শত বছরের মানবসেবায় রোটারী ফাউন্ডেশন : প্রাপ্তি ও প্রত্যাশা

রোটা. মাহবুবুর রহমান সুমন এমপিএইচএফ এমসি

শত বছরের বেশি সময় ধরে মানবসেবায় রোটারী ফাউন্ডেশন পৃথিবীর নানা প্রান্তে বিভিন্ন সেবামূলক কাজ করছে। এর মধ্যে পোলিও নির্মূল, নিরাপদ পানি সরবরাহ, শিক্ষা ও শান্তি প্রতিষ্ঠা এবং উন্নয়ন অন্তর্ভূক্ত। এছাড়া দারিদ্র্যমুক্তি, শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, মা ও শিশুস্বাস্থ্য, নিরাপদ পানি ও সেনিটেশন ইত্যাদি বিষয়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে রোটারী ফাউন্ডেশন নিঃস্বার্থভাবে কাজ করে। বিশেষ করে ধর্মীয় মূল্যবোধের কারণে যারা বিভিন্ন দান-সদকা দিয়ে থাকেন, রোটারী ফাউন্ডেশন প্রায় ঐ ধরনের কাজেই তাদের প্রকল্পে তা ব্যয় করে থাকে।
ফাউন্ডেশনের ফান্ড তৈরি হয় মূলতঃ রোটারী ক্লাবের সদস্য অর্থাৎ রোটারিয়ানদের মাধ্যমে। রোটারিয়ানরা রোটারী ফাউন্ডেশনে প্রতি বছরই তাদের অনুদান জমা দিয়ে ঐ ফান্ডকে করেছে সমৃদ্ধ। যা’ বেসরকারি সেবামূলক প্রতিষ্ঠানের অন্যতম বৃহৎ ফান্ড হিসেবে স্বীকৃত। ১৯০৫ সালে রোটারী ক্লাবের জন্ম হলেও প্রায় ১২ বছর পরে এই ফান্ড শুরু হয়।
বর্তমানে পৃথিবীর অন্যতম বৃহৎ আর্থিক ফান্ড ‘রোটারী ফাউন্ডেশন’ ১৯১৭ সালে তৎকালীন রোটারী ইন্টারন্যাশনালের প্রেসিডেন্ট রোটারিয়ান আর্ক সি. ক্লাম্প গঠন করেন। এরপর থেকে গত শতবর্ষে সারা পৃথিবীর রোটারিয়ানদের অনুদানে রোটারী ফাউন্ডেশন বিশ্বের দরিদ্র ও অসহায় মানুষের সেবা করে আসছে।
প্রতিবছর রোটারিয়ানরা লক্ষ-কোটি টাকা রোটারী ফাউন্ডেশনে দান করে কি পান? মূলতঃ রোটারী ফাউন্ডেশনে যারা দান করেন তারা শুধুমাত্র মানবসেবার জন্যই ঐ দান করে থাকেন। কিন্তু, তারপরও রোটারী ইন্টারন্যাশনাল বা রোটারী ফাউন্ডেশন মনে করেন- যারা দান করছেন তাদের তো সম্মাননা প্রদান করা দরকার। যার ফলে প্রতিটি দানের পরই ঐ রোটারিয়ানকে বিশেষভাবে মূল্যায়িত করা হয়। যেমন- ১ হাজার ডলার প্রদান করে পিএইচএফ (পল হ্যারিস ফেলো) হলে রোটারীর প্রতিষ্ঠাতা পল পি. হ্যারিসের মুখায়ব আকৃত একটি সুন্দর লেবেল পিন তাকে প্রদান করা হয়। এছাড়া এমডি (মেজর ডোনার) বা একেএস (আর্ক ক্লাম্প সোটাইটি মেম্বার), পিএইচএস (পল হ্যারিস সোটাইটি মেম্বার), বেনিফ্যাক্টর (১ হাজার ডলার থেকে ১ কোটি ডলার পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপ) পদকধারী হলে তাকেও নানা ধরনের উপহার দেয়া হয়। তবে মেজর ডোনার থেকে এর উপরের স্তরের পদকধারীদের জন্য রয়েছে আরো চমকপ্রদ ব্যবস্থা। তাদের মূল্যায়ন করার জন্য প্রতি বছর রোটারী ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশনে এবং আমেরিকায় রোটারী প্রধান অফিসে আয়োজন করা হয় বিশেষ অনুষ্ঠানের।
প্রতি বছর রোটারী ফাউন্ডেশনের ট্রাস্টিরা রোটারী ইন্টারন্যাশনাল কনভেনশনে বেশ কিছু বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। এই ইভেন্টগুলো দাতাদের সেবার প্রতিশ্রুতি এবং ফাউন্ডেশনের তাদের উদার সমর্থনকে সম্মান করে।
দাতাদের জন্য আয়োজন করা হয় রোটারী ফাউন্ডেশন ডোনার সামিট। রোটারী ফাউন্ডেশন ডোনার সামিট হল একটি সাধারণ সেশন শৈলী ইভেন্ট যা ট্রাস্টি চেয়ার দ্বারা আয়োজিত হয়। এই অনুপ্রেরণামূলক, তথ্যপূর্ণ ইভেন্টের সময়, দাতারা রোটারীর প্রোগ্রামে তাদের সহায়তার মাধ্যমে তাদের প্রভাব সম্পর্কে গল্প শুনতে পাবেন। এই অধিবেশনে সাধারণত আর্চ ক্লাম্ফ সোসাইটি অনুষ্ঠান, রোটারী নেতাদের মূল বার্তা এবং বিনোদনের বৈশিষ্ট্য রয়েছে। ক্লাম্ফ সোসাইটির সদস্য, লিগ্যাসী সোসাইটির সদস্য, বেকুয়েস্ট সোসাইটির সদস্য, মেজর ডোনার ও পল হ্যারিস সোসাইটির সদস্যরা এই ইভেন্টে আমন্ত্রণ পাবেন।
রোটারী ফাউন্ডেশন ইউনিটি বল : শিকাগো স্কাইস্ক্র্যাপারের জন্য নামকরণ করা হয়েছে, যেটি ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯০৫ তারিখে প্রথম রোটারী ক্লাব মিটিং আয়োজন করেছিল। এই প্রিমিয়ার ডিনার ইভেন্টটি ফাউন্ডেশনের জনহিতৈষী নেতাদের স্বীকৃতি দেয় এবং তাদের অসাধারণ উদারতা উদযাপন করে। ক্লাম্ফ সোসাইটির সদস্যরা এবং লিগ্যাসী সোসাইটির সদস্যরা এই ইভেন্টে আমন্ত্রণ পান।
বার্ষিক দাতা স্বীকৃতি ডিনার : এটি একটি ডিনার ইভেন্ট। যা প্রতি বছর আয়োজক শহরের উদযাপনের জন্য তার নাম পরিবর্তন করে, এটি ফাউন্ডেশনের উল্লেখযোগ্য এবং সক্রিয় দাতাদের জন্য কৃতজ্ঞতা এবং কৃতজ্ঞতার একটি সন্ধ্যা। লেভেল-৪ মেজর ডোনার, লেভেল ৫ এবং ৬ দান সোসাইটির সদস্য এবং দাতারা যারা সেই রোটারী বছরে তাদের দান বা প্রতিশ্রুতির স্তরকে উন্নীত করেছেন তারা এই ইভেন্টে আমন্ত্রণ পান।
রোটারী ফাউন্ডেশনের উল্লেখযোগ্য কার্যক্রম হচ্ছে বিশ্ব থেকে পোলিও নির্মূল। ১৯৮৪ সালে পোলিও প্লাসের কার্যক্রম শুরু করে রোটারী ইন্টারন্যাশনাল। ধীরে ধীরে পৃথিবী থেকে পোলিও নির্মূলের পথে এগিয়ে গেলে ২০১১ সালে এগিয়ে আসেন বিশ্বের শীর্ষ ধনী বিল গেটস। তাঁর প্রতিষ্ঠিত বিল এন্ড মেলিন্ড গেটস পোলিও নির্মূলে রোটারী ফাউন্ডেশনকে দান করেন ১ বিলিয়ন ডলার। ২০১৮ সাল থেকে পৃথিবী থেকে পোলিও নির্মূলে মহাপরিকল্পনা করেছে রোটারী। এছাড়া সারা পৃথিবীতে পোলিওমুক্তকরণে রোটারী ইন্টারন্যাশনাল প্রায় ৪৫ হাজার কোটি টাকা খরচ করেছে।
রোটারী ফাউন্ডেশন আফ্রিকার বিভিন্ন দেশসহ তৃতীয় বিশ্বের অভাবগ্রস্ত দেশে বিভিন্ন প্রকল্প তৈরি করে ঐ ফান্ড থেকে মানুষের সেবা করা হচ্ছে। এর মধ্যে বাংলাদেশের বিভিন্ন স্থানেও বৃহৎ প্রকল্পগুলোতে রোটারী ফাউন্ডেশন সহযোগিতা করে আসছে।
রোটারী ফাউন্ডেশনে বিভিন্ন পর্যায়ে দানকারীদের বিভিন্নভাবে পদক দেয় রোটারী ইন্টারন্যাশনাল। মাত্র ১শ’ ডলার অনুদান প্রদান করলে আরএফএসএম (রোটারী ফাউন্ডেশন সাসটেইনিং মেম্বার), ১ হাজার ডলার এই ফান্ডে অনুদান প্রদান করলে পিএইচএফ (পল হ্যারিস ফেলো) পদক দেয়া হয়। এছাড়া ২ হাজার থেকে ৯ হাজার ৯শ’ ৯৯ ডলার পর্যন্ত এমপিএইচএফ (মাল্টিপল পল হ্যারিস ফেলো), ১০ হাজার থেকে ২ লাখ ৪৯ হাজার ৯শ’ ৯৯ ডলার পর্যন্ত এমডি (মেজর ডোনার) এবং ২ লাখ ৫০ হাজার থেকে ১ কোটি ডলার (১০ মিলিয়ন) একেএস (আর্ক ক্লাম্প সোটাইটি মেম্বার) পদক। এছাড়া রয়েছে পিএইচএস (পল হ্যারিস সোটাইটি মেম্বার) পদক, যারা আজীবন প্রতি বছর কমপক্ষে ১ হাজার ডলার করে ফাউন্ডেশনে অনুদান দেবেন এবং বেনিফ্যাক্টর পদক (১ হাজার ডলার থেকে ১ কোটি ডলার পর্যন্ত বিভিন্ন ধাপ)। রোটারী জেলা-৩২৮২ (বাংলাদেশ) এর বিভিন্ন রোটারী ক্লাবের সদস্যদের মধ্যে প্রায় সহস্রাধিক পিএইচএফ ও এমপিএইচএফ পদকপ্রাপ্ত রয়েছেন। এছাড়া রয়েছেন সহস্রাধিক আরএফএসএম পদকধারী রোটারীয়ান। এছাড়া রয়েছেন এমডি (মেজর ডোনার) এবং একেএস (আর্ক ক্লাম্প সোটাইটি মেম্বার)।
পৃথিবীর নানা দেশে শতভাগ আরএফএসএম, পিএইচএফ ও পিএইচএস ক্লাবও রয়েছে। ঐসব ক্লাবের সব সদস্য’ই ফাউন্ডেশনে ১শ’ ও ১ হাজার ডলার বা প্রতিবছর ১ হাজার ডলার করে অনুদান প্রদান করেন। ২০১৪ সালে রোটারী ইন্টারন্যাশনাল ডিস্ট্রিক্টের গভর্নর নমিনি রোটারিয়ান আলহাজ মো. মিজানুর রহমান (সুফী মিজানুর রহমান) সস্ত্রীক সারা বাংলাদেশে প্রথম একেএস (আর্ক ক্লাম্প সোটাইটি মেম্বার) পদকধারী হন। পরবর্তীতে ২০১৯ সালে পিডিজি দ্যাতোঁ মীর আনিসুজ্জামানও সস্ত্রীক একেএস (আর্ক ক্লাম্প সোটাইটি মেম্বার) পদকধারী হন।
উল্লেখ্য, রোটারী ইন্টারন্যাশনাল ব্যবসায়িক ও পেশাদার ব্যক্তিদের নিয়ে গড়ে উঠা বিশ্বব্যাপী সেবামূলক সংগঠন। উচ্চস্তরের মানদণ্ড, সমাজসেবা ও আন্তর্জাতিক বোঝাপড়ায় এ সংগঠনের ভূমিকা অপরিসীম। প্রত্যেক ব্যবসায়িক ও পেশাদার ক্লাব থেকে একজন ব্যক্তি রোটারী ক্লাবের সদস্য হয়ে থাকেন। শিকাগোর মার্কিন অ্যাটর্নি পল পি. হ্যারিস ১৯০৫ সালে এ সংগঠনটি প্রতিষ্ঠা করেন যা বিশ্বের অন্যতম প্রাচীন সেবাধর্মী প্রতিষ্ঠানরূপে স্বীকৃত। প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি, ব্যবসায় ও পেশাদারী পর্যায়ে উচ্চ নৈতিক মূল্যবোধ গঠন এবং বিশ্বব্যাপী ফেলোশীপ প্রদানের মহান ব্রত নিয়ে আদর্শ সেবাপ্রদানকল্পে এ সংগঠনটি গঠন করেন। প্রতিষ্ঠাকালীন সময়েই এ সংগঠনের সদস্যপদের জন্য সীমারেখা নির্দিষ্ট করে যান। একবিংশ শতকের শুরুতে বিশ্বের দুই শতাধিক দেশ ও ভৌগোলিক এলাকায় প্রায় ১২ লাখেরও বেশি সদস্য রয়েছে।
মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয়িস অঙ্গরাজ্যের এভানস্টোনে রোটারী ইন্টারন্যাশনালের সদর দফতর অবস্থিত। ঘূর্ণায়মান পদ্ধতিতে সদস্যদের কার্যালয়ে সভা অনুষ্ঠিত হওয়ায় এর নাম রোটারী রাখা হয়েছে। শুরুতে এটি ইন্টারন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব রোটারী ক্লাবস নামে পরিচিত ছিল। ১৯২২ সালে এর নামকরণ করা হয় রোটারী ইন্টারন্যাশনাল। কিন্তু বিশ্বের অন্যান্য দেশে এ সংগঠনটি রোটারী ক্লাব নামে পরিচিত। বিভিন্ন জনকল্যাণমুখী সেবামূলক প্রকল্প গ্রহণের পাশাপাশি ১৯১৭ সালে রোটারী ফাউন্ডেশন গঠন করা হয়। ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে বিদেশে পড়াশোনার জন্য বৃত্তি, মানবধর্মী প্রকল্পে অর্থবরাদ্দ এবং রোটারিয়ানদের বিদেশ সফরে নিয়ে যাওয়া হয়।
(তথ্যসূত্র: রোটারী ফাউন্ডেশনের সেমিনার সুভ্যেনির ও রোটারী ইন্টারন্যাশনাল অফিস)
লেখক: জয়েন্ট সেক্রেটারী (২০২১-২৩), চাঁদপুর রোটারী ক্লাব ও প্রধান সম্পাদক দৈনিক ইলশেপাড়।

১০ নভেম্বর, ২০২২।