নদীর ইলিশের উৎপাদন হুমকিতে

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-২
মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়তে আর আগের মতো নাও আসতে পারে…
মেঘনা নদীতে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে পানিতে লবণের মাত্রার তারতম্য ঘটছে…

মাহবুবুর রহমান সুমন
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু বলেছেন, দেশে আগামি ৫ বছরে কেবল ইলিশ আহরণের পরিমাণ সাড়ে ৫ লাখ টন ছাড়িয়ে যাবে। মন্ত্রীর এমন আশাবাদে ইলিশের উৎপাদন জাতীয় অর্থনীতিতে যে গুরুত্ব বহন করে তার অনেকটাই সরল ইঙ্গিত পাওয়া যায়। তিনি গত চলতি বছরের ১৯ জুন জাতীয় সংসদে ঐ কথাগুলো বলেন।
সংসদে তিনি আরো জানান, ২০০৮-০৯ অর্থবছরে যেখানে ২ লাখ ৯৯ হাজার টন ইলিশ ধরা হয়েছিল, সেখানে ২০১৭-১৮ অর্থবছরে তা বেড়ে ৫ লাখ ১৭ হাজার টনে দাড়িয়ে ছিলো। সংসদের স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তর পর্বে চট্টগ্রাম-১১ আসনের সংসদ সদস্য এম আবদুল লতিফের প্রশ্নের জবাবে প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু এ তথ্য জানান।
প্রতিমন্ত্রী আশরাফ আলী খান খসরুর এমন দাবির পরিসংখ্যানের হিসাবে সঠিক হলেও আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন মৎস্য গবেষকরা। তারা দাবি করছেন, সমুদ্র হতে মা ইলিশ প্রজনন মৌসুমে মিঠা পানিতে চলে আসে। নির্ধারিত সময়ে ডিম দিয়ে তারা আবার সমুদ্রে ফিরে যায়। সরকার নদীতে ইলিশ সংরক্ষণের জন্য ইলিশের অভয়াশ্রম ঘোষণা ও মা ইলিশসহ জাটকা নিধনের ব্যবস্থায় দেশে ইলিশ উৎপাদন ইতোমধ্যেই রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে।
কিন্তু বর্তমানে এমন উৎপাদন হুমকির দিকেই যাচ্ছে আমাদের পরিকল্পনার অভাবে। কারণ হিসেবে ইলিশ গবেষক ও মুখ্য মৎস্য কর্মকর্তা আনিছুর রহমান দাবি করছে, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে মেঘনা নদীর পানিতে ধীরে ধীরে যে পরিমাণ লবণাক্ততা বাড়ছে এতে করে সামনের দিনগুলোতে হয়তো আমরা আর মা ইলিশ নদীতে ডিম ছাড়তে আর আগের মতো না আসলে অবাক হওয়ার কিছুই থাকবে না।
এই ইলিশ গবেষক এও দাবি করছে, নদীর নাব্যতা হ্রাসের সাথে এমন হুমকি এখন পানিতে চলমান লবণের মাত্রা বৃদ্ধির উপরই সব কিছু নির্ভর করছে। তিনি কেবল আশঙ্কার কথাই বলছেন। কারণ হিসেবে গবেষকরা তাদের চলমান গবেষণায় দেখছেন, মেঘনা নদীতে ঋতু পরিবর্তনের সাথে সাথে পানিতে লবণের মাত্রার তারতম্য ঘটছে।
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রে চলমান ঊভভবপঃ ড়ভ পষরসধঃব পযধহমব ড়হ ঃযব ঊপড়ষড়মব ধহফ ইরড়ফরাবৎংরঃু ড়ভ ওহষধহফ ড়ঢ়বহ ধিঃবৎ ভরংযবং ৫ বছর মেয়াদী গবেষণার চূড়ান্ত ফলাফল শেষে আশঙ্কাটার সমীকরণ নির্ণয় অনেকটাই সহজ হয়ে যাবে বলে আশা করছেন গবেষকরা। তবে বর্তমানে যে একভাবেই হুমকি নেই, তা কিন্তু মৎস্য ও ইলিশ গবেষকরা উড়িয়ে দিচ্ছে না। তাদের আশঙ্কা কেবল ইলিশেকে নিয়ে নয়, নদীর অন্যান্য মাছের উৎপাদনও কমে আসবে সামনের দিনগুলোতে। প্রতিকূল পরিস্থিতিতে ইলিশসহ অন্যান্য মাছ নদীতে টিকে থাকার লড়াইয়ে হেরে গেলেই কেবল তা দৃশ্যমান হবে।
যদিও এখন পর্যন্ত ইলিশ আহরণে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম শীর্ষ দেশ হিসেবে ইতোমধ্যে খ্যাতি অর্জন করতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বের ৭৫ শতাংশ ইলিশই এখন বাংলাদেশেই আহরিত হয়। বাংলাদেশের ইলিশ খুবই সুস্বাদু। যার ফলে আমাদের পার্শ্ববর্তী দেশে ভারতেও এই মাছের ব্যাপক চাহিদা রয়েছে। রফতানিতে বাংলাদেশী ইলিশের ব্র্যান্ডিংয়ের সুবিধার জন্য মাছটি গত ২০১৭ সালে ‘ভৌগোলিক নির্দেশক’ (জিওগ্রাফিক্যাল ইনডিকেশন) পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করে।
ফলে ইলিশের উৎপাদন জাতীয় অর্থনীতির জন্য যে আশীর্বাদ তা অনেকটাই আগাম জানান দিচ্ছে। কিন্তু এই উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রার ইলিশ গবেষকদের আশঙ্কার বিপরীতে প্রস্তুতি কতটুকু তা এখনো জানা সম্ভব হয়নি। এদিকে ইলিশের জন্য নদীর মিঠা পানি যদি শেষ পর্যন্ত হুমকি হয়ে দেখা দেয়, তা হলে ক্ষতির আশঙ্কা ঠিক তার বিপরীত অর্থাৎ উৎপাদনের সমানই হবে।
তবে এখন দেশে প্রতিনিয়ত কি পরিমাণ ইলিশের উৎপাদন বাড়ছে তারও একটা পরিসংখ্যান মিলে প্রতিমন্ত্রীর সংসদের বক্তব্যের মধ্যে। তিনি বলেন, সরকারের সমন্বিত কার্যক্রমের ফলে প্রতি বছর ইলিশ আহরণের পরিমাণ বাড়ছে। মেঘনা থেকে জাটকা এখন পদ্মা, যমুনা, ব্রহ্মপুত্র ও সুরমা নদীতে বিস্তৃতি ঘটাচ্ছে। ২০০৭-০৮ সালের তুলনায় ২০১৫ সালে জাটকার পরিমাণ প্রায় ৩৯ শতাংশ বেড়েছে বলে মন্ত্রী সংসদকে জানান।
এছাড়া ২০১৭-১৮ সালে ২২ দিনে ‘মা’ ইলিশ রক্ষার কার্যক্রমের কারণে ৪৭.৭৪% শতাংশ ‘মা’ ইলিশ ডিম ছাড়ার সুযোগ পেয়েছে। চলমান ব্যবস্থাপনা পদ্ধতির বাস্তবায়ন অব্যাহত থাকলে আগামি ৫ বছরে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে বছরে ৫ লাখ ৫০ হাজার টন ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে প্রতিমন্ত্রী আশাবাদ ব্যক্ত করছেন।
মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী মো. আশরাফ আলী খান খসরু তার পরিসংখ্যানে আরো তুলে ধরে বলেন, গত ২০০২-০৩ সালে ইলিশ আহরণের পরিমাণ ছিল ১ লাখ ৯৯ হাজার ৩২ টন। বিভিন্ন কৌশল বাস্তবায়নের ফলে ২০০২-০৩ সালের তুলনায় ২০১২-১৩, ২০১৩-১৪, ২০১৪-১৫, ২০১৫-১৬, ২০১৬-১৭ ও ২০১৭-১৮ সালে ইলিশের উৎপাদন বেড়ে যথাক্রমে ৩ লাখ ৫১ হাজার টন (৫৯.৫৫%); ৩ লাখ ৮৫ হাজার টন (৭৫%); ৩ লাখ ৮৭ হাজার টন (৭৫.৪৮%); ৩ লাখ ৯৫ হাজার টন (৭৯.৫৫); ৪ লাখ ৯৬ হাজার টন (১২৫.০৪%) এবং ৫ লাখ ১৭ হাজার টনে দাঁড়ায়। অর্থাৎ ইলিশের উৎপাদন প্রায় দ্বিগুণের বেশি বেড়েছে।

১৪ অক্টোবর, ২০১৯।