মোহাম্মদপুর সপ্রাবি’র দুইটি ভবন পরিত্যক্ত ও অত্যন্ত ঝুঁকিপূর্ণ

হাজীগঞ্জে এক শ্রেণিকক্ষে সাড়ে চারশ’ শিশু শিক্ষার্থী

মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
৪ বছর আগে পরিত্যক্ত ঘোষণা করা হলেও নতুন ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়নি। তাই বাধ্য হয়ে মৃত্যুর ঝুঁকিতে প্রতিদিন ক্লাস করানো হতো হাজীগঞ্জ উপজেলার গর্ন্ধব্যপুর উত্তর ইউনিয়নের মোহাম্মদপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের পরিত্যক্ত ও ঝুঁকিপূর্ণ দু’টি একাডেমিক ভবনে। এতে যে কোন সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে ব্যাপক প্রাণহানীর আশংকায় থাকেন অভিভাবক, এলাকাবাসী ও স্থানীয়রা।
জানা গেছে, ১৯৩৫ সালে বিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠার পর থেকেই গ্রামীণ জনপদ, বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রী ও পড়ালেখার মান দিন দিন বৃদ্ধি পাওয়ায় উপজেলায় বিদ্যালয়টির সুনাম ছড়িয়ে পড়ে। নিয়মিত ও ধারাবাহিক ফলাফলে উপজেলার অন্যসব সেরা প্রতিষ্ঠানের সাথে প্রতিযোগিতা করে আসছে বিদ্যালয়টি। এখান থেকে উল্লেখযোগ্যসংখ্যক এবং নিয়মিত শিক্ষার্থীরা জিপিএ-৫ এবং বৃত্তি পেয়ে থাকে।
স্থানীয়রা জানান, ৫ শতাধিক শিশুর কল-কাকলিতে সার্বক্ষণিক মুখরিত থাকে বিদ্যালয়টি। কিন্তু পরিত্যক্ত দু’টি ভবন নিয়ে সারাক্ষণ আতঙ্কে থাকতে হয় এলাকাবাসী, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীদের। বিকল্প উপায় না থাকায় শ্রেণিকক্ষ হিসেবে ব্যবহৃত হতো পরিত্যক্ত ভবন দু’টি। কিন্তু করোনাকালীন দীর্ঘ এই দেড় বছরে ওই পরিত্যক্ত ভবন দু’টি আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠেছে।
জানা গেছে, ১৯৮৮ সালে ৩ রুমবিশিষ্ট টিনশেড ভবন, ১৯৯৪-৯৫ অর্থ-বছরে ২ রুমবিশিষ্ট একতলা ভবন এবং ২০০৮-০৯ অর্থ-বছরে চার রুমবিশিষ্ট একতলা একাডেমিক ভবন নির্মাণ করা হয়। এর মধ্যে ১৯৯৮ ও ১৯৯৪-৯৫ অর্থ-বছরে নির্মিত ভবন দু’টি ২০১৬ পরিত্যক্ত ঘোষণা করে উপজেলা প্রকৌশলী ও উপজেলা শিক্ষা বিভাগ। পরিত্যক্ত ভবন দুটির পিলারগুলো ও বিম থেকে ইট-সুরকির ঢালাই খসে পড়ে ভেতরের রড দেখা যাচ্ছে।
এছাড়া কয়েকটি পিলার থেকে ইট-সুরকি খসে পড়ে চিকন (সরু) হয়ে গেছে। দেয়ালে ফাটল রয়েছে, রড বেরিয়ে গেছে। ভেতরের কক্ষগুলোর দেয়াল এবং ছাদের পলেস্তারা খসে পড়ছে। দরজা-জানালা ভেঙে পড়েছে। ওপরের সিলিং ও টিনের চালাও জরাজীর্ণ। বৃষ্টি হলে টিন এবং ছাদ চুয়ে পানি পড়ে। ২০১৯ সালে এলাকাবাসী এবং পরের বছর ক্ষুদ্র সংস্কারের টাকা দিয়ে টিনের চালার উপরে ত্রিপাল সাঁটানো হয়েছে।
অপর ভবনটির চারটি কক্ষের মধ্যে একটিতে প্রাক-প্রাথমিক, একটিতে অফিস, ছোট একটি কক্ষে সততা স্টোরসহ আনুসাঙ্গিক মালামাল রাখা হয়েছে। রয়েছে মাত্র একটি কক্ষ। যেখানে ৫ম শ্রেণির ক্লাস নেয়া হয়। থেকে যাচ্ছে আরো চার শতাধিক শিক্ষার্থী। তারা বসবে কোথায়? তাই বাধ্য হয়ে পরিত্যক্ত ভবন দুটিতে পাঠদান করা হতো। বর্তমানে একটি পরিত্যক্ত ভবন বাদ দিয়ে, অপর একটিতে ক্লাস নেয়া হচ্ছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে।
এছাড়া শিক্ষার্থীরা স্কুল চলাকালীন সময় এবং বিদ্যালয় বন্ধ থাকলে স্থানীয় এলাকার শিশুরা বিদ্যালয় মাঠে এবং পরিত্যক্ত ভবনের ভিতরে প্রবেশ করে খেলাধুলা করে। এতে করে যে কোনো সময় বড় ধরনের দুর্ঘটনা ঘটে যেতে পারে। হতে পারে প্রাণহানী। এতে করে একদিকে দু’টি পরিত্যক্ত ভবন, অন্যদিকে বিপুলসংখ্যক শিক্ষার্থী। তাই দুই শিফটের স্কুল হওয়ায় সত্ত্বেও বিপুলসংখ্যক ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে বিপাকে আছেন শিক্ষকরা।
এছাড়া বিদ্যালয়ের ভূমির বুকের উপর দিয়ে ইউনিয়নের মূল সড়ক (এলডিইডি’র সড়ক) থাকায় শিশু শিক্ষার্থীরা প্রায় সময়ই দুর্ঘটনার শিকার হতে হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে ঝুঁকিপূর্ণ ভবন দু’টি ভেঙে দ্রুত পূনঃনির্মাণ এবং বিদ্যালয় মাঠের মধ্য থেকে ইউনিয়নের রাস্তাটি অন্যত্র সরিয়ে নেয়ার দাবি জানিয়েছেন এলাকাবাসী, শিক্ষক-শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা। এছাড়া রয়েছে শিক্ষার্থী অনুপাতে শিক্ষক সংকট।
বেশ কয়েকজন অভিভাবকের সাথে কথা হলে তারা জানান, আশ-পাশে ভালো কোন শিশু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান না থাকায় একপ্রকার নিরুপায় ও বাধ্য হয়ে তারা বাচ্চাদের এখানে পড়াচ্ছেন। তারা সবসময় আতঙ্কে থাকেন, না জানি কখন দুর্ঘটনা ঘটে। তাই দ্রুততার সাথে পরিত্যক্ত ভবন দুইটি ভেঙে নতুন ভবন নির্মাণের আকুল আবেদন জানান সরকারের কাছে।
বিদ্যালয় প্রধান শিক্ষক মোহাম্মদ আবু ছাদেক জানান, জরাজীর্ণ পরিত্যক্ত ভবন দু’টিতে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে শিশুদের পাঠদান করানো হয়েছে। কিন্তু গত দেড় বছরে ওই পরিত্যক্ত ভবন দুইটি আরো বেশি ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে উঠছে। এখন বিদ্যালয় খোলার পর শিক্ষার্থীদের নিয়ে বিপাকে আছি। প্রাক-প্রাথমিকের কক্ষ বাদে মাত্র একটি শ্রেণিকক্ষ আমাদের রয়েছে। এখন চারশ’র বেশি শিক্ষার্থী কোথায় ক্লাস বসবে..?
তিনি বলেন, ২০২০ সালে সয়েল টেস্টসহ আনুসাঙ্গিক আরো কাজ করেছে উপজেলা প্রকৌশলী অফিস। কিন্তু পরবর্তীতে আর কোন অগ্রগতি দেখিনি বা আমরাও কোন আপডেট পাইনি।
বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের পিটিআই কমিটির সভাপতি ও যুগান্তরের হাজীগঞ্জ প্রতিনিধি খালেকুজ্জামান শামীম জানান, আমাদের একটি মাত্র শ্রেণিকক্ষ, আর শিক্ষার্থী সাড়ে চার শতাধিক। জানি না, এরা বসবে কোথায় এবং ঝুঁকিপূর্ণ দুইটি ভবন নিয়ে আতঙ্কে আছি। কখন যে ধসে পড়ে প্রাণহানীর ঘটনা ঘটে!
তিনি বলেন, করোনাভাইরাস মহামারির কারণে দীর্ঘদিন শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ ছিল। এখন যদি শ্রেণিকক্ষের অভাবে শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা বন্ধ হয়ে যায়। তাহলে তো কোমলমতি শিশু শিক্ষার্থীরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাই শিক্ষার্থীদের পড়ালেখা চলমান রাখার জন্য বিদ্যালয়ের আশপাশে দোকান-ঘর বা বাসা-বাড়ি দেখা হচ্ছে। যেন ভাড়া নিয়ে হলেও শ্রেণিকক্ষের যোগান দিতে পারি। এসময় তিনি দ্রুত ভবন নির্মাণের দাবি জানান।
বিদ্যালয় পরিচালনা পর্ষদের সভাপতি মানিক মিয়াজী জানান, উপজেলা শিক্ষা অফিস বিষয়টি জানেন। আমরাও নিয়মিত তাদের অবহিত করি। করোনাকালীন সময়ের আগে সয়েল টেস্টসহ আনুসাঙ্গিক অন্যান্য কাজ করা হলেও এই পর্যন্ত ভবন নির্মাণে কোন আলোর মুখ দেখছি না। তাই কোমলমতি শিক্ষার্থীদের নিরাপত্তার কথা বিবেচনা করে দ্রুত ভবন দু’টি পূনঃনির্মাণ এবং রাস্তাটি বিদ্যালয়ের সম্পত্তি থেকে দ্রুত সরিয়ে নেয়া প্রয়োজন।
এ ব্যাপারে উপজেলা শিক্ষা কর্মকর্তা মো. আবু সাইদ চৌধুরী জানান, ঝুঁকিপূর্ণ ভবনটির বিষয়ে সংসদ সদস্য মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীরউত্তমসহ উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ এবং উপজেলা প্রকৌশলী কর্মকর্তার কার্যালয়ে তথ্য দেয়া আছে। তিনি বলেন, জানামতে সয়েল টেস্টসহ বেশ কিছু কাজ করা হয়েছে। আশা করি বরাদ্দ পেলে দ্রুত কাজ করা হবে। তাছাড়া বিদ্যালয়টির ব্যাপারে নিয়মিত খোঁজ-খবর রাখা হচ্ছে বলে তিনি জানান।
১৫ সেপ্টেম্বর, ২০২১।