্ত সচিব) ডা. কাজী মোস্তফা সারোয়ারের নামও শোনা যাচ্ছে।
অপরদিকে এ আসনে ১৯৭৯ সাল থেকে বিএনপি সাংগঠনিকভাবে শক্ত অবস্থানে থাকলেও গত দশম সংসদ নির্বাচনের পর মামলা-হামলায় দলটি অনেকটাই কাবু হয়ে পড়ছে। এছাড়া মতিন-মমিন প্রকাশ্য বিরোধ ভাবিয়ে তুলছে দলটির সাধারণ নেতাকর্মীদের। তবে দায়িত্বশীল নেতারা বলছে, তারা এখন আগের যেকোন সময়ের চেয়ে বেশি শক্তিশালী। তৃণমূল কর্মীদের দাবি সাবেক সংসদ এম এ মতিনের সাথে ইঞ্জিনিয়ার মমিনুল হকের চলমান বিরোধ নিয়ন্ত্রণ করতে না পারলে দল হিসেবে বিএনপি তাদের অর্জিত শক্তি ও ভোটের নিয়ন্ত্রণ হারাবে, সুযোগ নেবে আওয়ামী লীগ।
এই আসনে বিএনপির সম্ভাব্য প্রার্থী চাঁদপুর জেলা বিএনপির সাবেক সভাপতি ইঞ্জিনিয়র লায়ন মমিনুল হক। গতবার তিনি মেজর রফিকের কাছে হেরে যান। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি মনোনয়ন চাইবেন। তার সাথে গ্রুপিংয়ে জড়িয়ে আছেন সাবেক এমপি মতিন গ্রুপ। মাঝে-মধ্যেই সভা সমাবেশ হলে একে অন্যের বিরুদ্ধে কথা বলেন। তাদের অনুসারীরাও একই পথ অনুসরণ করেন। এছাড়া হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল কলেজের সাবেক অধ্যক্ষ ড. আলমগীর হোসেনও বিএনপির মনোনয়ন চাইতে পারেন।
আওয়ামী লীগের ব্যানারে নতুন মুখ হিসেবে বিদ্যুৎ বিভাগ তথা পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক ইঞ্জিনিয়ার মোহাম্মদ হোসাইন ও বঙ্গবন্ধু টেক্সটাইল ইঞ্জিনিয়ার্স অ্যাসোসিয়েশনের প্রতিষ্ঠাতা ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের উপ-সম্পাদকীয় কমিটির সাবেক সদস্য ইঞ্জিনিয়ার সফিকুর রহমানের প্রার্থীতার কথা শোনা যাচ্ছে। তাদের উভয়ের গণসংযোগেরও কমতি নেই এলাকায়। ফলে দলীয় মনোনয়নে কে এগিয়ে থাকবেন তা এখনো নিশ্চিত হতে পারেনি তাদের কর্মী-সমর্থকরা।
এদিকে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী ইঞ্জি. মমিনুল হক দাবি করেন, হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি এলাকাবাসীর সাথে বহু বছর যাবত জড়িয়ে আছি। তিন দশকেরও বেশি সময় ধরে ছাত্রদল সহ জাতীয়তাবাদী দলের বিভিন্ন স্তরের কখন কর্মী, কখন নেতা থেকে কাজ করে গেছি এবং যাচ্ছি। গত নবম সংসদ নির্বাচনের ভোটে ঠকানো হয়েছে আমাকে। মানুষ আমাকে ভোট দিলেও কারচুপি করে আমার বিজয় ছিনিয়ে নেয়া হয়েছে। তার দাবি এখন অনেক মামলার আসামি তার দলের নেতাকর্মীরা।
অপরদিকে স্থানীয় বিএনপির একটি অংশ সাবেক এমপি এমএ মতিনের পক্ষে কাজ করছে। তিনিও এবার জোড়ালো মনোনয়ন প্রত্যাশী। বিএনপির এই সিনিয়র নেতা ইউনিয়ন পর্যায় থেকে রাজনীতিতে প্রবেশ করেছেন। তার বেশ প্রভাব এখনো রয়েছে।
এছাড়া এক সময় ছাত্রদল নেতা কেন্দ্রীয় তাঁতী দলের বর্তমান সহ-সভাপতি জাহাঙ্গীর আলম মিন্টু এলাকায় নিজস্ব অবস্থান তৈরির চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন। সম্ভাব্য প্রার্থীর তালিকায় তার নামও রয়েছে। মনোনয়ন প্রত্যাশী জাতীয় পার্টি থেকে কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য ও সৌদি আরব রিয়াদ শাখার সভাপতি কামরুজ্জামান কাজল ও কেন্দ্রীয় প্রচার সম্পাদক খোরশেদ আলম খুশু ও জেলার নেতা মুক্তিযোদ্ধা হারুনুর রশিদ মুন্সী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের প্রার্থী হিসেবে রয়েছেন মাওলানা মনির হুসাইন, ইসলামিক ফ্রন্ট বাংলাদেশের কেন্দ্রীয় কমিটির চেয়ারম্যান আল্লামা সৈয়দ বাহাদুর শাহ’র নাম সম্ভাব্য তালিকায় শোনা যাচ্ছে।
সব মিলিয়ে সম্ভাব্য প্রার্থীদের পদচারণায় হাজীগঞ্জ-শাহরাস্তি এলাকা সরব হয়ে উঠছে। দু’উপজেলার নেতাকর্মী ভোটারসহ সাধারণ জনগণ মনে করছে আগের মত দু’বড় দলের মধ্যেই প্রার্থীতা নির্ধারণ হয়ে যাবে। তবে প্রার্থী নির্ধারণে দু’দলেই পরিবর্তনের একটা ইঙ্গিত আসছে।