মতলব উত্তরে এতিমখানার ফ্লোর ধসে ৪৩ ছাত্র আহত, ভবন পরিত্যক্ত ঘোষণা

আহতদের পাশে এমপি রুহুল, সহায়তার আশ্বাস

মনিরুল ইসলাম মনির/ মাহফুজ মল্লিক
মতলব উত্তর উপজেলার ফরাজীকান্দি আল-আমীন শিশুসদন (ইয়াতিমখানা) কমপ্লেক্স ভবনের ফ্লোর গত শনিবার রাত ১০টায় ধসে অন্তঃত ৪৩ শিক্ষার্থী আহত হয়েছে। আহতরা বর্তমানে ঢাকা মেডিকেল কলেজ, চাঁদপুর জেলা সদর হাসপাতাল, মতলব উত্তর ও মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসাধীন রয়েছে। এদের মধ্যে গুরুতর আহত মাদ্রাসার হেফজ বিভাগের শিক্ষার্থী সিয়াম ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিসাধীন।
গতকাল রোববার সকালে চাঁদপুর-২ (মতলব উত্তর-মতলব দক্ষিণ) আসনের সংসদ সদস্য অ্যাড. নুরুল আমিন রুহুল ঘটনাস্থল, হাসপাতালে চিকিৎসাধীন আহতদের দেখতে ছুটে আসেন। তিনি আহতদের চিকিৎসার খোঁজ-খবর নেন। সবধরনের চিকিৎসা দিতে নির্দেশ দেন উপজেলা স্বাস্থ্য কর্মকর্তা ডা. শংকর কুমার সাহাকে। আহতদের সব ধরনের সহায়তার আশ্বাস দেন তিনি।
দ্রুত এ মাদরাসা ও এতিমখানার জন্য ভবন চেয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির দৃষ্টি আকর্ষণ করে সংসদ সদস্য নুরুল আমিন রুহুল। এ মাদরাসায় প্রায় ৫শ’ শিক্ষার্থীসহ ২শ’ এতিম রয়েছে।

মতলব উত্তর উপজেলার ফরাজীকান্দি আল-আমিন এতিমখানায় ফ্লোর ধসে অর্ধশত ছাত্র আহত হয়। -ইল্শেপাড়

পরিদর্শনকালে উপস্থিত ছিলেন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. একেএম মাহাবুবুর রহমান, উপজেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি দেওয়ান রেজাউল করিম, মো. আনিছুজ্জামান চৌধুরী, সাংগঠনিক সম্পাদক মোফাজ্জল হোসেন, উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম-আহ্বায়ক জহিরুল ইসলাম আলেক, গোলাম মোস্তফা, ছাত্রলীগ নেতা রিয়াজুল আরম রিয়াদসহ দলীয় নেতাকর্মী এবং স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের চিকিৎসকবৃন্দ।
দুর্ঘটনার রাতেই চাঁদপুর জেলা প্রশাসক মো. মাজেদুর রহমান খান, পুলিশ সুপার মো. মাহবুবুর রহমান, ইউএনও শারমিন আক্তার, সিনিয়র সহকারী পুলিশ সুপার (মতলব সার্কেল) আহসান হাবীব, সহকারী কমিশনার (ভূমি) আনোয়ার হোসাইন পাটোয়ারী, মতলব উত্তর থানার ওসি মো. নাসির উদ্দিন মৃধা, পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মুরশেদুল আলম ভূঁইয়া ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন।
মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ জানায়, আগামি ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবসে ডিসপ্লেতে অংশগ্রহণের জন্য মাদ্রাসা ভবনের দোতলার বারান্দায় টিম মিটিং চলাকালীন সময় ফ্লোর ধ্বসে পড়ে। এসময় ওই মিটিংয়ে থাকা সবাই আহত হয়। আহতদের স্থানীয়ভাবে চিকিৎসা দেয়া হয়। এদের মধ্যে গুরুতর আহতদের উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি করা হয়েছে। মতলব উত্তর স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে নেওয়া হয় ১৭ জন ছাত্রকে। এরমধ্যে ৬ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়। ১১ জন ভর্তি আছে। সিয়াম নামে এক ছাত্র ঢাকার পঙ্গু হাসপাতালে মৃত্যু সাথে পাঞ্জা লড়ছে বলে জানা গেছে।
অপরদিকে আহত আরো ২৬ জনকে নেয়া হয়েছে মতলব দক্ষিণ স্বাক্ষ্য কমপ্লেক্সে। তাদের মধ্যে ৮ জনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য চাঁদপুর সদর হাসপাতালে নেয়া হয়। ৯ জন ভর্তি আছে, বাকি ৯ জনকে প্রাথমিক চিকিৎসা দিয়ে ছাড়পত্র। গুরুতর আহত শিক্ষক মোহাম্মদ হোসেনকে চাঁদপুর সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। শিক্ষকসহ মোট ৪৪ জনকে হাসপাতালে নেয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া স্থানীয়ভাবে ১৫ জনকে চিকিৎসা দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, অধিকাংশ আহতদের হাত ও পায়ের হাড় ভেঙ্গে গেছে।
ফরাজীকান্দি দরবার শরীফের পীরজাদা আল্লামা মাসউদ আহমদ জানান, এই ঘটনার পর স্থানীয় প্রশাসন দীর্ঘদিনের জরাজীর্ণ ঝুঁকিপূর্ণ তিন তলা ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে সেখানে সব ধরনের শিক্ষা কার্যক্রম নিষিদ্ধ করেছে।
আল-আমিন এতিমখানার আবাসিক কর্মকর্তা শাহান শাহ সেলিম জানান, মতলব উত্তর উপজেলার ফরাজীকান্দি উয়েসিয়া কামিল মাদ্রাসার এতিমখানার ছাত্ররা ১৬ ডিসেম্বর চাঁদপুর জেলা স্টেডিয়ামে কুচকাওয়াজে অংশগ্রহণের লক্ষ্যে শনিবার রাতে শিক্ষকদের সাথে সভা করছিলো। রাত ১০টায় শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের ওজন সইতে না পেরে তিন তলা বিশিষ্ট ভবনের দ্বিতীয় তলা বারান্দার ফ্লোর ধসে পড়ে। এতে দ্বিতীয় তলায় থাকা শিক্ষার্থীরা নিচতলায় পড়ে গুরুতর আহত হয়। নতুন ভবন নির্মাণে সহযোগিতার জন্য আমরা বিভিন্ন সময় প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছিলাম। কিন্তু তা না পাওয়ায় আমাদের এ ধরনের দুর্ঘটনার সম্মুখীন হতে হয়েছে।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে চিকিৎসাধীন এতিম শিক্ষার্থীরা হলেন- সিহাব (১৪), আইনুদ্দিন (১৩), নাহিদ (১৩), সাব্বির (১৩), ইব্রাহীম (১৩), তরিকুল ইসলাম (১৩), আব্দুল আজিজ (১৩), সজিব (১৫), আব্দুল্লাহ (১৪), রহমান (১৫), নাহিদ (১৪) ও সিনিয়র সহকারী মৌলভী মোহাম্মদ হোসেন (৫০)। ঢাকায় চিকিৎসার জন্য নেয়া শিশুর নাম সিয়াম (১০)। মতলব দক্ষিণ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ভর্তি আরিফ হোসেন (১৪), মো. আজহার (১৫), মো. আহম্মদ আলী (১০), মো. হাবিবুব রহমান (১৩), মো. আকরাম (১৫), মো. তামিম (১৩), মো. সুজন (১৪). মো. শাখাওয়াত (১৫), মো. রাকিব (১৪)।
মাদ্রাসার ছাত্র ও এলাকাবাসীর সহায়তায় আহত ছাত্রদের উদ্ধার করে। পরবর্তীতে খবর পেয়ে চাঁদপুর থেকে দমকল কর্মী, উপজেলা প্রশাসন ও পুলিশ কর্মকর্তারা ঘটনাস্থলে গিয়ে আহতদের হাসপাতালে নিয়ে যায়।
আহতদের উদ্ধারে অন্যান্যের মধ্যে কামাল হোসেন গাজী, মনসুর আহমেদ, মাহবুব আলম মিষ্টার, আবদুল বাতেনসহ এলাকার লোকজন এগিয়ে আসে।
মাদ্রাসার ফাযিল প্রথম বর্ষের ছাত্র মো. ইসমাইল হোসেন ও হেফজ বিভাগের ছাত্র মো. আল হাসান বলেন, মাদ্রাসার এই ভবনটি দীর্ঘদিন ধরে ঝুঁকিপূর্ণ অবস্থায় রয়েছে। এ অবস্থায় আমরা এখানে লেখাপড়ার পাশাপাশি বসবাস করছি। ভবনটি পুরাতন হওয়ায় এই ঘটনাটি ঘটেছে।
স্থানীয় এলাকাবাসী মানছুর আহমেদ বলেন, খবর পেয়ে আমরা রাতেই এলাকাবাসী দুর্ঘটনার শিকার ছাত্রদের উদ্ধার করে হাসপাতালে প্রেরণ করি।
তিনি জানান, ভবনটি পুরাতন হওয়ায় এখানে নতুন করে ভবন তৈরি করা প্রয়োজন। ভবিষ্যতে দুর্ঘটনা এড়াতে মাদ্রাসার শিক্ষার্থীদের নিরাপদে শিক্ষাদানে নতুন ভবন তৈরির জন্য সরকারের প্রতি দাবি জানাই।
চাঁদপুর ফায়ার সার্ভিসের উপ-সহকারী পরিচালক মো. ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বলেন, খবর পেয়ে আমরা রাতেই ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। ভবনটি খুবই ঝুঁকিপূর্ণ। ভবন নির্মাণে কোনো ধরনের নিয়মনীতি ছিল না। বসবাসের অনুপযোগী ৩ তলা ভবনটিতে সাইনবোর্ড টাঙিয়ে দেয়া হবে।
মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শারমিন আক্তার বলেন, দুর্ঘটনার খবর জানার পরপরই আমরা ঘটনাস্থলে ছুটে যাই। আহত শিক্ষার্থীদের প্রশাসনের পক্ষ থেকে চিকিৎসা সহায়তা দেয়া হচ্ছে। দুর্ঘটনার শিকার তিনতলা ভবনটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হয়েছে। এখানে নতুন ভবন নির্মাণের জন্য ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানানো হবে।
চাঁদপুর-২ আসনের সংসদ সদস্য অ্যাড. নুরুল আমিন রুহুল বলেন, মাদরাসাটি এ অঞ্চলের প্রাচীন ইসলামী শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। এতিমখানার ভবনটি ঝরাজীর্ণ ছিল। এ স্থানে সরকারিভাবে ভবন করার জন্য বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া এতিমদের জন্য অস্থায়ীভাবে টিনসেট করার জন্য সরকারের পক্ষ থেকে ১০ বান্ডিল ঢেউটিন, ৩০ হাজার টাকা ও ৫০টি কম্বল দেয়া হয়েছে।