স্মৃতিতে বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ

ড. আবু সিনা
বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজের সকল শিক্ষক, কর্মচারী ও পরিচালনা কমিটির সদস্যসহ এই বিদ্যালয় সংশ্লিষ্ট সকল মানুষের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা জানাই যাদের অক্লান্ত পরিশ্রমে এই বিদ্যালয়টি গত দশ যুগ ধরে মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে। বিশেষ শ্রদ্ধা তাদের প্রতি যারা প্রায় একশত বিশ বছর আগে শিক্ষার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে এই বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার চিন্তা করেছেন ও আর্থিকভাবে অবদান রেখেছেন। তাদের সেই সুচিন্তার ফসল হিসেবে এই বিদ্যালয় দশ যুগ ধরে অসংখ্য সফল মানুষ তৈরি করেছে এবং করছে।
আমি বিজ্ঞানের মানুষ। বিজ্ঞান বিষয়ে গবেষণা করাই আমার কাজ। কিন্তু বিজ্ঞানের প্রতি ভালোবাসার শুরুটা এই বিদ্যালয়ের শিক্ষার মাধ্যমেই হয়েছিলো আমার। আজ পৃথিবীর অন্যতম সেরা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পিএইচডি করে সেই বিশ্ববিদ্যালয়ে গবেষণা করছি ক্যান্সার নিয়ে। স্বল্প খরচে ক্যান্সার সনাক্তকরণের একটি পদ্ধতি আবিষ্কার নিয়ে গবেষণা চলছে আমার, যেটি সারা পৃথিবীতে সাড়া ফেলেছে। অনেকেই তাই মনে করেন আমি হয়তো বিদেশের বিখ্যাত স্কুল ও কলেজে পড়াশুনা করেছি। এই বিদেশ বিভুঁইয়ে এই প্রশ্নটি আমাকে অসংখ্যবার শুনতে হয়েছে কিন্তু আমি প্রতিবারেই গর্বভরে বলেছি যে আমি বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজে পড়েছি। তারা জিজ্ঞাসা করেছে- এই স্কুলের নাম তো শুনিনি, এটা কি খুব বিখ্যাত? আমি বলেছি- এটা হয়তো পৃথিবীর বিখ্যাত স্কুলগুলির একটি নয় কিন্তু এই বিদ্যালয় যে উন্নত মানুষ তৈরী করে তাতে কোন সন্দেহ নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশের অনেক বিখ্যাত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ঘুরে দেখেছি। সেখানে হয়তো অনেক আধুনিক সুবিধা আছে কিন্তু শত সীমাবদ্ধতার মাঝেও আমাদের শিক্ষকরা যেভাবে আন্তরিকতার সাথে, শিক্ষার্থীদের সন্তানতুল্য মনে করে শিক্ষা দেয়ার চেষ্টা করেছেন সেটা অতুলনীয়। যতটুকু মনে পড়ে আমাদের সময়ে আমাদের শিক্ষকরা মাধ্যমিক পরীক্ষার আগে রাতের বেলা শিক্ষার্থীদের বাসায় গিয়ে তাদের পড়াশোনার খোঁজ নিতেন। ছাত্র-ছাত্রীদের সুন্দর ভবিষ্যৎ তৈরির জন্য এমন নিঃস্বার্থ চেষ্টার উদাহরণ খুব কমই আছে।
বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ আমার প্রাণের সাথে মিশে আছে। এই বিদ্যালয় আমার জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ। এই বিদ্যালয়ের মাটির গন্ধ আমি সুদূর অস্ট্রেলিয়া বসেও নিতে পারি। স্কুলের সিঁড়ির পাশের কামিনী ফুল গাছগুলো কেমন আছে জানিনা কিন্তু তার সুগন্ধ এখনো চোখ বন্ধ করে টের পাই। স্কুলের মাঠে গোল্লাছুট খেলা, ক্লাসের টেবিলে কলম খেলা, ক্লাস শেষে বিকেলে স্কুল মাঠে ক্রিকেট খেলাসহ কত আনন্দের স্মৃতি আমার মনের কোনে খেলা করে প্রতি মুহূর্তে। আজ পৃথিবীর বিখ্যাত বিশ্ববিদ্যালয়ে কাজ করলেও আমার কৈশোরের দিনগুলি ছিলো সত্যি সোনায় মোড়ানো। খুব ফিরে যেতে ইচ্ছে করে কৈশোরের সেই দিনগুলোতে। রবি ঠাকুরের ভাষায় দিনগুলি হয়তো সোনার খাঁচায় রইলোনা কিন্তু আমার মনের খাঁচায় আজো বেজে উঠে স্কুলের মাঠে শারীরিক চর্চার সময় শত শত শিক্ষার্থীর সাথে একই কণ্ঠে জাতীয় সঙ্গীত গাওয়ার স্মৃতি। আজ সবার ভালোবাসার এই বিদ্যাপীঠের দশ যুগপূর্তি উৎসবে সবার সাথে আমার মনও মেতে উঠেছে। আমিও হারিয়ে গেছি আজ থেকে ত্রিশ বছর পূর্বে যেদিন আমি এই বিদ্যালয়ে প্রথম ভর্তি হয়েছিলাম। সেই থেকে আমার জীবনের সাতটি বছর কেটেছে এই বিদ্যালয়ের আঙিনায়। সাদা-কালো পোশাকের স্কুল পোষাক পড়েই জীবনের শ্রেষ্ঠ সময়গুলি কেটেছে আমার এই বিদ্যালয়ে। শিক্ষকদের ভালোবাসা আর বন্ধুদের সহচর্য আমার জীবনকে পরিপূর্ণ করেছে। স্কুলের পিয়ন রাজ্জাক দাদা কিংবা দারোয়ান জলিল কাকা তাদের কথাও মনে পড়ে খুব। আমরা যখন স্কুলে পড়ি তখন জলিল কাকা একবার জেলা প্রশাসকের গাড়ি স্কুলের ভিতর ঢুকতে দেয়নি প্রধান শিক্ষকের অনুমতি না থাকায়। এই ঘটনাটি নিয়ে অনেকেই হাস্যরস করেছে কিংবা তাকে বোকা বলেছে। কিন্তু এই ঘটনাটি আমার মনে গভীর দাগ কেটেছে। কর্তব্যের প্রতি তার এই নিষ্ঠা আমাকে আজও অনুপ্রাণিত করে। ধর্ম-বর্ণের ভেদ অতিক্রম করে এই বিদ্যালয় আমাকে মানুষ হতে শিখিয়েছে। তাই আমার বাবা’সহ আমাদের সময়ের এই স্কুলের সকল শিক্ষক যেমন সিদ্দিক স্যার, ফনি স্যার, প্রাণতোষ স্যার, মিলন স্যার, ছোট হুজুর, বড় হুজুর স্যার, পন্ডিত স্যার, গোপাল স্যার, হাফেজ স্যার, বিএড স্যার, আব্দুল হাই স্যার, ছোট শহীদ স্যার ও কলেজের সবিতা ম্যাডাম, মামুন স্যার’সহ সকল শিক্ষকদেরকে মনের গভীর থেকে শ্রদ্ধা জানাই। এই স্যারদের মাঝে অনেকেই হয়তো পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে চলে গেছেন কিন্তু তারা যে শিক্ষার আলো ছড়িয়েছেন আমার মতো হাজারো শিক্ষার্থীদের মাঝে সেই আলো বাবুরহাট ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়েছে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে। ভবিষ্যতে বাবুরহাট স্কুল ও কলেজের শিক্ষার্থীদের দীপ্ত পদচারণা বাংলাদেশ ছাড়িয়ে আরো বেশি করে ছড়িয়ে পড়ুক সারা পৃথিবীর বড় বড় প্রতিষ্ঠানে।
ফেসবুকের কল্যাণে এই দশ যুগপূর্তি উৎসবের আমেজ বাবুরহাট ছাড়িয়ে পৃথিবীর বিভিন্ন প্রান্তে অবস্থিত শিক্ষার্থীদের মাঝেও ছড়িয়ে পড়েছে। এই সুদূর অস্ট্রেলিয়া থেকে আমিও তাই আজ সবার মতো রবিঠাকুরের ভাষায় বলে উঠি-
‘মোরা সুখের দুখের কথা কবো, প্রাণ জুড়াবে তায়।
পুরানো সেই দিনের কথা ভুলবি কি রে হায়।
ও সেই চোখের দেখা, প্রাণের কথা, সে কি ভোলা যায়।
ড. আবু সিনা : ক্যান্সার গবেষক, কুইন্সল্যান্ড বিশ্ববিদ্যালয়, অস্ট্রেলিয়া ও সাবেক শিক্ষার্থী, বাবুরহাট উচ্চ বিদ্যালয় ও কলেজ।