চাঁদপুরে সক্ষমতা না থাকলেও প্রাথমিকে গুগুল মিটে ক্লাশ

প্রাথমিক শিক্ষায় অনলাইনে ক্লাশ

ইল্শেপাড় রিপোর্ট
চাঁদপুরে সক্ষমতা না থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে গুগুল মিটে ক্লাশ নেয়া শুরু হয়েছে। কিন্তু শিক্ষার্থী সংকটে গুগুল মিটের ক্লাশগুলো তেমন একটা জমে উঠছে না। মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা ও জেলার কর্মকর্তাদের তদারকিতে গুগুল মিটে শিক্ষকরা ক্লাশ করাতে বাধ্য হলেও শিক্ষার্থীদের নানা সংকটের কারণে এতে তেমন ফল পাওয়া যাচ্ছে না।
প্রাথমিকের শিক্ষার্থীদের অধিকাংশের অভিভাবকের স্মার্ট ফোন না থাকায় তা’ ফলপ্রসু হচ্ছে না বলে অভিমত বিশেষজ্ঞদের। এছাড়া রয়েছে এমবি বা ইন্টারনেট সংযোগের অভাব। চাঁদপুর সদর উপজেলার এমনও প্রাথমিক বিদ্যালয় আছে যেখানে দেড়শ’ শিক্ষার্থীদের মধ্যে তাদের ৫ জন বাবা/মায়ের স্মার্ট ফোন রয়েছে। ফলে গুগুল মিটের কাল্পনিক ক্লাশে আগ্রহী হতে পারছে না শিক্ষার্থীরা। অপরদিকে বাস্তব অবস্থা না বুঝেই প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগের হর্তাকর্তারা আদেশ জারি করেই শেষ, বাস্তবায়ন বা পরিস্থিতি তারা বুঝতে চান না।
চাঁদপুরের বেশ ক’জন প্রাথমিক শিক্ষার্থীর সাথে আলাপ করে জানা যায়, তারা এ ধরনের ক্লাশে তেমন কিছু বুঝতে পারছে না। এছাড়া অনেক সময় তাদের বাবা-মা ব্যস্ত থাকায় তারা ক্লাশে অংশ নিতেও পারছে না। আবার রয়েছে এমবি বা ইন্টারনেট কেনার খরচ।
এদিকে করোনা মহামারীর সংকটে এক বছরের বেশি সময় ধরে দেশের সব ধরনের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় প্রতিনিয়ত ব্যাহত হচ্ছে লাখ-লাখ শিক্ষার্থীদের শিক্ষা জীবন। শিক্ষা জীবনে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে প্রাথমিকের শিক্ষার্থীরা। কারণ তাদের সামগ্রিক শিক্ষা পদ্ধতিটাই হচ্ছে হাতে-কলমের শিক্ষা। আর চাঁদপুর জেলায় ২ লাখ ১৯ হাজার ৪শ’ ২ জন শিক্ষার্থী বর্তমানে অধ্যয়নরত রয়েছে।
এসব কোমলমতি শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় বন্ধ থাকায় হাতে-কলমে পাঠদান আর বাস্তবায়ন করা সম্ভব হচ্ছে না। বিকল্প হিসেবে অনলাইনে জুম কিংবা গুগুল মিটের মাধ্যমে ক্লাশ পরিচালনার নীতিগত সিদ্ধান্ত নেয় প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তর।
ফলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা সচিব গত ১৬ মে দেশের সব জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারকে মৌখিক নির্দেশনা প্রদান করে অনলাইনভিত্তিক গুগুল মিট এ্যাপসে’র মাধ্যমে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের ক্লাশ নিশ্চিত করার জন্য।
চাঁদপুর জেলার সব প্রাথমিক বিদ্যালয়ে অনলাইনে ক্লাশ পরিচালনার জন্য প্রস্তুতি নেয় জেলা শিক্ষা অফিস। এজন্য শিক্ষার্থীদের তালিকা প্রণয়ন করে জেলা শিক্ষা অফিস। ফলে বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা যাতে অনলাইন গুগুল মিট অ্যাপের মাধ্যেমে ক্লাশ পরিচালনা করতে পারে, সেজন্য সব শিক্ষকদের প্রতিদিন বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকার জন্য মৌখিক নির্দেশ দেন জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার।
এমন নির্দেশনার পর-পরই দেশে শুরু হয় করোনার দ্বিতীয় ঢেউ। শিক্ষকদের বিদ্যালয় গিয়ে ক্লাশ পরিচালনা করা বন্ধ হলেও বাসা-বাড়ি থেকে ক্লাশ পরিচালনার নির্দেশা দেয় জেলা শিক্ষা অফিস।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসারে নির্দেশনায় শিক্ষকরা অনলাইনে নিয়মিত শিক্ষার্থীদের পাঠদান অব্যাহত রাখে। এজন্য শিক্ষকরা গত এক বছর সরাসরি মোবাইল কল, জুম অ্যপস, গুগুল মিট কিংবা ইমুর মতো সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে পাঠদান অব্যাহত রাখায় শিক্ষার্থী ঝড়েপড়ার পরিস্থিতি অনেকটাই কমে আসছে বলে জানা গেছে।
চাঁদপুরে প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের সক্ষমতা যাচাই করে দেখা গেছে, জেলায় ২৯ হাজার ৮৩ জন অভিভাবক মোবাইলে ইন্টারনেট ব্যবহার করে। তবে তাদের অনেকেই কেবল স্বজনদের সাথে দেশ-বিদেশে কথোপকথন করার জন্যই মূলত মাঝে-মাঝে ইন্টারনেট ব্যবহার করেন।
যদিও চাঁদপুরের কর্মরত প্রাথমিক শিক্ষকরা বলছেন, কোমলমতি শিক্ষার্থীদের শ্রেণি কক্ষের হাতে-কলমের পাঠদানের বিকল্প নেই। তবে অনলাইন ক্লাশের মাধ্যমে কেবল শিক্ষার্থীদের পাঠ্যবইয়ের দিকে মনোযোগ ধরে রাখার চেষ্টা করা হচ্ছে। তবে তা এখনো হাতে কলমের বিকল্প বা যথেষ্ট নয় বলে শিক্ষকরা জানিয়েছেন।
চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের সূত্রমতে জেলায় মোট প্রাথমিক বিদ্যালয়ের রয়েছে ১ হাজার ৫৬টি। উপজেলা ভিত্তিক ফরিদগঞ্জে ১শ’ ৯০টি, চাঁদপুর সদরে ১শ’ ৭২টি, হাজীগঞ্জে ১শ’ ৫৭টি, শাহরাস্তিতে ১শ’ ১টি, কচুয়ায় ১শ’ ৭১টি, মতলব দক্ষিণে ১শ’ ১৩টি, মতলব উত্তওে ১শ’ ৮০টি ও হাইমচর উপজেলায় ৭২টি প্রাথমিক বিদ্যালয় রয়েছে।
চাঁদপুর জেলার সবগুলো প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বর্তমানে কর্মরত শিক্ষক আছেন ৭ হাজার ২শ’ ১ জন। এর মধ্যে ফরিদগঞ্জে ১ হাজার ১শ’ ৬৭ জন, চাঁদপুর সদরে ১ হাজার ১শ’ ৭৫ জন, হাজীগঞ্জে ৯শ’ ৫৬ জন, শাহরাস্তিতে ৬শ’ ৮০ জন, কচুয়ায় ১ হাজার ৩২ জন, মতলব দক্ষিণে ৬শ’ ৭৫ জন, মতলব উত্তরে ১ হাজার ৬২ জন ও হাইমচর উপজেলায় ৪শ’ ৭ জন রয়েছেন।
গত ১৬ মে থেকে সচিবের মৌখিক সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস, উপজেলা শিক্ষা অফিস ও জেলার সব প্রাথমিক শিক্ষকরা তা বাস্তবায়নে কাজ করে আসছে। তবে মাঠ পর্যায়ে তা বাস্তবায়নে শিক্ষকদের ব্যাপক হিমশিম খেতে হচ্ছে। এমনকি শিক্ষকদের বিব্রত অবস্থায় পড়তে হচ্ছে বলে অনেক শিক্ষক অভিযোগ করছেন।
জেলার কর্মরত শিক্ষকরা বলছেন, জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস ইতিমধ্যে অনলাইনে গুগুল মিট অ্যাপসের মাধ্যামে প্রতিদিন শিক্ষার্থীদের ক্লাস নেয়ার জন্য নির্দেশনা প্রদান করেছেন। তা বাস্তবায়নে উপজেলা শিক্ষা অফিস ও উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসাররা মাঠ পর্যায়ে তদারকি করছে।
সাধারণ শিক্ষকরা বলছেন, শিক্ষার্থীদের প্রতিদিন নির্ধারিত সময়ে ক্লাস নিশ্চিত করা সম্ভব হচ্ছে না। বরং বিরম্বনা বাড়ছে। কারণ প্রাথমিক শিক্ষার্থীদের নিজস্ব কোন মোবাইল নেই। আবার তাদের নেই কোন মোবাইল অপরেটিং অভিজ্ঞতা।
আবার মফস্বল পর্যায়ের অধিকাংশ অভিভাবকরাই অস্বচ্ছল। তাদের কারো অ্যান্ড্রয়েড মোবাইল থাকলেই নেই নিয়মিত ইন্টারনেট ক্রয়ের সক্ষমতা। ফলে অধিকাংশ শিক্ষার্থীই অনলাইন সুবিধা নিতে পারছে না। এছাড়া শিক্ষকরা অনলাইন ক্লাশ পরিচালনার জন্য ইন্টারনেট খরচও পাচ্ছে না শিক্ষা অফিস থেকে। এতে করে বিব্রত স্ব-স্ব বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষকরা।
বর্তমানে বিকল্প পাঠাদনের জন্য সর্ট সিলেবাসের অ্যসাইনমেন্ট বাড়ি বাড়ি গিয়ে শিক্ষার্থীদের হাতে-হাতে তুলে দিতে হচ্ছে। করোনাকালীন এমন সময়ে তা বাস্তবায়নে শিক্ষকরা যেমন স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে পরছে, তেমনি তাদের পরিবার ও স্বজনরাও বিব্রত হচ্ছে। পাশাপাশি শিক্ষকদের বাড়ি-বাড়ি আগমনে অনেক অভিভাবকও বিব্রত বলে জানা গেছে।
বর্তমানে করোনার ভয়াবহ প্রকোপ বৃদ্ধিতে শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের নিরাপদে নিজ আবাসস্থলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে অবস্থান করা একান্ত বলে মনে করেন অভিভাবকরা। এমতাবস্থায় প্রাথমিক শিক্ষকদের বাড়ি বাড়ি প্রেরণ করা ও শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্য ঝুঁকিতে রাখা কতাটা যুক্তিসঙ্গত।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সুত্রে জানা গেছে, জেলার সবকটি উপজেলায় আইটি পুল রয়েছে। এইসব আইটি পুল পরিচালনা করছেন সংশ্লিষ্ট ক্লাস্টারের উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসাররা। আর জেলায় আইটি পুল মোট শিক্ষক রয়েছেন ৪শ’ ৪৩ জন। উপজেলাভিত্তিক হচ্ছে- ফরিদগঞ্জে ৪৮ জন, চাঁদপুর সদরে ২০ জন, হাজীগঞ্জে ৭০ জন, শাহরাস্তিতে ১শ’ ১জন, কচুয়ায় ৬০ জন, মতলব দক্ষিণে ৪৯ জন, মতলব উত্তরে ৮০ জন ও হাইমচর উপজেলায় ২৪ জন শিক্ষক।
নাম না প্রকাশের শর্তে আইটি পুলের বেশ কয়েকজন শিক্ষক এই প্রতিবেদককে জানান, আইটি পুল মূলত কাগজ-কলমের হিসাব। যেসব উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসারদের সমন্বয়ে আইটি পুল করা হয়েছে সেসব শিক্ষা অফিসারেরও আইটি সম্পর্কে তেমন ধারণা নেই।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসের তথ্যমতে বর্তমানে ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ৬ হাজার ৬১ জন, চাঁদপুর সদরে ২ হাজার ২শ’ ৩৮ জন, হাজীগঞ্জে ২ হাজার ৮শ’ ২১ জন, শাহরাস্তিতে ১ হাজার ২শ’ ৩৫ জন, কচুয়ায় ৪ হাজার ১৩ জন, মতলব দক্ষিণে ৩ হাজার ৪শ’ ৯ জন, মতলব উত্তরে ৬ হাজার ৭শ’ ৭২ জন ও হাইমচর উপজেলায় ২ হাজার ৫শ’ ৯৪ জন শিক্ষার্থীর এমন সক্ষমতা আছে। যারা গুগুল মিট ব্যবহার করে অনলাইনে ক্লাস করতে পারবে।
চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস বলছে, তাদের চলিত শিক্ষাবর্ষে মোট শিক্ষার্থী রয়েছে ২ লাখ ১৯ হাজার ৪শ’ ২ জন। তার মধ্যে ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ৩৬ হাজার ৮শ’ ৯৭ জন, চাঁদপুর সদরে ৩৭ হাজার ৪শ’ ৮৮ জন, হাজীগঞ্জে: ৪০ হাজার ৩শ’ জন, শাহরাস্তিতে ১৩ হাজার ৪শ’ ৮৪ জন, কচুয়ায় ২৯ হাজার ৮৯ জন, মতলব দক্ষিণে ১৬ হাজার ২শ’ ৩৪ জন, মতলব উত্তরে ২৬ হাজার ৮শ’ ৭৫ জন ও হাইমচর উপজেলায় ১৩ হাজার ৪শ’ ৮৪ জন শিক্ষার্থী।
জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস সূত্র জানিয়েছে, তাদের গুগুল মিট প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত শিক্ষক হচ্ছে ৪ হাজার ৯শ’ ৫০ জন। এরমধ্যে উপজেলা ভিত্তিক ফরিদগঞ্জে ১ হাজার ১শ’ ৬৭ জন, চাঁদপুর সদরে ১ হাজার ১শ’ ৭৫ জন, হাজীগঞ্জে ৪শ’ ৬৫ জন, শাহরাস্তিতে ৩শ’ ১৫ জন, কচুয়ায় ৩শ’ ৮৭ জন, মতলব দক্ষিণে ২ হাজার ২৬ জন, মতলব উত্তরে ১ হাজার ১২ জন ও হাইমচর উপজেলায় ২শ’ ৩ জন শিক্ষক।
এ জেলায় উপজেলা সহকারী শিক্ষা অফিসারদের সমন্বয়ে মোট ক্লাস্টার রয়েছে ৪৮টি। ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ৮টি, চাঁদপুর সদরে ৭টি, হাজীগঞ্জে ৭টি, শাহরাস্তিতে ৪টি, কচুয়ায় ৭টি, মতলব দক্ষিণে ৪টি, মতলব উত্তরে ৮টি ও হাইমচর উপজেলায় ৩টি ক্লাস্টার রয়েছে। যারা অনলাইনের শিক্ষক পুল ও গুগুল মিট ক্লাস তদারকি করে থাকেন।
ফলে সক্ষমতা না থাকলেও প্রাথমিক শিক্ষা বিভাগে গুগুল মিটে ক্লাশ কোন বাস্তবধর্মী বিষয় নয়। এছাড়া শিক্ষকদের বাড়ি-বাড়ি গিয়ে শিক্ষাদানও অভিভাবকরা পছন্দ করছেন না। ফলে এর বাইরে কোন পদ্ধতি বের না করা পর্যন্ত করোনাকালে কিছু করা ঠিক হবে না বলে অভিমত বিশিষ্টজনদের।
১৯ আগস্ট, ২০২১।