অনুমতি ছাড়া সরকারি বই বিতরণ
স্টাফ রিপোর্টার
হাইমচর উপজেলায় দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সিকি কিলোমিটার এলাকার মধ্যে কোন ধরনের অনুমতি ছাড়াই চালু করা হয়েছে বর্ণমালা একাডেমী নামের একটি শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সাথে কোন ধরনের যোগাযোগ না করে বিদ্যালয়টি ২০২০ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি করে শিক্ষা কার্যক্রম চালিয়ে যাচ্ছে। শুধু তাতেই ক্ষান্ত নয়, প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে জোরপূর্বক এবং রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস থেকে সরকারি বই নিয়েছেন তারা। সরকারের পক্ষ থেকে নানামুখী সুবিধা দিয়ে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়ার সুযোগ সৃষ্টি হলেও এ ধরনের বিদ্যালয় চালু হওয়ার কারণে সরকারি প্রাথমিকের শিক্ষার্থী সংখ্যা অনেকগুণ হ্রাস পেয়েছে। এ ধরনের পরিস্থিতি সৃষ্টি হওয়ার কারণে ক্ষোভ প্রকাশ করেছে সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকসহ এলাকাবাসী।
সরেজমিন বিদ্যালয়গুলো পরিদর্শন, স্থানীয়দের অভিযোগ ও শিক্ষকদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, পূর্ব চরকৃষ্ণপুর গ্রামে বর্ণমালা একাডেমী ২০১৯ সালে প্রতিষ্ঠা করা হয়। ২০২০ শিক্ষাবর্ষে ছাত্র-ছাত্রী ভর্তি হয়। এই বিদ্যালয়ের সিকি কিলোমিটার দক্ষিণ-পূর্বে ১৯৪৭ সালে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯নং উত্তর গন্ডামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টির আধা কিলোমিটার পূর্বে রয়েছে ৫৯নং উত্তর গন্ডামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়। এই বিদ্যালয়টি স্থাপিত হয় ১৯৭৩ সালে। ৩টি বিদ্যালয় এলাকার এক কিলোমিটারের মধ্যে রয়েছে মা কচি-কাঁচা একাডেমী নামে আরেক প্রতিষ্ঠান। এটি প্রতিষ্ঠিত হয় ২০১৪ সালে।
দু’টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয় ও ২০১৪ সালে প্রতিষ্ঠিত মা কচি কাঁচা একাডেমী চলমান অবস্থা থাকলেও নতুন করে একই এলাকায় বর্ণমালা একাডেমী চালু করায় স্থানীয়দের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। বাণিজ্যিকভাবে একের পর এক বিদ্যালয় চালু হওয়ার কারণে শিক্ষার গুণগত মান নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেয় এলাকাবাসীর মধ্যে।
নতুন করে বাণিজ্যিকভাবে চালু হওয়া বর্ণমালা একাডেমী সরকারি বিধি বিধান তোয়াক্কা না করে চালু হওয়ার কারণে ২০১৯ সালের নভেম্বর মাসে চাঁদপুর জেলা প্রশাসক, চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার, হাইমচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, হাইমচর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বরবার একটি লিখিত অভিযোগ করেন স্থানীয় পূর্ব চরকৃষ্ণপুর গ্রামের বাসিন্দা সাহেদ হোসেন, গন্ডামারা গ্রামের বাসিন্দা ছিডু মিয়া বেপারী ও মনা মিয়া বরকন্দাজ।
অভিযোগে তারা নিয়ম-নীতির তোয়াক্কা না করে বর্ণামালা একাডেমী চালু এবং সরকারি বিধান না মেনে শিক্ষা কার্যক্রম চালু করার বিষয়ে একটি বিধান অভিযোগের সাথে (প্রাথিমক শিক্ষা অধিদপ্তরের ৫৬১/৫২২নং স্মারক) সংযুক্ত করেন। এ বিষয়ে ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য ২০১৯ সালের ২০ নভেম্বর জেলা প্রশাসক কার্যালয় থেকে নির্দেশনা দেয়া হয় জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসকে। কিন্তু এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোন ব্যবস্থাগ্রহণ করা হয়নি।
৫৯নং উত্তর গন্ডামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক মো. তাজুল ইসলাম বলেন, বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে আমি আছি। আমাদের বিদ্যালয়টিতে এক সময় শিক্ষার্থীর সংখ্যা ছিলো ৩ শতাধিক। প্রাইভেট স্কুলগুলো অভিভাবকদের বিভিন্নভাবে প্রলোভন দিয়ে তাদের স্কুলে ভর্তি করিয়েছে।
একই বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তাপসী রানী সাহা বলেন, গত দেড় বছর আমি এই বিদ্যালয়ে কর্মরত। গত বছর শিক্ষার্থী সংখ্যা ছিলো ১২১ জন। ২০২০ সালে শিক্ষার্থী সংখ্যা ১১৩ জন। একই এলাকার মধ্যে একাধিক বিদ্যালয় চালু হওয়ার কারণে আমদের শিক্ষার্থী সংখ্যা কমে যাচ্ছে। সরকারি বিদ্যালয় হিসেবে আমাদের এখানে সুযোগ-সুবিধার কোন কমতি নেই।
১৯নং উত্তর গন্ডামারা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মো. মিজানুর রহমান বলেন, শিক্ষার শতভাগ মান বজায় রাখার চেষ্টা অব্যাহত থাকলেও আমাদের নির্দিষ্ট এলাকার ছাত্রগুলো কেজি স্কুলে চলে গেছে। এতে করে আমাদের শিক্ষার্থী সংকট সৃষ্টি হয়েছে।
মা কচি-কাঁচা একাডেমীর প্রতিষ্ঠাতা ও পরিচালক নাজমুল হাসান দুলাল বলেন, ২০১৪ সালে এলাকার যোগাযোগ ব্যবস্থা খুবই খারাপ ছিলো। ছোট শিশুদের বিদ্যালয় আসা-যাওয়া খুবই কষ্টকর বিধায় আমি বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করি। এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকে সুনামের সাথে চলছে। পঞ্চম শ্রেণির সমাপনী পরীক্ষায়ও ভাল রেজাল্ট করেছে। আমার বিদ্যালয়টি প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে সরকারি বইগুলো নিয়মিত পাচ্ছি। একই এলাকায় বিদ্যালয় সংখ্যা বাড়তে থাকলে শিক্ষার গুণগত মান ঠিক থাকবে না। আমি কোন ধরনের বাণিজ্যিক চিন্তা-ভাবনায় বিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করিনি।
বর্ণামালা একাডেমীর প্রধান শিক্ষক মুয়তাসিম বিল্লাহ রাজু বলেন, স্থানীয়দের দাবির প্রেক্ষিতে তারা নতুন করে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এ বছর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসে আবেদন করে শিক্ষার্থীদের জন্য বই এনেছেন। তাদের বিদ্যালয় থেকে অন্যান্য বিদ্যালয় ২ কিলোমিটার দূরে। তবে তাদের কোন ধরনের অনুমোদন নেই বলে স্বীকার করেন তিনি।
হাইমচর উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার জুলেখা শারমিন বলেন, বর্ণমালা একাডেমী নামে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠা কিংবা তাদের কোন বিষয়ে আমার সাথে আলাপ করেননি। বরং আমার সাথে কোন রকম যোগাযোগ ছাড়ই তারা প্রভাব খাটিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছ থেকে ২০২০ শিক্ষাবর্ষের বই নিয়েছে। তারা আমাদের কোন ধরনের তালিকায় নেই। স্থানীয়দের দেয়া অভিযোগের নোটিশ তিনি এখন পর্যন্ত পাননি বলে জানান।
হাইমচর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) ফেরদৌসি বেগম বলেন, এ বিষয়ে আবেদন পাওয়ার পরেই আমি বিষয়টি তদন্ত করে ব্যবস্থা নেয়ার জন্য উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে চিঠি দিয়েছি। একই সাথে বর্ণমালা একাডেমী নামে ওই বিদ্যালয়কে বই না দেয়ার জন্য বলেছি। কিন্তু এখন পর্যন্ত উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার আমাকে কোন কিছু জানায়নি।
চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. সাহাব উদ্দিন বলেন, গ্রামীণ এলাকায় একটি বিদ্যালয় থাকলে ২ কিলোমিটারের মধ্যে আরেকটি বিদ্যালয় করার নিয়ম নেই। এ বিষয়ে প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের স্পষ্ট বিধান রয়েছে। স্থানীয়রা যে আবেদন করেছেন সে বিষয়ে আমি এখন পর্যন্ত কোন ব্যবস্থা নেইনি। তবে আজকেই (১৬ ফেব্রুয়ারি) বলবো বিষয়টি দেখার জন্য।