আজ শুভ বড়দিন

ইল্শেপাড় ডেস্ক
আজ ২৫ শে ডিসেম্বর। খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের সর্ববৃহৎ ধর্মীয় উৎসব ‘শুভ বড়দিন’। খ্রিস্টধর্মের প্রবর্তক যিশুখ্রিস্ট এদিনে বেথলেহেমে জন্মগ্রহণ করেন। তাই এ দিনটিকে ‘শুভ বড়দিন’ হিসেবে উদ্যাপন করে থাকেন খ্রিস্টধর্মাবলম্বীরা। তারা বিশ্বাস করেন, সৃষ্টিকর্তার মহিমা প্রচারের মাধ্যমে মানবজাতিকে সত্য ও ন্যায়ের পথে পরিচালিত করতেই যিশুর পৃথিবীতে আগমন ঘটেছিল। বিশ্বের অন্য দেশের মতো বাংলাদেশের খ্রিস্টধর্মানুসারীরাও আজ যথাযথ ধর্মীয় ভাবগাম্ভীর্য ও আনন্দ-উৎসবের মাধ্যমে ‘শুভ বড়দিন’ উদ্যাপন করবেন।
এ উপলক্ষে রাজধানী ঢাকাসহ সারা দেশে খ্রিস্টধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গির্জাগুলোকে সাজানো হয়েছে নতুন সাজে। বিভিন্ন গির্জা এবং তারকা হোটেলগুলোতে ব্যবস্থা করা হয়েছে আলোকসজ্জার। বড়দিন উপলক্ষে প্রেসিডেন্ট মো. সাহাবুদ্দিন ও প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস শুভেচ্ছা জানিয়ে বাণী দিয়েছেন।
ওদিকে বড়দিন উপলক্ষে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন প্রধান উপদেষ্টা প্রফেসর মুহাম্মদ ইউনূস। মঙ্গলবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় খ্রিস্টান সমপ্রদায়ের প্রতিনিধিদের সঙ্গে শুভেচ্ছা বিনিময় করেন তিনি। ধর্ম উপদেষ্টা ড. আ ফ ম খালিদ হোসেনের সঞ্চালনায় খ্রিস্টান ধর্মের নেতাদের মধ্যে শুভেচ্ছা বক্তব্য রাখেন বাংলাদেশের ক্যাথলিক খ্রিস্টানদের প্রধান ধর্মগুরু আর্চবিশপ বিজয় এন ডি’ক্রুজ, দ্যা ন্যাশনাল ক্রিশ্চিয়ান ফেলোশিপ অব বাংলাদেশের সভাপতি বিশপ ফিলীপ পি অধিকারী, বাংলাদেশ ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশনের প্রেসিডেন্ট নির্মল রোজারিও, বাংলাদেশ ক্রিশ্চিয়ান এসোসিয়েশনের মহাসচিব ইগ্নাসিওস হেমন্ত কোড়াইয়া এবং বাংলাদেশ খ্রিস্টান মহাজোটের প্রেসিডেন্ট ড্যানিয়েল নির্মল ডি’ কস্তা।
আতশবাজি, পটকা ফুটানো ও ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ: খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান বড়দিনে সবপ্রকার আতশবাজি, পটকা ফুটানো এবং ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ করে গণবিজ্ঞপ্তি জারি করেছে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ (ডিএমপি)। মঙ্গলবার ডিএমপি কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী স্বাক্ষরিত এক গণবিজ্ঞপ্তিতে এ নির্দেশনা দেয়া হয়।
এতে বলা হয়, ২৫শে ডিসেম্বর খ্রিস্ট ধর্মাবলম্বীদের বৃহত্তম ধর্মীয় অনুষ্ঠান বড়দিন উৎসবমুখর পরিবেশে উদ্যাপনের লক্ষ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশ অর্ডিন্যান্স (অর্ডিন্যান্স নং-৩/৭৬)-এর ২৮ ধারায় অর্পিত ক্ষমতাবলে ২৪শে ডিসেম্বর রাত ১২টা থেকে ২৫শে ডিসেম্বর রাত ১২টা পর্যন্ত ঢাকা মহানগর এলাকায় সকল প্রকার আতশবাজি, পটকা ফুটানো ও ফানুস ওড়ানো নিষিদ্ধ করা হলো।
এদিনের অপেক্ষায় তাদের সারাটি বছর কাটে। ডিসেম্বর মাস শুরু হলেই এ সম্প্রদায়ের মানুষের মধ্যে উৎসবের সাড়া পড়ে যায়। ঘরবাড়ি নতুন করে সাজাতে শুরু করেন। নতুন পোশাক কেনাকাটার ধুম পড়ে যায়। শুভেচ্ছা কার্ড বিনিময় করেন।
ইতোমধ্যে, সারা পৃথিবীর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ দিনটি পালন করতে শুরু করেছেন। হাজার হাজার পুণ্যার্থী, পর্যটক যিশুর জন্মস্থান বেথেলহেমে হাজির হয়েছেন। সেখানে চার্চ অব নেটিভিটির বাইরে বয়স্কাউটরা ব্যান্ড বাজিয়ে মার্চপাস্ট করেছেন। অনেকে সেখানে মোমবাতি জ্বালিয়ে উৎসব পালন করেছেন। বাংলাদেশও এর ব্যতিক্রম নয়।
রাজধানী ঢাকায় হোটেল সোনারগাঁও, শেরাটন, র‌্যাডিসন, অস্টিনে চোখ ধাঁধানো আলোকসজ্জা। আর খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষ তাদের বাড়িঘর আলোক সজ্জায় সজ্জিত করেছেন। বড়দিনের ইতিহাস হিসেবে জানা যায়, যিশুর মা মাতা মেরী ছিলেন ইসরাইলের নাজারেথবাসী যোসেফের বাগদত্তা। একদিন এক দেবদূতের মাধ্যমে তিনি জানতে পারলেন, মানুষের মুক্তির পথ দেখাতে তার গর্ভে আসছেন ঈশ্বরের পুত্র। তার নাম রাখতে হবে যিশু। আজ থেকে দুই হাজার বছরেরও আগে ২৫ ডিসেম্বর বেথেলহেমের এক গোয়ালঘরে তার গর্ভেই জন্ম নেন যিশু।
তিনি এমন এক সময় জন্মগ্রহণ করেন যখন অজ্ঞতা, কুসংস্কার ও ভন্ডামিতে ভরে উঠেছিল পৃথিবী। মানুষের মধ্যে না ছিল শুদ্ধতা, না ছিল নীতি-নৈতিকতা। খ্রিস্টীয় ধর্মগ্রন্থগুলো থেকে জানা যায়, যিশুর জন্মকালে আকাশ থেকে ভেসে এসেছিল দৈববাণী: ‘তোমাদের মঙ্গলের জন্য পৃথিবীতে এ রাতে ঈশ্বরের পুত্র এসেছেন।’ যিশুর জন্মের অনেক বছর পর থেকে খ্রিস্টানরা এ দিনটিকে আনন্দ ও মুক্তির দিন হিসেবে পালন করতে শুরু করেন। ৪৪০ সালে পোপ এ দিবসকে স্বীকৃতি দেন। তবে উৎসবটি জনপ্রিয়তা পায় মধ্যযুগে। সে সময় এর নাম হয় ‘ক্রিসমাস ডে’। বিশ্বের অধিকাংশ দেশেই ক্রিসমাস দিবসে সরকারি ছুটির দিন।
এদিকে বড়দিন উৎসবমুখর ও নিরাপদ পরিবেশে উদযাপনে প্রয়োজনীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। সামগ্রিক নিরাপত্তা নিশ্চিতে কিছু নির্দেশনা মেনে চলার অনুরোধ জানিয়েছে পুলিশ।
মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) রাজধানীর রমনার কাকরাইলে অবস্থিত সেন্ট মেরিস ক্যাথেড্রাল চার্চে বড়দিনের সার্বিক নিরাপত্তা মহড়া পরিদর্শন শেষে অতিরিক্ত কমিশনার (কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম) মো. মাসুদ করিম সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে বলেন, ঝুঁকি নিয়ে এখন পর্যন্ত আমাদের কাছে এমন কোনো তথ্য নেই, আমরা অত্যন্ত সতর্ক আছি। প্রতিবারের মতো এবারও বড়দিন নির্বিঘ্নে ও আনন্দঘন পরিবেশে উদযাপিত হবে।
বান্দরবানে শীতবস্ত্র বিতরণ ও চিকিৎসা সেবা প্রদান ॥ বড়দিন উপলক্ষে পাহাড়ে পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর মাঝে সেনাবাহিনীর উপহার সামগ্রী, শীতবস্ত্র বিতরণ, চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিতরণ কর্মসূচি অব্যাহত রয়েছে।
মঙ্গলবার বান্দরবানের রুমা সেনা জোনর তত্ত্বাবধানে খ্রিস্টান ধর্মাবলম্বীদের ধর্মীয় উৎসব বড়দিনের প্রাক্কালে শান্তি ও সম্প্রীতি বজায়ে দেবতা পাহাড় টিওবির আওতায় দুর্নিবারপাড়া এবং সন্নিহিত এলাকাসমূহে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান করা হয়। এ ছাড়া ক্যাপলংপাড়াস্থ গির্জাসমূহে ধর্ম যাজকদের মাঝে বাইবেল এবং কোমলমতী শিশুদের মাঝে খেলনা বিতরণ করা হয়। সেনাবাহিনীর ২৪ পদাতিক ডিভিশনের পক্ষ থেকে এ তথ্য জানানো হয়েছে।
তীব্র শীত মোকাবিলায় দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত শিশুদের মাঝে শীতবস্ত্র বিতরণ করা হয়। এসব কর্মসূচির উদ্বোধন করেন ৩৮ ইস্ট বেঙ্গলের উপ-অধিনায়ক মেজর মো. সাজ্জাদ হোসেন। তার নেতৃত্বে মেডিক্যাল টিম দেবতা পাড়াত টিওবির আওতায় দুর্নিবারপাড়ায় দুস্থ ও অসহায় উপজাতীয় জনগোষ্ঠীর মাঝে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা ও ওষুধ বিতরণ করা হয়। এ সময় সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়, এ প্রত্যন্ত অঞ্চলের উপজাতিদের চিকিৎসার মান বৃদ্ধির লক্ষ্যে বিনামূল্যে চিকিৎসাসেবা প্রদান কর্মসূচি প্রত্যন্ত অঞ্চলের মানুষের সুস্বাস্থ্য ও মানুষের প্রফুল্লতা বৃদ্ধিতে অবদান রাখবে।
এছাড়া সেনাবাহিনী শুরু থেকে উপজাতীয়দের মাঝে মানবিক চাহিদা পূরণের লক্ষ্যে নিয়োজিত রয়েছে। সেনাবাহিনীর এ কার্যক্রম চলাকালে জানানো হয়, খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের ধর্মীয় অনুভূতির প্রতি সম্মান জানিয়ে বড়দিন উদযাপনে সেনা তৎপরতা অব্যাহত রয়েছে। কর্মসূচি চলাকালে সেনা কর্মকর্তারা বলেন, তারা যেন যার যার অবস্থান থেকে নিরাপত্তা বাহিনীকে পার্বত্য অঞ্চলে শান্তি প্রতিষ্ঠায় সহযোগিতা অব্যাহত রাখেন।
সিরাজদিখানের খ্রিস্টান পল্লী বড়দিনে সাজ সাজ রব। মুন্সীগঞ্জে খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব বড়দিন ঘিরে উৎসব আমেজ। জেলার সিরাজদিখান উপজেলার কেয়াইন ইউনিয়নের শুলপুর খ্রিস্টান পল্লীতে চলছে সাজ সাজ রব। মঙ্গলবার রাত ৮টা ১ মিটিটে প্রার্থনার মধ্য দিয়ে শুরু হয় উৎসব। আজ হবে মূল উৎসব। বাড়ির সামনে সাজানো হয়েছে ক্রিস্টমাস ট্রি।
জেলার একমাত্র খ্রিস্টান পল্লীর পরিবারগুলো উৎসব এই নিয়ে মহাব্যস্ত। উপজেলার শুলপুর ‘সাধু যোাশেফ গির্জায়’ সাজানো হয়েছে দৃষ্টিনন্দন ঝলমলে আলোকসজ্জায়। গির্জার অভ্যন্তরে দৃষ্টিনন্দন ডিসপ্লে করা হয়েছে কুড়ে ঘরের অভ্যন্তরের মাদার মেরীর কোলে যিশু খ্রিস্টের প্রতিচ্ছবি। প্রার্থনা করতে আগত পুণ্যার্থীদের আগমন নিরবচ্ছিন্ন করতে তৈরি করা হচ্ছে বিশেষ ভলান্টিয়ার টিম। সব মিলিয়ে উৎসব জৌলুশ ছাড়াচ্ছে জেলার একমাত্র খ্রিস্টান পল্লী শুলপুর গ্রামে ।
রাজশাহী ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময়। রাজশাহী ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের নেতৃবৃন্দ বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সঙ্গে বড়দিনের শুভেচ্ছা বিনিময় করেছেন। মঙ্গলবার বিভাগীয় কমিশনার কার্যালয়ের সম্মেলন কক্ষে এ শুভেচ্ছা বিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। শুভেচ্ছা বিনিময়কালে ক্যাথলিক নেতৃবৃন্দ বিভাগীয় কমিশনারকে ফুলের তোড়া উপহার দেন। বিভাগীয় কর্মকর্তাদের পক্ষ থেকে বিভাগীয় কমিশনার খোন্দকার আজিম আহমেদ খ্রিস্টান সম্প্রদায়ের মানুষদের উদ্দেশে শুভকামনা জানান।
অন্যদিকে রাজশাহী ক্যাথলিক ধর্মপ্রদেশের বিশপ জের্ভাস রোজারিও সকলকে বড়দিনের শুভেচ্ছা ও প্রীতি জানান। তিনি শুভেচ্ছা বক্তব্যে বলেন, আমি আমাদের ধর্মগুরু রাজশাহী অঞ্চলের বিশপের পক্ষ থেকে আপনাদেরকে বড়দিনের শুভেচ্ছা জানাচ্ছি। বিশ্বের ক্যাথলিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে আমরা বাংলাদেশের অল্প কিছু খ্রিস্টান বড়দিনের খুশি সবার সঙ্গে ভাগাভাগি করছি। যিশু খ্রিস্টের পৃথিবীতে আগমন শান্তির বার্তা নিয়ে, পৃথিবীর সব মানুষ যেন শান্তিতে বসবাস করে, পারস্পরিক মিলন ও পারস্পরিক সৌহার্দ্য যেন মানুষের মধ্যে আরও বেশি বেড়ে যায়। মানুষের সার্বিক মুক্তির জন্য তিনি এসেছিলেন।

২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪।