ভাওয়াল রাজার দেশে

রহিম বাদশা :
(পূর্ব প্রকাশের পর) মাত্র আধাঘণ্টার বাসভ্রমণে আমরা পৌঁছে যাই নন্দন পার্কে। সহজে দ্রুত টিকেট পেতে সহযোগিতা করলেন গাজীপুরের সাংবাদিক শাহজাহান ভাই। অগ্রবর্তী টিমের পরিদর্শনকাল থেকে শুরু করে ভ্রমণ শেষ পর্যন্ত যিনি আন্তরিকভাবে সহযোগিতা করেছেন অকৃপণভাবে। তাকে নিয়েই আমরা নন্দনে প্রবেশ করলাম। একটি কৃত্রিম পার্ক হলেও নন্দনে প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যরে এতটুকু কমতি নেই। ছোট ছোট গাছ কেটে সেগুলোকে নান্দনিক করে তোলা হয়েছে। রাইডগুলোও বেশ ভালো। অবশ্য দেশে-বিদেশে আরো অনেক উন্নত ও রোমাঞ্চকর রাইড দেখার সুযোগ হওয়ায় আমাকে অতিমাত্রায় আকর্ষণ করতে ব্যর্থ হয় নন্দন। তবে অধিকাংশ ভ্রমণসঙ্গী নন্দনের বিভিন্ন রাইড উপভোগ করেছে আনন্দচিত্তে। আয়োজক কমিটির পক্ষ থেকে প্রত্যেকের জন্য প্রবেশ ফি ও দশটি রাইড সম্বলিত টিকেট দেয়া হয়েছিল। ফলে বিনামূল্যে এসব রাইড উপভোগ করেছে ভ্রমণসঙ্গীরা। সবচেয়ে বেশি মজা করেছে শিশুরা। আমার মেয়ে তো নিজের রাইডগুলো শেষ করে আমার টিকেট নিয়ে কিছু রাইড দ্বিতীয় দফা উপভোগ করেছে। তার দেখাদেখি আরো কিছু শিশু-কিশোর ডাবল রাইড উপভোগ করে বাড়তি আনন্দ পেয়েছে। আমি অবশ্য মাত্র ৪টি রাইড উপভোগ করেছি। এর মধ্যে বিশাল জলাশয়ে প্যাডেল নৌকা চালানো এবং অর্ধগোলাকৃতির ছোট্ট শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত হলে সৌরজগত দেখার রাইডটি আমার বেশ ভালো লেগেছে। এর আগে কলকাতার সাইন্স সিটির বিশাল পর্দায় এমনিভাবে সৌরজগত দেখার সুযোগ হয়েছিল।
পড়ন্ত বিকেলে আমরা যখন সবাই আনন্দ উপভোগের শেষ পর্যায়ে রয়েছি এমন সময় জি এম শাহীন জানালেন এসপি শামসুন্নাহার কিছুক্ষণের মধ্যে নন্দন পার্কে আসছেন, আমাদের সাথে সময় কাটাতে। কয়েক মিনিটের মধ্যেই স্বামী, সন্তান আর একদল পুলিশ নিয়ে আমাদের কাছে হাজির হলেন আমাদের ‘আপা’, মানে এসপি শামসুন্নাহার। সদ্যসাবেক প্রিয় কর্মস্থল চাঁদপুরের এতজন সাংবাদিক দেখে আনন্দে আত্মহারা হওয়ার উপক্রম তাঁর। ‘কেমন আছেন? উফ্্, আপনাদের দেখে আমার কি যে ভালো লাগছে!!!’ এই একটি মাত্র বাক্য আর অভিব্যক্তিতে শামসুন্নাহার আপার হৃদয় নিংড়ানো প্রাণের আবেগ, প্রাণের বাসনার পরিপূর্ণ প্রকাশ ঘটেছে। নিষ্পাপ, নিষ্কলুষ শিশুর মতোই মায়ের ¯েœহে জড়িয়ে ধরলেন শিশুদের, আদুরে বোনের মমতা মাখানো আলিঙ্গণে আবদ্ধ করলেন ভাবিদের। এবার শুরু সেল্ফিবাজি। আনন্দভ্রমণে অংশ নেয়া প্রায় সকলেই একে একে সেল্ফি ও ছবি তুলে সুখস্মৃতিগুলো স্মৃতির ফ্রেমে বন্দী করে রাখলেন। তিনিও আনন্দচিত্তে দীর্ঘসময় ধরে হাসি বিনিময় করে যাচ্ছিলেন।
গোধূলীলগ্নে নন্দন ছেড়ে সোহাগ পল্লীর উদ্দেশ্যে ফের যাত্রা শুরু হলো। বাসেই জানিয়ে দেয়া হলো কটেজে যেয়ে ফ্রেশ হয়ে সবাই যেন সুইমিংপুল লাগোয়া উন্মুক্তপ্রায় মঞ্চের সামনে চলে আসে। সন্ধ্যায় আমরা যখন একে একে মঞ্চের সামনে হাজির হলাম কেবল’ই বিস্ময়ে বিস্মিত হলাম ক্ষণে ক্ষণে। দুর্গাপূজার দশমীর দিন বলে আগে থেকে চেষ্টা করেও আমরা ওই রাতের জন্য কোনো শিল্পী কিংবা সাউন্ড সিস্টেম পাইনি। তাই কোনো সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান রাখা হয়নি। কিন্তু ছায়ানটের শিল্পী আমাদের শামসুুন্নাহার আপা আমাদের সবাইকে অবাক করে দিয়ে সাউন্ড সিস্টেম, ঢোল, তবলা, হারমোনিয়াম নিয়ে আসলেন, আনলেন এসবের বাদকও।
কিছু সময়ের মধ্যেই অনুষ্ঠানস্থলে হাজির হলেন শামসুন্নাহার আপা। আপা আসার পরপরই শুরু হলো সংক্ষিপ্ত আলোচনা পর্ব। গাজীপুরের এসএ টিভির সাংবাদিক শাহজাহান ভাই, চাঁদপুর প্রেসক্লাব সভাপতি ইকবাল ভাই, সাধারণ সম্পাদক জাকির ভাই, কালিয়াকৈর থানার ওসি (চাঁদপুরের কয়েকটি থানার সাবেক ওসি) আলমগীর হোসেন মজুমদার, আমাদের ‘দুলাভাই’ খ্যাত এসপি শামসুন্নাহারের স্বামী হেলাল উদ্দিন এবং পুলিশ সুপার সুপার শামসুন্নাহার- এই ক’জন মাত্র বক্তা। উপস্থাপনায় ছিলেন আনন্দ ভ্রমণ উদযাপন কমিটির সদস্য সচিব জি এম শাহীন; এই সুদৃশ্য, মনোরোম, হৃদয়হরিণী সোহাগ পল্লীতে আসার একমাত্র প্রস্তাবক ছিলেন যিনি।
পুলিশ সুপার শামসুন্নাহার তার বক্তব্যের শুরুতেই চাঁদপুরের সাধারণ মানুষ ও চাঁদপুরের সাংবাদিকদের স্মরণ করতে যেয়ে’ই কেঁদে ফেললেন। বললেন, এখনো মিস করেন তাঁর চাঁদপুরস্থ কার্যালয়ে আসা সেই নিরীহ-দুঃখী মানুষগুলোকে। বুঝলাম এতদিনেও তার প্রিয় কর্মস্থল চাঁদপুরকে এতটুকু ভুলতে পারেননি তিনি। হয়তো ভুলার চেষ্টাও করেননি! বহুকষ্টে কান্না চেপে প্রায় দুই মিনিট নীরব থাকলেন। এই নীরবতা যেন তাঁর অনুভূতির হাজার কথা বলে দিয়ে গেল আমাদের কর্ণকুহরে। তিনি তার বক্তব্যে বার বার চাঁদপুরের মানুষের প্রতি তাঁর হৃদয় নিংড়ানো ভালোবাসার স্মৃতিচারণ করলেন। ভালোবাসা আর স্মৃতির নিদর্শনস্বরূপ প্রেসক্লাব নেতৃবৃন্দের হাতে তুলে দিলেন শুভেচ্ছা স্মারক ক্রেস্টও।
এরপর শুরু হলো আমাদের অনির্ধারিত ও পরিকল্পনাহীন সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান। স্বতঃস্ফূর্তভাবে গান করলেন আজীবন সদস্য এম আই মমিন খানের মেয়ে সম্পা, সাহিত্য ও প্রকাশনা সম্পাদক মাহবুবুর রহমান সুমনের মেয়ে পুষ্পি, সাবেক সভাপতি শরীফ চৌধুরীর মেয়ে তানহা। গাইলেন পুলিশের দুই কনস্টেবলও। এরপর কেবল চমক আর চমক। পুলিশ সুপারের পরিকল্পনায় মঞ্চে ডাকা হলো প্রেসক্লাব সভাপতি, সাবেক সভাপতিবৃন্দ, সাধারণ সম্পাদক ও সাবেক সাধারণ সম্পাদকবৃন্দকে। শর্ত একটাই স্বস্ত্রীক মঞ্চে আসতে হবে। এতে তারা সবাই অপ্রস্তুত ও বিস্মিত হলেন। আপত্তিও করলেন অনেকে। কিন্তু শামসুন্নাহার আপার পরিকল্পনা বাস্তবায়নে নাছেরবান্দা শরীফ চৌধুরী ছাড় দিলেন না। কেবলমাত্র রাতের খাবারের প্রস্তুতিতে ব্যস্ত দু’জন তার আহ্বান থেকে নিস্তার পেলেন।
একে একে মঞ্চে আসলেন সভাপতি ইকবাল পাটোয়ারী-তাসলিমা মুন্নি জুটি, সাবেক সভাপতি যথাক্রমে ইকরাম চৌধুরী-আসমা ইকরাম জুটি, কাজী শাহাদাত-মাহমুদা খানম জুটি, জালাল চৌধুরী-খাদিজা পারভীন সিমন জুটি, শরীফ চৌধুরী-শাহনাজ চৌধুরী জুটি, সাধারণ সম্পাদক মির্জা জাকির-শামীমা সুলতানা কাকলী জুটি, সাবেক সাধারণ সম্পাদক যথাক্রমে আহছানুজ্জামান মন্টু-মিসেস মন্টু জুটি, গিয়াসউদ্দিন মিলন-হাসনা জাহান জুটি, রহিম বাদশা-রোকেয়া রহিম মিলি জুটি, জি এম শাহীন-মেরিনা শাহীন জুটি। অনেকেই গান করলেন। কেউ আবৃত্তি করলেন কবিতা। কেউ আবার স্বামী/স্ত্রীর সাথে ঠোঁট মেলালেন। গান করলেন সাংগঠনিক সম্পাদক মোরশেদ আলম-দিলরুবা খানম জুটিও।
এই অসাধ্য কাজটি এর আগে কেউ করাতে পারেনি আমাদের দিয়ে। এর মধ্যে আমিসহ অধিকাংশ’ই জীবনে প্রথম বারের মতো মঞ্চে উঠে গান করলাম। এখানেও চমকের কমতি ছিল না। একদিকে যেমন মাহমুদা খানম, শামীমা সুলতানা কাকলী, দিলরুবা খানমের মতো ক’জন বিলুপ্তপ্রায় শিল্পীর পুনর্জাগরণ হলো তেমনি আমাদের এতজন বেসুরো মানুষের সুর-তাল-লয়হীন কষ্টদায়ক গান শুনে স্রােতারা ধৈর্য্য পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হলেন। কণ্ঠ, সুর নাইবা হলো ভালো! আনন্দ-বিনোদনের এতটুকুও কমতি ছিল না সেই সন্ধ্যায়। বিশেষ করে হঠাৎ বনে যাওয়া কণ্ঠশিল্পীদের অপূর্ণতা স্বভাবসুলভ রস-রঙ্গে অনেকটাই পূর্ণ করে দিলেন উপস্থাপক শরীফ ভাই। সর্বশেষ চমক হয়ে আসলেন পুলিশ সুপারের স্বামী হেলাল ভাই। তাকেও আমরা সেদিন প্রথমবারের মতো শিল্পী হিসেবে পেলাম। গানও খারাপ করলেন না। আর শেষ দু’টি গানে মঞ্চে উঠে আমাদের সবার সাথে কণ্ঠ মেলান শামসুন্নাহার আপা। তবে কেন যেন এদিন তিনি গান করলেন না। দুঃখ ভারাক্রান্ত হৃদয়ের কারণে নাকি অন্যদের দিয়ে গান করিয়ে তৃপ্তির ঢেকুর গিলেছেন- সে কথা কেবল অন্তর্যামি’ই জানেন। সবাই মিলে যেন বিনে সুতোর মালা গাঁথা। বাঙালির শ্রেষ্ঠ সংগীত ‘আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি…’ সমবেত কণ্ঠে গেয়ে শেষ হলো স্মরণীয় ও রেডর্কভাঙ্গা সেই সাংস্কৃতিক আয়োজন।
এই আনন্দ আয়োজনের পর আবারো মেজবানে মেজবানীতে যোগ দিলাম আমরা সবাই। গাজীপুর শীর্ষ পুলিশ কর্মকর্তা শামসুন্নাহার আপা সেই রাতে আমাদের প্রধান মেহমান ছিলেন। নৈশভোজের আগে-পরে আরো কিছু সময় গল্প-গুজব আর আড্ডায় মেতেছিলেন আমাদের বোন। প্রায় অর্ধদিবস (৬ ঘণ্টা) আমাদের সঙ্গী হওয়ার পর বিদায় বেলায় জানালেন, পরদিন আমাদের সঙ্গী হওয়ার আকুল আকাক্সক্ষা ছিল তার। কিন্তু সরকারি দায়িত্ব ও পারিবারিক কাজের কারণে সম্ভবত পারছেন না। তার পক্ষে শ্রীপুর থানার ওসি মোহাম্মদ জাবেদ (চাঁদপুরের কয়েকটি থানার সাবেক ওসি) আমাদের সঙ্গ দেবেন। বোন বলে কথা, ভাইদের না খাওয়ালে হয়! তাও আবার ভাবি-বাচ্চারা সাথে আছে। নয়তো বাড়ি ফিরে খোটা দিতে পারে এই বলে- ‘কই তোমাদের বোনের বাড়ি গেলাম, আপ্যায়ন তো করালেন না?’ ব্যস্ততা থাকলেও আমাদের বিচক্ষণ ও আন্তরিক বোন এ ক্ষেত্রে ভুল করলেন না। বলে গেলেন, পরদিন দুপুর বেলার খাবার আয়োজন করেছেন আমাদের জন্য। আমাদের কষ্টের কথা চিন্তা করে পরদিনের ভ্রমণ স্পট বঙ্গবন্ধু সাফারী পার্কেই হবে সেই আয়োজন। বোনকে বিদায় দিয়ে এবার আমাদের ঘুমের রাজ্যে হারিয়ে যাওয়ার পালা। বলা যায়, বনের ভেতর বনবাস। তবে এই বনবাস সঙ্গীহীন নয়। (চলবে)