
উপজেলায় প্রশাসনের নাকের ডগায় বসে ব্যবসা পরিচালনা
ইল্শেপাড় রিপোর্ট
ফরিদগঞ্জের ভান্ডারী মহলের এনসিসি ব্যাংকের পশ্চিম পাশে দেশি-বিদেশী মেটাল ও ফ্লাইউঠের ফার্নিচার ব্যবসায়ী মো. মীর মোশারফ হোসেন মাস্টারের কর্মকাণ্ড নিয়ে উপজেলাজুড়ে শিক্ষক মহলে বইছে নানা বিতর্ক। ভান্ডারী মহলের স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলছেন, তিনি দীর্ঘদিন ধরে ‘মেসার্স নিউ আল মোজাদ্দেদ ফার্ণিচার’ নামক প্রতিষ্ঠানটির স্বত্বাধিকারী হিসেবে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান পরিচালনা করে আসছেন। এই ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের স্বত্বাধিকারী হিসেবেই তিনি বাজার ব্যবসায়ী সমিতির একজন সদস্য ও ফরিদগঞ্জ পৌরসভা হতে ব্যবসায়ী লাইসেন্সপ্রাপ্ত। যা এই শিক্ষক নিজেই স্বীকার করেন ইল্শেপাড়ের কাছে।
বিপরীত দিকে উপজেলার ‘চরকুমিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়’ বলছে, মো. মীর মোশারফ হোসেন তাদের একজন সহকারী শিক্ষক। কিন্তু মূলত তার আসল পরিচয় কোনটা, এ নিয়েই চলছে এখন ব্যবসায়ী মহল ও উপজেলার প্রাথমিক শিক্ষকদের মাঝেই চলছে ব্যাপক তোলপাড়।
তবে ফরিদগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিস বলছে, তিনি তাদের অধীনস্থ একজন সহকারী শিক্ষক। বর্তমানে এই শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন উপজেলার ‘চরকুমিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে’। তবে তিনি উপজেলায় বসে যে প্রকাশ্য দিবালোকে ফার্ণিচারের ব্যবসা-বাণিজ্য পরিচালনা করছেন সেজন্য নিয়োগকারী সংস্থার কোন অনুমতি নেননি। ফলে সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী তিনি (শিক্ষক) শাস্তিযোগ্য অপরাধ করছেন বলে উপজেলা শিক্ষা অফিস জানায়।
অপরদিকে বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতি, ফরিদগঞ্জ উপজেলা শাখার কর্তা ব্যাক্তিরা দাবি করছেন, মো. মীর মোশারফ হোসেন কেবল একজন ব্যবসায়ী’ই না তিনি তাদের সমিতির নির্বাচিত প্রভাবশালী ‘মিডিয়া ও তথ্য যোগাযোগ সম্পাদক’। এছাড়া উপজেলার বিদেশী পণ্য আমদানীকারক একজন ধর্নাঢ্য ব্যবসায়ী হিসেবে যেমন পরিচিত, তেমনি শিক্ষক সমিতির বড় অর্থের যোগানদাতা ও একজন সুহৃদ। তবে সমিতির কেউ কেউ আড়ালে-আবডালে বলেন, এই শিক্ষক নেতার সাথে বেশ কয়েকজন নারী শিক্ষকের সাথে রয়েছে চমৎকার সম্পর্ক। এ নিয়ে রয়েছে মুখরোচক গল্পও।
এছাড়া ফরিদগঞ্জ উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির মিডিয়া ও তথ্য যোগাযোগ সম্পাদক হিসেবে মো. মীর মোশারফ হোসেন তাদের শিক্ষক সমিতির নানা সভায় প্রভাব বিস্তার করার জন্য নানা ধরনের প্রস্তাব দেন। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের তেল মারতে তিনি মশা মারতে কামানও দাগান। সম্প্রতি একটি সভার কার্যবিবরণী এ প্রতিবেদকের হাতে এসেছে। সেখানে তার এখতিয়ারের বাইরের একটি কর্মকাণ্ডেও তিনি নিজেকে উদারভাবে মেলে ধরেছেন। তিনি ভবিষ্যতে বড় নেতা হবার জন্য নানা ধরনের কথাও বলেন।
এদিকে চরকুমিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা দাবি করছেন, ২০১৫ সালে ফরিদগঞ্জ উপজেলার বাংলাদেশ প্রাথমিক শিক্ষক সমিতির নির্বাচনে মিডিয়া ও তথ্য যোগাযোগ সম্পদাক নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই শিক্ষক মো. মীর মোশারফ হোসেন বিদ্যালয় থেকে মনেহয় লাপাত্তা। তবে তিনি বিদ্যালয়ে উপস্থিত হাজিরা খাতায় স্বাক্ষর করার জন্য বিদ্যালয়ে আসেন এবং স্বাক্ষর শেষে বিদ্যালয় ত্যাগ করেন। কোমলমতি শিক্ষার্থীদের কোন পাঠদানের জন্য শ্রেণিকক্ষে তেমন একটা অংশ নেন না। উপজেলায় নিজ ব্যবসা প্রতিষ্ঠানেই ব্যস্ত থাকেন বিদ্যালয় চলাকালীন সময়ে। তবে রহস্যজনক কারণে কেবল প্রধান শিক্ষকই ভিন্নমত পোষণ করেন এই শিক্ষক সম্পর্কে।
এদিকে উপজেলার চির্কা চাঁদপুর ক্লাস্টারের মধ্য গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের এক শিক্ষক নাম না প্রকাশের শর্তে প্রতিবেদককে জানান, এই শিক্ষক নেতা মূলত উপজেলা শিক্ষা অফিসের কর্মকর্তাদের চালক কাম ড্রাইভার।
তিনি জানান, কয়েক মাস আগে মো. মীর মোশারফ হোসেন ব্যাক্তিগতভাবে কারণে তার মোটরসাইকেলে করে শিক্ষা অফিসের এক কর্মকর্তাকে মধ্য গোবিন্দপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সকাল পৌনে ১০টায় নিয়ে আসেন। ঐ দিন বিদ্যালয়ের ২ জন সহকারী শিক্ষক বিদ্যালয়ে আসতে দেরি করায় তাদের নাজেহালও করেন।
ঐ শিক্ষক আরো জানান, পরে ভুক্তভোগী ঐ দুই সহকারী শিক্ষক ব্যাপক হয়রানির শিকার হন। এছাড়া সমিতির মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের নামে ভুক্তভোগী শিক্ষকদের কাছ থেকে কিছু অর্থও হাতিয়ে নেন এই শিক্ষক নেতা মো. মীর মোশারফ হোসেন।
তবে ফরিদগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসের এক কর্মচারী নাম প্রকাশ না করা শর্তে জানান, সহকারী উপজেলা শিক্ষা অফিসারদের একান্ত অনুগত হিসেবেও এই শিক্ষক উপজেলায় পরিচিত। এই শিক্ষক কেবল চালকই নন শিক্ষা অফিসারদের ম্যানেজ করেই দীর্ঘদিন বিদ্যালয় ফাঁকি দিয়ে ব্যবসা-বাণিজ্য প্রকাশ্যে করে আসছেন। এজন্য শিক্ষা অফিসাররা তার কাছ থেকে নিয়মিত নজরানাও পেয়ে থাকেন বলেও অভিযোগ আছে- জানান ঐ কর্মচারী।
এদিকে তুমুল বিতর্কিত এই মীর মোশারফ হোসেন ব্যবসায়ী না শিক্ষক তা তার কাছে জানতে চাইলে তিনি তার ব্যাক্তিগত ব্যবসার কথা স্বীকার করে ইল্শেপাড়কে জানান, চাকরিবিধি ও উপজেলা শিক্ষা অফিসের অনুমতি নিয়েই দীর্ঘদিন ধরে ফরিদগঞ্জে ফার্ণিচারের ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন। এছাড়া তিনি আরো দাবি করেন, চাকরিবিধি মেনেই ব্যবসা পরিচালনা করে আসছেন তিনি।
এ বিষয়ে চরকুমিরা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক নাজমা আক্তার রহস্যজনক কারণে সহকারী শিক্ষক মীর মোশারফ হোসেনের বক্তব্যের ঠিক উল্টো কথাই জানান। তিনি ইল্শেপাড়কে জানান, মীর মোশারফ হোসেন ব্যবসায়ী নন। তিনি নিয়মিত’ই বিদ্যালয়ে উপস্থিত থাকেন। কোন ধরনের ফাঁকিবাজির সাথে তার কোন সম্পর্কও নেই।
ফরিদগঞ্জ উপজেলা শিক্ষা অফিসার মনির উজ্জামান খান ইল্শেপাড়কে জানান, সরকারি চাকরি বিধি অনুযায়ী কর্মচারীরা কোন ধরনের ব্যবসা-বাণিজ্য করতে পারেন না। ব্যবসা পরিচালনা করার অনুমতি প্রদানের তো প্রশ্নই আসে না।
চাঁদপুর জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিসার মো. সাহাব উদ্দিন ইল্শেপাড়কে জানান, সরকারি কর্মচারীরা তার নির্ধারিত কর্মস্থলের দায়িত্ব শেষে পারিবারিক আর্থিক স্বচ্ছলতার জন্য ক্ষুদ্র ব্যবসা করতে পারেন। তবে চাকরি বিধি অনুযায়ী বৃহত্তর ব্যবসা পরিচালনা করার নিয়ম নেই।
শিক্ষা কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের পরস্পর বিরোধী বক্তব্যের বিপরীতে এখন দেখার বিষয় উপজেলা শিক্ষা অফিস কিংবা জেলা প্রাথমিক শিক্ষা অফিস এই চিহ্নিত ব্যবসায়ী কাম সহকারী শিক্ষক মো. মীর মোশারফ হোসেনের বিরুদ্ধে চাকরি বিধি অনুযায়ী কি ধরনের ব্যবস্থা নেয়।