এস.এম চিশতী
আর্সেনিক একটি মরণব্যাধী, নীরব ঘাতক রোগ। পানিজনিত সমস্যার ফলে এ মরণব্যাধী রোগটি মানুষের শরীরে ধীরে ধীরে বাসা বাঁধছে। যার শেষ পরিণতির নাম হচ্ছে মৃত্যু। দেশের প্রতিটি জেলাতেই কম-বেশি এ রোগটি ছড়িয়ে পড়ছে। সরকারিভাবে বিভিন্ন পদক্ষেপ নেয়া হলেও তা বাস্তবায়নে ত্রুটি থাকায় মৃত্যুর মাত্রা দিন-দিন বাড়ছে।
চাঁদপুর সদর হাসপাতাল সূত্রে জানা যায়, এ রোগটির প্রধান কারণ হচ্ছে প্রয়োজনের তুলনায় বিশুদ্ধ আর্সেনিকমুক্ত পানি পান না করা। তাই দেশের অন্যান্য জেলার মতো মরণব্যাধী এ আর্সেনিক রোগটি চাঁদপুরবাসীকেও গ্রাস করছে। সুপেয় মিঠা পানির উৎসস্থল পদ্মা-মেঘনা-ডাকাতিয়া নদীর তীরে সর্বগ্রাসী আর্সেনিকের ভয়াল থাবা প্রতিনিয়ত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে আর্সেনিকের রূপ। আর্সেনিক নিয়ে এখনই প্রতিরোধসহ পরবর্তী করণীয় নির্ধারণ করা না হলে জেলার প্রায় ৩০ লাখ মানুষের জীবনে নেমে আসবে অনিশ্চিত মরণব্যাধী আসেনিকোসিসের প্রাদুর্ভাব।
অবশ্য ইতোমধ্যে ব্র্যান্ডিং জেলা চাঁদপুরের সাধারণ মানুষ নীরব ঘাতক আর্সেনিক দ্বারা আক্রান্ত হয়ে নীরবেই প্রাণ বিসর্জন দিচ্ছেন, এমনটাই মনে করছেন এ জেলার সচেতন মহল। এছাড়া এ জেলার সাংবাদিক, শিক্ষাবিদ গুণীজন অনেকেই মনে করেন আর্সেনিক প্রতিরোধে নদীকেন্দ্রিক প্রকল্প সহায়ক হতে পারতো। অথচ নদীবেষ্টিত চাঁদপুরের নদীকে ঘিরে কোনো প্রকল্প আজঅবধি গ্রহণ করা হয়নি। তবে বাংলাদেশ আর্সেনিক মিটিগেশন ওয়াটার সাপ্লাই প্রকল্প চাঁদপুরে বাস্তবায়ন হলেও কিন্তু সঠিক উদ্যোগ গ্রহণের অভাবে চাঁদপুরে আর্সেনিক প্রতিরোধে কোনো প্রকল্পই সুফল বয়ে আনতে পারেনি!
সিইজিআইএস পরিচালিত এক সমীক্ষায় দেখা যায়, এ জেলার বেশিরভাগ গ্রামীণ এলাকায় অগভীর নলকূপের পানিই প্রধান উৎস। কারণ স্বল্প খরছে অগভীর নলকূপের পানি সহজে উত্তোলন করা যায় আর এ পানি নিরাপদ মনে করেই সবাই নিয়মিত ব্যবহার করছেন। যার ফলে নিরবে আর্সেনিকে আক্রান্ত হয়ে অসংখ্য পরিবার ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন।
আর্সেনিকে ক্ষতিগ্রস্ত মতলব উপজেলার ডিঙ্গাভাঙ্গ গ্রামের আব্দুর রব বলেন, সরকারিভাবে গভীর নলকূপ বসানের খরচ ৪ হাজার ৫শ’ টাকার পরিবর্তে ১২ হাজার টাকা ব্যয় করে ৮শ’ ফুটের গভীর নলকূপ বসানোর পর কন্ট্রাক্টর ফিল্টার কম দেয়ায় গভীর নলকূপটি নষ্ট হয়ে যায়। এরপর স্বল্পখরচে অগভীর নলকূপ বসিয়ে পানি ব্যবহার করছি। এতে সমস্যয় পড়েছি। এ এলাকায় অসংখ্য ৮শ’ ফুট গভীর নলকূপ ফিল্টার কম দেয়ার কারণে নষ্ট হয়ে পড়ে রয়েছে! তিনি দৈনিক ইল্শেপাড় পত্রিকার মাধ্যমে সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করেন, ৮শ’ ফুট গভীর নলকূপে কম পক্ষে ৫টি ফিল্টার দেয়া হলে গভীর নলকূপগুলো নষ্ট হতো না। মাত্র দু’টি ফিল্টার দেয়ার কারণেই গভীর নলকূপগুলো নষ্ট হয়ে যায়। যার ফলে গভীর নলকূপের পানির যে সুবিধা তা থেকে আমরা বঞ্চিত হচ্ছি।
চাঁদপুর জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ থেকে প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, চাঁদপুরে প্রথম আর্সেনিক শনাক্ত হয় ১৯৯৩ সালে। এরপর থেকে জেলার ৮টি উপজেলার অধিকাংশ নলকূপের পানিতে আর্সেনিক শনাক্ত হতে থাকে, এর ধারবাহিকতায় ধীরে ধীরে জেলার সর্বত্রই বাড়তে থাকে আর্সেনিকের থাবা।
একটি পরিসংখ্যান অনুযায়ী বর্তমানে চাঁদপুর জেলার ৮টি উপজেলার প্রায় ৩০ লাখ জনসংখার মধ্যে আর্সেনিকের মাত্রা হাজীগঞ্জে ৯৮.০৬ শতাংশ। এছাড়া চাঁদপুর সদর উপজেলায় ৭২.৭৮ শতাংশ। মতলব দক্ষিণে ৯১.৬০ শতাংশ । মতলব উত্তর উপজেলায় ৮২. ৮৮ শতাংশ। হাইমচর উপজেলায় ৮২. ১৭ শতাংশ। শাহরাস্তি উপজেলায় ৯৮ দশমিক ৬৬ শতাংশ। কচুয়ায় উপজেলায় ৯৫ দশমিক ৭৪ শতাংশ ও ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ৯৮ দশমিক ৫৪ শতাংশ মানুষ আর্সেনিকের ঝুঁকিতে রয়েছে।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ক্লিনিক সূত্রে জানা যায়, ১৯৯৬ সালে শাহাপুর গ্রামের কবিরাজবাড়ির পরিমল কান্তি মজুমদার প্রথম আর্সেনিক আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুবরণ করেন। তার মৃত্যুর পর এ সংবাদ জেলার সব কয়টি উপজেলায় ছড়িয়ে পড়লে সাধারণ মানুষ ঘাতক আর্সেনিক সম্পর্কে সচেতন হতে শুরু করে। অবশ্য অনেকে পুকুরের পানি ফুটিয়ে পান করলেও, বর্তমানে জেলার বেশিরভাগ মানুষই এখনো আর্সেনিক দূষিত পানি পান করে থাকেন।
অথচ আর্সেনিকের হাত থেকে রক্ষা এবং বিশুদ্ধ পানি আহরণের উৎস হচ্ছে গভীর নলকূপ। আর প্রতি ১শ’ জনে ১টি করে এ গভীর নলকূপ প্রয়োজন। জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল বিভাগ থেকে জানা যায়, জেলায় কমপক্ষে ২৫ হাজার গভীর নলকূপের প্রয়োজন। অথচ এর বিপরীতে সরকারিভাবে সবর্ত্র গভীর নলকূপ স্থাপন করা হয়েছে এ পর্যন্ত ১৪ হাজার যার অধিকাংশ নষ্ট হয়ে পড়ে আছে।
বেসরকারি সংস্থার একটি জরিপ থেকে জানা যায়, জেলায় ১০ হাজার ৮শ’ ৫৫ জন আর্সেনিকোসিস রোগী শনাক্ত করা হয়েছে। উপজেলা ভিত্তিক পরিসংখ্যানে আর্সেনিকোসিস রোগে আক্রান্ত হয়েছে কচুয়া উপজেলায় প্রায় ১ হাজার, শাহরাস্তিতে প্রায় ৬ হাজার, হাজীগঞ্জে প্রায় ১ হাজার, মতলব দক্ষিণে প্রায় ৮শ’, মতলব উত্তরে প্রায় ৭শ’, চাঁদপুর সদরে প্রায় ৭শ’ হাইমচরে ১শ’ ৫৫ জন ও ফরিদগঞ্জ উপজেলায় প্রায় ৫শ’ জন রোগী পাওয়া গেছে। এ আতঙ্কজনক চিত্রই জানান দিচ্ছে আস্তে আস্তে জেলার মানুষ মরণব্যাধী আর্সেনিকোসিস রোগের দিকে ধাবিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে কয়েকজন আর্সেনিক বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের কাছ থেকে জানতে চাওয়া হলে, তারা সবাই একই কথা বলেন, তাদের মতে মানবদেহের জন্য পয়েন্ট ৪-এর উপর আর্সেনিক ধারাবাহিকভাবে আর্সেনিকোসিস রোগে পরিণত হয়। ফলে ঐ রোগীর হাত, পা, শরীরের বিভিন্ন অঙ্গ খোঁসা ও পচন দেখা দেয়। যা পরবর্তীতে চিকিৎসার মাধ্যমে সুস্থ করা সম্ভব হয় না। তারা আরো বলেন, এখনই এ রোগ প্রতিরোধ করা না গেলে চরম মূল্য দিতে হবে এ অঞ্চলে বসবাসকারী সাধারণ মানুষ ও তাদের পরবর্তী প্রজন্মকে।
এ নীরব ঘাতক আর্সেনিক রোগ নির্মূল এবং ব্র্যান্ডিং জেলা চাঁদপুরের ঐতিহ্য রক্ষায় সরকারের যথাযথ কর্তৃপক্ষ বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে সঠিক পরিকল্পনা গ্রহণ করবেন এমনটাই আশা করছেন এ জেলার সচেতন মহল।
৬ জানুয়ারি, ২০২১।