চাঁদপুর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক সভা

প্রধানমন্ত্রীর উপহার দুস্থ ছাড়া অন্যদের হাতে গেলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা
…….জেলা প্রশাসক বেগম অঞ্জনা খান মজলিশ

শাহ্-আলম খান
চাঁদপুর জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির মাসিক সভা গত বৃহস্পতিবার (২৯ এপ্রিল) সকাল সাড়ে ১০টায় ভার্চুয়ালি অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় সভাপতিত্ব করেন জেলা উন্নয়ন সমন্বয় কমিটির সভাপতি ও জেলা প্রশাসক বেগম অঞ্জনা খান মজলিশ।
সভাপতির বক্তব্যে জেলা প্রশাসক বেগম অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, চাঁদপুরসহ সারাদেশে এখন একটি ক্রিটিক্যাল সময় চলছে। বিশেষ করে বৈশ্বিক মহামারি করোনার দ্বিতীয় ঢেউ আমাদের বিপর্যয়ের মুখে ঠেলে দিয়েছে। আমাদের সরকার তথা প্রধানমন্ত্রী সাধ্যমতো চেষ্টা করে যাচ্ছেন এ থেকে পরিত্রাণ পাওয়ার জন্যে। আমি জানি অনেক মানুষই এই লকডাউনে অনেক কষ্টে জীবনযাপন করছেন। কিন্তু আপনাকে আগামি দিন বেঁচে থাকতে, আত্মীয়-স্বজনকে দেখতে এবং সবাইকে রক্ষা করতে হলে একটু কষ্ট করতেই হবে।
তিনি বলেন, করোনা এবং রমজানকে পুঁজি করে কিছু লোক সাধারণ জনগণকে ঠকানোর চেষ্টা করছে বিভিন্নভাবে। জেলা প্রশাসক আরো বলেন বলেন, চারটি মোবাইল কোর্ট এখানে দিনরাত কাজ করছে। এছাড়া উপজেলাগুলোতেও উপজেলা নির্বাহী অফিসারদের নেতৃত্বে মোবাইল কোর্ট কাজ করে যাচ্ছে। আমাদের এই কোর্টগুলো সড়কে যানবাহন নিয়ন্ত্রণ, ভেজাল দ্রব্য ধরা ও বাজার মনিটরিংসহ বিভিন্ন রকম কাজ করে যাচ্ছে। এসব কাজে এবং গত দু’মাস নদীতে জাটকা নিধন রোধে আমাদের সাথে ছিলেন চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাংবাদিকবৃন্দ।
তিনি বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই সময়ে ত্রাণ তৎপরতা তথা প্রধানমন্ত্রীর উপহার হিসেবে প্রত্যেক পৌরসভা ও প্রত্যেক ইউনিয়নের জন্যে অর্থ বরাদ্দ মিলেছে। প্রতিটি ইউনিয়নের জন্যে ২ লাখ ৫০ হাজার টাকা এবং পৌরসভাগুলোর জন্যে শ্রেণি অনুপাতে বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। এছাড়া ভিজিএফ কার্ডধারী যারা আছেন তারা চালের পরিবর্তে নগদ টাকা পাবেন।
জেলা প্রশাসক বলেন, প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপহার প্রতিজনকে খামের মধ্যে ‘মুজিববর্ষ ও করোনাকালীন সময়ের উপহার’ প্রদান করার জন্যে সংশ্লিষ্টদের অনুরোধ জানানো হয়েছে। এজন্যে ইতোমধ্যে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হয়েছে। দুঃস্থ, অসহায় ও কর্মহীন ব্যক্তি ছাড়া অন্য কেউ যেনো এই অর্থ না পায় সেদিকে দৃষ্টি রাখার জন্যে জনপ্রতিনিধিদের ভূমিকা রাখার অনুরোধ জানান তিনি। প্রধানমন্ত্রীর উপহার অপব্যবহার তথা দুঃস্থদের হাতে না দিয়ে অন্যদের হাতে যদি যায় তাহলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেয়া হবে।
তিনি আশা করেন, এ রকম কিছু চাঁদপুরে হবে না। এ বিষয়ে জনপ্রতিনিধি এবং দায়িত্বপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তারা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তার বক্তব্য প্রসঙ্গে ক্ষোভ প্রকাশ করে বলেন, প্রতি জেলেকে ৪০ কেজি করে চাল দেয়া হয়। যা তারা ঠিকমতো পায় না বলে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। ভবিষ্যতে যাতে এ ধরনের অভিযোগ না আসে সেজন্যে তিনি প্রস্তাব দেন চাল নয়, কৃষকদের মতো নগদ অর্থ ব্যাংকিং ব্যবস্থার মাধ্যমে জেলেদের দেয়া যায় কি-না সে বিষয়ে একটি প্রস্তাব তৈরি করতে।
তিনি আরো বলেন, জাটকা নিধনে অনেক জনপ্রতিনিধি জেলেদের সহায়তা করেন। যা অত্যন্ত দুঃখজনক। তারা অনেকে জাল, নৌকা অথবা উৎসাহ প্রদান করে জেলেদের নদীতে নামান। আগামি মা ইলিশ রক্ষা কার্যক্রমের আগে জেলেদের হালনাগাদ তালিকা প্রদান করতে হবে। কোনো অপ্রকৃত জেলে এই তালিকায় থাকতে পারবে না। মৃত জেলেদের নাম বাদ দিতে হবে। জেলেদের খাঁচায় মাছ চাষে উৎসাহ ও প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দিতে হবে।
সভায় পুলিশ সুপার মো. মিলন মাহমুদ বলেন, আগামি ৫ মে পর্যন্ত লকডাউন বাড়ানো হয়েছে। আমাদের পুলিশ বাহিনী প্রতিনিয়ত লকডাউন বাস্তবায়নে কাজ করে যাচ্ছে। কঠিন চ্যালেঞ্জ হচ্ছে সড়কগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করা। যদিও দূরপাল্লার যানবাহন চলা বন্ধ রয়েছে। কিন্তু ছোট-ছোট কিছু যানবাহন চলাচলা করলেও তা আমরা আটক করছি। তবে মানবিক বিবেচনায় শর্তসাপেক্ষে কয়েকদিন পর ওই গাড়িগুলোকে ছেড়ে দেয়া হচ্ছে। এ কাজগুলো অত্যন্ত কঠিন। এরা খেটে খাওয়া মানুষ। এদের দমিয়ে রাখা অত্যন্ত কষ্টকর। তারপরও সরকারি বিধি-নিষেধ বাস্তবায়নে আমাদের তা করতে হচ্ছে।
পুলিশ সুপার আরও বলেন, মার্কেটগুলো খুলে দেয়াতে সেখানে মানুষজন অযথা ভিড় করছে। কিন্তু সড়কে প্রয়োজন ছাড়া যানবাহন চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে হলে সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। সমন্বিত প্রচেষ্টা ছাড়া এ কাজে সফলতা লাভ করা যাবে না। এজন্যে তিনি জনপ্রতিনিধি, সাংবাদিক ও জনসাধারণের সহযোগিতা কামনা করেন।
সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্লাহ বলেছেন, ২৫০ শয্যা বিশিষ্ট চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে ৩ বেডের আইসিইউ ইউনিট স্থাপনের কাজ দ্রুত এগিয়ে চলছে। লিকুইড অক্সিজেন প্ল্যান্ট স্থাপন করা হচ্ছে। যা দিয়ে সমগ্র হাসপাতালটি অক্সিজেনের আওতায় আসবে। অর্থাৎ সবগুলো বেডেই সেন্ট্রাল অক্সিজেন ব্যবহার করতে পারবে। আর এই কাজটি ঈদের আগেই সম্পন্ন করা হবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ জানিয়েছে।
চাঁদপুরের প্রত্যেক উপজেলায় আরটি পিসিআর টেস্ট ল্যাব স্থাপন করা হচ্ছে। এতে এখন থেকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনার টেস্ট করা যাবে এবং ৩০ মিনিটের মধ্যে ফলাফল পাওয়া যাবে। তিনি বলেন, করোনামুক্ত থাকতে হলে স্বাস্থ্যবিধি মেনে চলতে হবে।
সিভিল সার্জন আরো বলেন, গত এক মাসে চাঁদপুর ৪ হাজার ৫শ’ টেস্টের মধ্যে ১ হাজার ৪২ জন করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন। মৃত্যুর সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। গত এপ্রিল মাসেই ২২ জনের মৃত্যু হয়েছে। সারাদেশে মৃত্যুর হার যেখানে ১.৫ সেখানে চাঁদপুরে ২.৫ হয়ে গেছে। এটি অত্যন্ত ভয়ানক আশঙ্কা তৈরি করছে।
তিনি বলেন, করোনার দ্বিতীয় ঢেউয়ের এই সময়ে আমাদের এখানে দেখা যাচ্ছে যে, আগে যেমন করোনাভাইরাসটি শরীরের বিভিন্ন স্থান আক্রমণ করার পর ফুসফুসে আক্রমণ করতো কিন্তু এখন দেখা যাচ্ছে এটি সরাসরি ফুসফুসে আক্রমণ করছে। যা অত্যন্ত ভয়ানক। করোনার উপসর্গ দেখা দেয়ার এক-দুইদিনের মধ্যে করোনার টেস্ট করে পজিটিভ হলে আক্রান্তদের হাসাপাতালে ভর্তি হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।
জেলা পরিষদের প্রধান নির্বাহী মো. মিজানুর রহমান বলেন, মুজিববর্ষ ও করোনাকালীন সময়ে জেলা পরিষদের উন্নয়ন কার্যক্রম চলমান রয়েছে। করোনা রোধকল্পে স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয় থেকে ৫০ লাখ টাকা বরাদ্দ পেয়েছি। ঐ বরাদ্দ থেকে ১ লাখ ২ হাজার মাস্ক, ৬৫ হাজার সাবান এবং ৩ হাজার ৮শ’ হ্যান্ডস্যানিটাইজার ক্রয় করা হয়েছে। সেখান থেকে চাঁদপুরের ৯১টি ইউনিয়নের প্রতিটিতে ৬শ’ মাস্ক, ৪শ’ ৩২টি সাবান এবং ২৪টি করে হ্যান্ডস্যানিটাইজার এবং প্রতিটি পৌরসভায় ১ হাজার মাস্ক, ২৪টি হ্যান্ডস্যানিটাইজার, প্রতিটি উপজেলা পরিষদসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বণ্টন করা হয়েছে। এছাড়া মুজিববর্ষ উপলক্ষে দুঃস্থ ও ভূমিহীনদের মাঝে ৩৮টি ঘর বরাদ্দ দেয়া হয়েছে। যার কার্যক্রম চলমান রয়েছে। করোনাকালীন এইসব কার্যক্রম জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান আলহাজ ওচমান গণি পাটওয়ারীসহ আমরা তদারকি করছি। উন্নয়ন কাজগুলোও সেভাবে পরিচালিত হচ্ছে।
চাঁদপুরের জেলা মৎস্য কর্মকর্তা আসাদুল বাকী বলেছেন, পদ্মা-মেঘনার অভয়াশ্রমে জাটকা নিধনরোধে বিগত দুই মাসে ৫৫৮টি মোবাইল কোর্ট করা হয়েছে। ৩শ’ জেলেকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদন্ড দেয়া হয়েছে এবং ২ কোটি মিটার কারেন্টজাল আটক ও ধ্বংস করা হয়েছে। প্রকৃত জেলেদের হালনাগাদ তালিকা করা হচ্ছে।
পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী এসএম রেফাউদ গণি বলেন, চাঁদপুর শহর রক্ষা বাঁধের পুরাণবাজার অংশের হরিসভা এলাকায় ১শ’ ৩৭ মিটারে ৩৭ হাজার জিও ব্যাগ ফেলা হচ্ছে। ২ কোটি ৩৫ লাখ টাকার মেরামত কাজ চলমান রয়েছে। চাঁদপুর শহরের মোলহেডের ৪০ মিটার এলাকায় জরুরি মেরামত হিসেবে ২৭ হাজার ব্লক ডাম্পিং কাজ চলমান রয়েছে। এতে খরচ হবে প্রায় ৭০ লাখ টাকা। ঐ কাজগুলো জরুরি মেরামত হিসেবে বরাদ্দপ্রাপ্তির আগেই কাজগুলো সম্পন্ন করা হচ্ছে। মে মাসের মধ্যে কাজগুলো সম্পন্ন করা হবে। এছাড়া জরুরি মেরামতের জন্যে ১০ হাজার জিও ব্যাগ প্রস্তুত করা হয়েছে।
সড়ক ও জনপথ বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. আতিকুল্লাহ্ ভূঁইয়া বলেন, চাঁদপুর সেতুর আগামি বছরের টোল আদায়ের জন্যে দরপত্র প্রক্রিয়া সম্পন্ন হয়ে গেছে। গত বছর ৮ কোটি টাকার বেশি ছিলো, এ বছর তা ৯ কোটি টাকায় বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, সড়ক ও জনপথের জায়গার অবৈধ দখলদারদের উচ্ছেদ করা হয়েছে। এছাড়া আমাাদের বিভাগের অন্যান্য কাজ চলমান রয়েছে। তবে কয়েকদিন আগে অর্থ মন্ত্রণালয়ের পরিপত্রের নির্দেশনার আলোকে নতুন কোনো কাজ হাতে নেয়া যাবে না।
মতলব উত্তর উপজেলা নির্বাহী অফিসার গাজী মো. শরীফুল ইসলাম বলেন, মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্প এলাকায় ফরাজীকান্দি ইউনিয়নের আমিরাবাদ-জনতা বাজারের মাঝামাঝি স্থানে বেড়িবাঁধটি ঝুঁকিপূর্ণ রয়েছে। যেটি গত ৭ মাস আগে মেরামত করা হয়েছিলো। তখন শুষ্ক মৌসুম ছিলো। আমি গত বুধবার জায়গাটি ঘুরে এসেছি। বাঁধটি বর্ষা মৌসুমের আগেই মেরামত করা না হলে বড় ধরনের ক্ষতির আশঙ্কা রয়েছে।
মেঘনা-ধনাগোদা সেচ প্রকল্পের নির্বাহী প্রকৌশলী মামুন হাওলাদার বলেন, ঐ বাঁধের ৭৪ মিটার মেরামত করার জন্যে ৩৭ লাখ টাকার দরপত্র আহ্বান করা হয়েছে। দরপত্র প্রক্রিয়ার সকল কাজ সম্পন্ন হলেও বাঁধ সেধেছে এর ফান্ডিং ব্যবস্থায়। কারণ গত ২৬ এপ্রিল অর্থ মন্ত্রণালয় পরিপত্র জারির মাধ্যমে জানিয়েছে কোনো নতুন কাজ বা পুরাতন কাজের অর্থ ছাড় এ মুহূর্তে দেয়া যাচ্ছে না। যার ফলে ঝুঁকিপূর্ণ বেড়িবাঁধের এই অংশটি এখন মেরামত করা হচ্ছে না। কবে নাগাদ কাজটি করা যাবে তাও তিনি বলতে পারছেন না।
সভায় চাঁদপুরের স্থানীয় সরকার বিভাগের উপ-পরিচালক ও অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি নাছির উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল, গণপূর্ত, স্থানীয় সরকার প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলীবৃন্দ, কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক, সমাজসেবা অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক, ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক, মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তরের দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা, জেলা খাদ্য নিয়ন্ত্রক বক্তব্য রাখেন।
সভায় আরো উপস্থিত ছিলেন সদর উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানজিদা শাহনাজ স্মৃতিসহ সব উপজেলা নির্বাহী অফিসারবৃন্দ।

৪ মে, ২০২১।