আজ পবিত্র ‘লাইলাতুল বারাআত’

ইলশেপাড় ডেস্ক
আজ বৃহস্পতিবার (৯ এপ্রিল) পবিত্র ‘শবেবরাত’ বা ‘লাইলাতুল বারাআত’। হাদিস শরিফে এসেছে, আল্লাহ তাআলা এ রাতে বান্দাহেকে গোনাহ থেকে মুক্তি দেন। আর সে কারণেই এ রাতকে লাইাতুল বারাত বা শবে বরাত নামকরণ করা হয়েছে। আর হাদিসের পরিভাষায় এ রাত ‘লাইলাতুন নিসফি মিন শাবান’ নামে পরিচিত। আরবি হলো ‘লাইলাতুল বারাআত’। ফারসি ‘শব’ আর আরবি ‘লাইলাতুন’ অর্থ রাত বা রজনী। ‘বারাআত’ অর্থ হলো নাজাত, মুক্তি, নিস্কৃতি। আর লাইলাতু বারাআত শবে বারাআতের অর্থ দাঁড়ায় মুক্তি বা নাজাতের রাত।
উম্মাতে মুহাম্মদির জন্য বছরে যে কয়টি বিশেষ দিনক্ষণ রয়েছে তন্মধ্যে এ রাতটিও একটি। ফজিলতময় এ রাতে ইবাদত-বন্দেগির ব্যাপারে হাদিসে রয়েছে সুস্পষ্ট নির্দেশনা।
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বর্ণনা করেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, ‘জিবরিল আলাইহিস সালাম আমার কাছে এসেছিলেন এবং বললেন, আপনার প্রভু আপনাকে নির্দেশ দিয়েছেন (জান্নাতুল) বাকিতে যাওয়ার জন্য এবং তাদের জন্যে ক্ষমা প্রার্থনা করার জন্য।’ (মুসলিম)
অন্য হাদিসে এসেছে- হজরত মুয়াজ ইবনে জাবাল রাদিয়াল্লাহু আনহু বলেন, রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তাআলা অর্ধ শাবানের রাতে (শাবানের ১৪ তারিখ দিবাগত রাতে) সৃষ্টির দিকে (রহমতের) দৃষ্টি দেন এবং মুশরিক ও বিদ্বেষ পোষণকারী ব্যতিত আর সবাইকে ক্ষমা করে দেন।’ (ইবনে হিব্বান)
হাদিসের আলোকেই প্রতিয়মান হয় যে, অর্ধ শাবানের এ রাত বান্দার ক্ষমা ও মুক্তির রাত। আল্লাহ তাআলা এ রাতের ইবাদত-বন্দেগি ও আমলকারীদের মাফ করে দেন।
মধ্য শাবান রাতের ফজিলত বিষয়ে অনেক হাদিস রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ও সাহাবায়ে কিরাম, তাবেয়িগণ থেকে বর্ণিত হয়েছে বলে উল্লেখ করেছেন ইমাম ইবনে তাইমিয়া রাহমাতুল্লাহি আলাইহি।
এ রাতের ইবাদত-বন্দেগি ও বান্দার গোনাহ মাফের বিষয় সম্পর্কে হাদিস বর্ণনা করেছেন ইমাম আহমদ ইবনে হাম্বল রহমাতুল্লাহি আলাইহি। তিনি তার মুসনাদে উল্লেখ করেন-
হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত তিনি বলেন, এক রাতে আমি রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লামকে হারিয়ে ফেললাম (বিছানায় পেলাম না)। আমি (তাঁর সন্ধানে) বের হলাম। এসে দেখলাম তিনি (জান্নাতুল) বাকি কবরস্তানে আছেন। তিনি বলেন, তুমি কি ভয় করছ আল্লাহ ও তাঁর রাসূল তোমার প্রতি কোনো অবিচার করবেন? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি অনুমান করলাম আপনি আপনার অন্য কোনো বিবির কাছে গিয়েছেন। তিনি বললেন, আল্লাহ তাআলা মধ্য শাবানে (১৫ তারিখের রাতে) দুনিয়ার কাছের আকাশে অবতীর্ণ হন। তারপর কালব গোত্রের বকরির পালের লোমের চেয়েও বেশিসংখ্যক লোককে তিনি ক্ষমা করে দেন।’ (তিরমিজি, মুসনাদে আহমদ)
তবে এ রাতের যে বিষয়গুলো দলমত নির্বিশেষে হক্কানি আলেম সমাজ কখনো সমর্থন করে না তাহলো-

  • ঘর-বাড়ি, দোকান ও মসজিদ আলোকসজ্জা করা।
  • মাজার-কবরস্থানে ফুল দেয়া ও আলোকসজ্জা করা।
  • আতশবাজি ও পটকা ফোটানো।
  • পাড়া-মহল্লা কিংবা বাড়ি-বাড়ি হালুয়া-রুটি বিলানোর রেওয়াজ ইত্যাদি। বরং এসব রুসুম রেওয়াজ ইসলামি শরিয়া বিরোধী কাজ।
  • মনে রাখতে হবে : শবে বরাতে নির্দিষ্ট কোনো আমল নেই, আবার এই রাতের জন্য আমলের আলাদা কোনো নিয়মও কুরআন-হাদিসের মাধ্যমে প্রমাণিত নয়।
    তাই সবার উচিত কুরআন-সুন্নাহ বর্ণিত আমলগুলো একাকি নিরবে নিভৃতে পালন করা। তবে এ রাতে দীর্ঘ কেরাত এবং দীর্ঘ সেজদায় নামাজ পড়ার ব্যাপারে হাদিসের বর্ণনা রয়েছে। হাদিসে এসেছে-
    হজরত আয়েশা রাদিয়াল্লাহু আনহা বলেন, এক রাতে রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম ঘুম থেকে ওঠে নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন এবং সেই নামাজে এতো দীর্ঘ সময় তিনি সেজদায় ছিলেন যে, আমার সন্দেহ হচ্ছিল তিনি ইন্তেকাল করেছেন কিনা। আমি উঠে গিয়ে তার বৃদ্ধাঙ্গুলি নাড়া দিলাম। আঙুলটি নড়ে উঠল। আমি নিশ্চিত হলাম যে তিনি বেঁচে আছেন। অতঃপর আমি আপন স্থানে ফিরে এলাম। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম সেজদা থেকে মাথা উঠালেন এবং নামাজ শেষ করে এক পর্যায়ে বললেন- হে আয়েশা! তুমি কি ভেবেছ যে, আল্লাহর নবী তোমার উপর কোনো অবিচার করেছে? আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসুল! আমি এমন কিছুই ভাবিনি। আমি বরং আপনাকে দীর্ঘ সময় সেজদায় দেখে ভয় পাচ্ছিলাম যে, আপনাকে আল্লাহ পাক উঠিয়ে নিলেন কিনা! অতপর রাসুল সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তুমি কি জান আজকের এ রাতটি কোন রাত? আমি বললাম, আল্লাহ ও তার রাসুলই ভালো জানেন। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এ রাতটি শাবানের পঞ্চদশ রজনী। এতে মহান প্রভু তার বান্দাদের উপর বিশেষ দৃষ্টি দেন। ক্ষমাপ্রার্থীদের ক্ষমা করে দেন। রহমতপ্রার্থীদের রহমত দান করেন। অপরদিকে পরশ্রীকাতর ব্যক্তিদের আপন অবস্থায় ছেড়ে দেন।’ (শুয়াবুল ঈমান, আত তারগীব)
    সুতরাং এ রাতে দীর্ঘ কেরাত ও লম্বা সেজদায় বেশি বেশি নফল নামাজ পড়া, তাহাজ্জুদের নামাজ পড়া, আল্লাহর কাছে তাওবা-ইসতেগফার, জিকির-আজকার ও কুরআন তেলাওয়াত করা ফজিলতপূর্ণ ইবাদত।
    তাই মুমিন মুসলমানের উচিত, এ রাতে নামাজ আদায় করে প্রাণঘাতী বৈশ্বিক মহামারি করোনাভাইরাস থেকে মুক্তি লাভে আল্লাহর কাছে রোনাজারি করা। দুনিয়ার যাবতীয় বালা-মুসিবত থেকে হেফাজত করার আবেদন-নিবেদন করা।
    আল্লাহ তাআলা মুমিন মুসলমানকে যথাযথভাবে কুরআন-সুন্নাহর নির্দেশনা মোতাবেক রুসুম রেওয়াজ পরিহার করে এ রাতে ইবাদত-বন্দেগি করে নিজেদের ক্ষমা ও মুক্তি অর্জন করার তাওফিক দান করুন। আমিন।
    এদিকে প্রতি বছর ব্যাপক উৎসাহ-উদ্দীপনায় রাতটি উদযাপিত হলেও এবার দৃশপট সম্পূর্ণ ভিন্ন। করোনাভাইরাসের প্রাদুর্ভাবের মধ্যে কোনো আমেজ ছাড়াই পালিত হচ্ছে শবে বরাত। মসজিদে ও কবরস্থানে যাওয়ায় রয়েছে বারণ। এমনকি বিনা প্রয়োজনে ঘর থেকেও বের হওয়া যাচ্ছে না। এমন শবে বরাত এর আগে কেউ দেখেনি।
    এবার যেন শবে বরাতের ইবাদত-বন্দেগি সবাই নিজ নিজ ঘরে করেন এ ব্যাপারে আগেই নির্দেশনা দিয়েছে ইসলামিক ফাউন্ডেশন। মসজিদে নিয়মিত জামাতে পাঁচজনের বেশি এবং জুমার জামাতে ১০ জনের বেশি মুসল্লির ওপর রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। এই নির্দেশনা বাস্তবায়নে সারাদেশে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী কঠোর অবস্থানে রয়েছে।
    এই অবস্থায় শবে বরাত পালিত হচ্ছে অনেকটা নীরবে-নিভৃতে। মসজিদ-কবরস্থান কোথাও লোকের ভিড় নেই। এমনকি রাস্তায়ও নেই মানুষের তেমন কোনো আনাগোনা। শবে বরাতে কবরস্থানে যাওয়ার রেওয়াজ বহু পুরোনো। এই রাতে প্রতিটি কবরস্থান থাকে লোকে লোকারণ্য। কিন্তু এবার কবর জিয়ারতেও রয়েছে নিষেধাজ্ঞা। নেই কবরস্থানকেন্দ্রিক ফকিরদের আনাগোনাও।
    ভয়াবহ আকার ধারণ করতে যাওয়া করোনাভাইরাসের কবল থেকে জাতি যেন মুক্তি পান সে ব্যাপারে দেশবাসীকে বিশেষ প্রার্থনার আহ্বান জানিয়েছে সরকার। মসজিদে যেতে না পারলেও নগরবাসী নিজ নিজ ঘরে নামাজসহ বিভিন্ন ইবাদত করছেন। তারা করোনার ভয়াবহতা থেকে রক্ষা পেতে বিশেষ দোয়াও করছেন।