চাঁদপুরে পালকি বাহক বেহারা সম্প্রদায়ের মানবেতর জীবনযাপন

হাজার বছরের ঐতিহ্যের ধারক ‘পালকি’ আজ বিলুপ্ত!

এস এম চিশতী
একটি অনুসন্ধানে জানা যায়, ১৯৩০ খ্রিস্টাব্দে রিক্সার প্রচলন শুরু হলে মূলত পালকির ব্যবহার কমতে থাকে। ধীরে ধীরে যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্রমাগত উন্নতি হওয়ায় এবং মোটরচালিত গাড়ির জনপ্রিয়তার কারণে পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যায়। তাই এখন আর চাঁদপুর জেলার কোথায়ও, সেই প্রাণে দোলা দেয়া ‘হুমনা’ ধ্বনি ভেসে আসে না। কালের পরিক্রমায় বাঙালির ঐতিহ্যবাহী বাহন পালকি আজ চাঁদপুর থেকেও বিলুপ্ত হয়ে গেছে।
এ কথা সর্বজন স্বিকৃত যে, এক সময়ে বাঙালির বিয়ে অনুষ্ঠানে একমাত্র ঐতিহ্য ছিল পালকি। বর-কনেকে বাহনের অন্যতম এ মাধ্যম পালকি আজ প্রায় বিলুপ্ত। তাই বাংলার হাজার বছরের প্রাচীন ঐতিহ্যের ধারক ‘পালকি’ আজ আর চোখে পড়ে না। অথচ কিছুদিন আগেও চাঁদপুর জেলার প্রতিটি গ্রামের পথে ‘হুমনা’ ‘হুমনা’ ধ্বনির তালে তালে পা ফেলে, সুরেলা ছন্দময় ধ্বনি ছড়িয়ে যারা পালকিতে বহন করতো নব বধূ কিংবা বর, আজ সেসব পালকি শিল্পীরা অসহায় হয়ে মানবেতর জীবনযাপন করছে।
এ বিষয়ে কথা হয়, মতলব উপজেলার আঁচলাচিলা গ্রামের বাসিন্দা পালকি শিল্পী শাহনেয়াজ সবুর সাথে। তিনি আবেগ জড়ানো কণ্ঠে বলেন, আমরা যখন রঙিন ঝালর দেয়া আর নানা রঙের ফুল ও কাগজে সাজানো পালকি কাঁধে নিয়ে হাঁটতাম তখন পালকির ভেতর ঘোমটা দেয়া বধূর মুখখানি দেখতে আশপাশের মানুষ এসে দাঁড়াতো রাস্তার পাশে। আর তখন লাজুক মুখে নববধূও দরজার ফাঁক দিয়ে চোখ মেলে তাকাতো বাইরের দিকে। সে দৃশ্য উপভোগ করে অনেকেই খুশি হয়ে আমাদের বকশিস দিতো। আজ বয়সের ভারে নুয়ে পড়েছি, অনেক কষ্টে দিন চলছে, কিন্তু সে সোনালী স্মৃতি আজো ভুলতে পারিনি।
সবুরের সাথে কাজ করা ৭০ বছরের আরেক সঙ্গী বৃদ্ধ সুরুজ মিয়া বলেন, যৌবনে গায়ে শক্তি থাকতে আমরা বেহারা পেশাককে শ্রদ্ধার সঙ্গে গ্রহণ করেছিলাম। হঠাৎ আধুনিকতার হাওয়ায় পালকির ব্যবহার বন্ধ হয়ে যাওয়ায় কাঠমিস্ত্রি হিসেবে জীবিকা নির্বাহ করে পরিবার-পরিজন নিয়ে বহু কষ্টে কনো রকমে বেঁচে আছি। বয়সের কারণে তাও এখন আর পারছি না।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক হাজীগঞ্জ উপজেলা শহরের এক বেহারাশিল্পী কান্নাজড়িত কণ্ঠে বলেন, আমি আমার সে অতীত পরিচয় দিতে চাই না, কারণ বর্তমান আধুনিকতার ছোঁয়ায় মানুষ পালকি বাহকদের মানুষই মনে করে না, এদের ধারণা পালকি বাহকরা নিম্ন শ্রেণির অর্থাৎ নিচু জাতের লোক ছিলো। অমানুষ না হলে মানুষকে কাঁধে করে হাঁটা কী সম্ভব ছিলো? এটা যে বাঙালির ঐতিহ্য তা অনেকেই মানতেই চায় না। তিনি আক্ষেপ করে আরো বলেন, লেখালেখি করে কি লাভ হবে, বরং আমার আছে সম্মানটুকু নষ্ট হবে। তাই আল্লাহর ওয়াস্তে আমার নাম নিয়ে কোনো লেখালেখি করবেন না, আমার দুঃখ আমারই থাক।
অনুভূতি জানতে কথা হয় ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা গ্রামের মুন্সি বাড়ির ৬৮ বছরের আমেনা বেগমের সাথে। তিনি বলেন, আমার বাবার বাড়ি হাজীগঞ্জ উপজেলা মালা পাড়া গ্রামে। আমার ১৩ বছর বয়সে বিয়ে হয়। আমি বাপের বাড়ি মালাপাড়া ছেড়ে পালকিতে চড়েই ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা গ্রামে আমার স্বামীর ঘরে আসি। তখন গ্রামে একটি ঐতিহ্য ছিলো বিয়ে করা দুলা আর দুলাইনকে পালকিতে তুলে বেহারারা কাঁধে নিয়ে চলতো আর তাদের মুখে থাকতো ছন্দের যাদু করা শব্দ ‘হুমনা’ ‘হুমনা’ এখনো আমার কানে যেনো ভেসে আসছে সে যাদুকরী ধ্বনি। আজো জীবনের শেষ বেলায় ভুলতে পারিনি সেই দিনের স্মৃতি।
এ বিষয়ে সরেজমিনে কথা হয়, চাঁদপুর সরকারি কলেজের একজন জনপ্রিয় শিক্ষক এবং মনমাতানো গায়ক আলমগীর হোসেন বাহারের সাথে। তিনি বলেন, আমাদের দেশীয় সুপ্রাচীন সংষ্কৃতির চর্চা ও বিলুপ্ত হওয়া ঐতিহ্য আবার প্রচলন করতে পারা সেটি গর্বের বিষয়। আমি শিক্ষকতার পাশাপাশি গানের মাধ্যমে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্য ধরে রাখতে চেষ্টা করে যাচ্ছি। আমরা সবাই মিলে যদি আন্তরিক হই, তাহলে আমাদের সমাজ থেকে বিলুপ্ত হওয়া সে পালকির ব্যবহার আবার নতুন করে চালু করা কঠিন কিছু নয়। আমি মনে করি যান্ত্রিক জীবনে বিয়ের আনুষ্ঠানিকতায় আবার পালকির প্রচলন হলে নতুন প্রজন্মের কাছে নতুন আমেজে বিবাহ অনুষ্ঠান আরো প্রাণবন্ত হয়ে অনুষ্ঠানে বরং ভিন্নতা আসবে। আলমগীর হোসেন বাহারের সাথে কণ্ঠ মিলিয়ে সচেতন মহলও এমনটাই প্রত্যাশা করেন।
১২ নভেম্বর, ২০২০।