
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-১
মেঘনা নদীর পানিতে ক্ষারত্ব বা রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতির প্রমাণ মিলেছে।
নদীর তীরবর্তী এলাকায় গড়ে উঠা সিমেন্ট কারখানাসহ ইট ভাটাগুলো পরিবেশ ধ্বংসের জন্য দায়ী।
মাহবুবুর রহমান সুমন
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের ‘Effect of climate change on the Ecology and Biodiversity of Inland open water fishes’ ৫ বছর মেয়াদী চলমান এক গবেষণায় দেখা গেছে, অতি বৃষ্টি কিংবা কম বৃষ্টি আবার অতিরিক্ত খরা (তাপমাত্রা) বা কম খরায় নদীর পরিবেশ যেমন হুমকি তৈরি করছে, তেমনি প্রাকৃতিক পরিবেশও অনেকটাই বসবাসের অযোগ্য হয়ে উঠেছে। যার প্রভাব আস্তে আস্তে দীর্ঘমেয়াদী হয়ে উঠার আশঙ্কা রয়েছে। যদি তা কাটিয়ে উঠা সম্ভব না হয় তাহলে আমাদের কৃষি, বনজ, কিংবা মৎস্য অর্থনীতির জন্য তা বিপর্যয় হিসেবেই দেখা দিবে।
পাশাপাশি আমাদের এই সমাজ বাসযোগ্য পরিবেশও ধীরে ধীরে আমাদের জন্য দুরুহ ব্যাপারে পরিণত হতে পারে। যাতে প্রাকৃতিক পরিবেশ এমন পর্যায়ে না যায় সেজন্য প্রতিকারের প্রস্তুতি এখনি নিতে হবে- এমন অভিমত সংশ্লিষ্ট গবেষক ও বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তায়ফা আহমেদ, মো. ইসতিয়াক হায়দার ও অভিজিৎ বসুসহ মো. আশিকুর রহমানের।
৫ বছর মেয়াদী চলমান এ গবেষণায় প্রাথমিক পর্যায়ে তারা মেঘনা ও তেতুলিয়া নদীর যেসব প্রধান প্রধান এলাকার পানিতে লবণাক্ততা পাওয়া গেছে, তার মাধ্যে অন্যতম হলো চর-আলেকজান্ডার এবং রামগতিতে। এই এলাকায় বছরের ফেব্রুয়ারিতেই লক্ষণীয় মাত্রায় বিশেষ করে রামগতিতে লবণাক্ততার সর্বোচ্চ স্তর পাওয়া য়ায়।
সংশ্লিষ্টরা গবেষণায় আরো উল্লেখ করেন, ঐ সময়ে সমুদ্রের শক্তিশালী জোয়ারের প্রভাব এসে নদীতে পরে। এছাড়া গবেষণায় আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় চিহ্নিত হয়েছে- শীতকালীন ঋতুতে কম বৃষ্টিপাতের কারণে নদীর পানি থাকে শান্ত। অন্যদিকে উচ্চ বৃষ্টিপাতের কারণে, পানির অশান্তির স্বচ্ছতার পরিমাণ পাওয়া যায় নিম্ন পর্যায়ে। বর্ষা ঋতুতে রামগতিতে পনির স্বচ্ছতার নিম্ন সীমা (১৩.৮) সেমি রেকর্ড করা হয়।
এছাড়া গবেষণার নমুনায় নদীর স্বাভাবিক বায়ু এবং জলের তাপমাত্রার মধ্যে যে সম্পর্ক ছিলো তা অনেকটাই বর্তমানে হ্রাস পেয়েছে। গবেষণায় দেখা যায়, জলের তাপমাত্রার ৭৩ শতাংশই বায়ুর পরিবর্তনের কারণে হয়েছে। এমন পরিস্থিতিতে বিশাল এ মেঘনা নদীর পানিতে ক্ষারত্ব বা রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতির প্রমাণও মিলেছে।
নদীর পনির গবেষণার নমুনা পয়েন্টে ক্ষারত্ব বা রাসায়নিক উপাদানের উপস্থিতি ৬১.৩ থেকে ১১৭.০ মিলি গ্রাম চিহ্নিত হয়েছে। যা অনেকটাই উচ্চমাত্রার বলে উল্লেখ করেছে গবেষকরা। সাধারণত শীতকালের ঋতুই প্রধানত সমুদ্র থেকে লবণাক্ত পানি অনুপ্রবেশের জন্য দায়ী হিসেবে চিহ্নিত হয়েছে। ফলে ঐ সময়ে নদীর পনিকে ধীরে ধীরে ক্যালসিয়াম এবং ম্যাগনেসিয়াম আয়রনের মাধ্যমে লবণাক্ততার স্তর বৃদ্ধি করে দিচ্ছে। এছাড়া শীতকালের কম বৃষ্টিপাতও আরেকটি কারণ হিসেবে গবেষণায় চিহ্নিত হয়েছে।
গবেষণার পরিসংখ্যান বলছে, সাধারণত দেশের ৬ ঋতু মাঝে বর্তমানে ৩টি ঋতু উপর নদীর তাপমাত্রা নির্ভর করে। যা হচ্ছে মার্চ-জুন, জুলাই-অক্টোবর এবং শীতকালীন নভেম্বর-ফেব্রুয়ারি। তুলনামূলকভাবে এ সময়ে নদীর বায়ুতে উচ্চ তাপমাত্রা পাওয়া (থাকে না) যায়নি। তবে গ্রীষ্মকালীন মৌসুমে বা বর্ষাকালে পানিতে তাপমাত্রা ছিল অনেকটাই বেশি। শীতের ঋতুতে বায়ু ও জলে তাপমাত্রা ছিল অনেকটা কম। যা নদী ও তীরবর্তী এলাকার পরিবেশের জন্য হুমকি হিসেবে চিহ্নিত। ভবিষ্যতে আমাদের স্বাভাবিক পরিবেশের উপর যার প্রভাব পড়বে ধীরে ধীরে, যা আশঙ্কাজনক।
তবে লবণাক্ততার পাশাপাশি পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর অন্যান্য যেসব কারণও চিহ্নিত হয়েছে তা হলো, নদীতে প্রতিনিয়ত বড়-বড় জাহাজসহ নানা রকম নৌযানের মেশিনের শব্দ, সেগুলোর সার্সলাইটের আলো, বিভিন্ন প্রকারের ক্ষতিকর বর্জ্য নদীর তীরের স্বাভাবিক পরিবেশকে বিঘ্ন ঘটিয়ে আসছে অনেকটাই নীরবে।
এছাড়া নদীর তীরবর্তী এলাকায় গড়ে উঠা সিমেন্ট কারখানাসহ বড় ধরনের শিল্প-কারখানা ও ইট ভাটাগুলো অনেকাংশেই পরিবেশ ধ্বংসের জন্য দায়ী বা চিহ্নিত। এ ধরনের শিল্প-কারখানা কি পরিমাণ পরিবেশ দূষণ ঘটিয়ে চলেছে নীরবে তার হিসাব এ মুহূর্তে জানা নেই সংশ্লিষ্ট পরিবেশ অধিদপ্তরের। এমন পরিস্থিতিতে নদীর তীরবর্তী এলাকাই নয় বরং পুরো দেশের পরিবেশই এখন হুমকির মুখে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। ফলে দেশের বৃহত্তর নদীগুলোর মৎস্য সম্পদের জন্য তা হুমকি হয়েই থাকছে না, কৃষি অর্থনীতির জন্য আগামিতে বড় ধরনের হুমকি হিসেবে থাকছে।
এমন পরিস্থিতিতে পরিবেশের উন্নয়ন ঘটাতে না পরলে, তা প্রাকৃতিক বা মানবিক বিপর্যয়ের জন্য অনেকটাই অপেক্ষা করছে। তবে তা যে বড় ধরনের পরিবেশগত বিপর্যয় ডেকে আনছে শীঘ্রই, এ নিয়ে কোন মতবিরোধ নেই- নদী কিংবা পরিবেশ গবেষকদের মনে।
১৩ অক্টোবর, ২০১৯।