ফরিদগঞ্জে নিহত ৩ যুবদল নেতা
রুহুল আমিন খাঁন স্বপন
২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর ফরিদগঞ্জ উপজেলার রাজনীতির ইতিহাসের একটি কলঙ্কময় দিন। তৎকালীন বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলীয় জোটের আহ্বানে ডাকা মিছিল-সমাবেশকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষের সময় পুলিশ বা অস্ত্রধারীদের ছোড়া গুলিতে নিহত হন ফরিদগঞ্জের ৩ যুবদল কর্মী।
এরা হলেন- উপজেলার পাইকপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের পূর্ব গাজীপুর তিনকড়ি বেপারী বাড়ির আ. মতিন বেপারী ও তফুরেরনেছা দম্পত্তির ছোট ছেলে জাহাঙ্গীর বেপারী, রূপসা উত্তর ইউনিয়নের বারপাইকা গ্রামের মো. আব্দুল আলিম ও হাজেরা বেগমের ছেলে আরিফ হোসেন এবং একই ইউনিয়নের বদরপুর গ্রামের আব্দুর রহিম ও সফুরা বেগমের ছেলে বাবুল ভূঁইয়া।
নিহতের পরিবারের পক্ষ থেকে ওই সময়ে মামলা করা হলেও তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পাল্টা মামলার কারণে তাদের মামলাগুলোর অস্তিত্ব আর খুঁজে পাওয়া যায়নি। একযুগ মুখ বুঝে সবকিছু সহ্য করলেও স্বৈরাচারের পতনের পর নতুন করে বিচারের আশা করছেন ওই তিন পরিবারের স্বজনরা। এক যুগেও তাদের স্বজনদের হত্যার বিচার না পাওয়ার যন্ত্রণাকে তাদের কুঁড়ে কুঁড়ে খাচ্ছে।
সরেজমিন নিহত তিন যুবদল কর্মীর বাড়ি গিয়ে তাদের মা-বাবা ও ভাইদের সাথে কথা বলে দুঃসহ জীবনের স্মৃতি হাতড়িয়ে বেড়ানো এবং প্রত্যাশার কথা জানা গেছে।
রূপসা উত্তর ইউনিয়নের বারপাইকা গ্রামের মুন্সি বাড়ির মরহুম আ. আলিমের ৩ সন্তানের মধ্যে সবার ছোট আরিফ পেশায় ছিল টাইল্স মিস্ত্রী। ২০১৩ সালের ২৫ অক্টোবর জুমার নামাজের পর বাড়ি থেকে বের হয়ে বিএনপির মিছিলে যোগ দেন। কিন্তু বাড়ি ফিরেন লাশ হয়ে।
মা হাজেরা বেগম জানান, ছেলেকে হারানোর পর থেকে তার সংসারের সুখ চলে গেছে। তার স্বামী মারা যান। মেঝো ছেলে দেলোয়ার হোসেন ব্রেন স্ট্রোক করে। আরিফের বিধবা স্ত্রী আদরের নাতনিকে নিয়ে অন্যত্র বিয়ে করে চলে যায়।
ভাই দেলোয়ার হোসেন বলেন, পুলিশ ও আওয়ামী লীগের ক্ষমতার দাপটে তার ভাই আরিফের হত্যার বিচার পাননি। মামলা করা হলেও উল্টো মামলা দিয়ে আমাদের মামলাকেই শেষ করে দিয়েছে। ফ্যাসিবাদী স্বৈরাচারের পতনের পরও মামলাটি পুনঃতদন্তের আবেদনের পর খারিজ করে দেয় আদালত। তবে প্রত্যাশা করছি অন্তর্বর্তী সরকারের সঠিক নিদের্শনায় মামলাটি পুনরায় তদন্ত হবে এবং আমরা ন্যায়বিচার পাবো।
একই ইউনিয়নের দক্ষিণ বদরপুর গ্রামের আনিছ ভূঁইয়া বাড়ির আ. রহিমের ৬ সন্তানের মধ্যে বড় বাবুল ভূঁইয়া। বিএনপির ডাকা মিছিলে অংশ নিতে ফরিদগঞ্জ সদরে আসেন, কিন্তু ফিরেন লাশ হয়ে।
বাবা আব্দুর রহিম জানান, সেদিন ছেলের গুলি খাওয়ার সংবাদ শুনে হাতে থাকা ৫০ টাকা নিয়ে ছুটে গিয়েছি ফরিদগঞ্জে। পুলিশের রক্তচক্ষু ও ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের চাপের মধ্যেই ছেলেকে বাঁচানোর চেষ্টা করেছি, কিন্তু পারিনি।
নিহত বাবুলের স্ত্রী রোকেয়া বেগম বলেন, কাঠমিস্ত্রীর কাজ করে সংসার চালাতেন তার স্বামী। স্বামীর মৃত্যুর পর তিন সন্তানকে নিয়ে অনেক কষ্ট করেছি। আওয়ামী লীগের লোকজন টাকার লোভ দেখালেও তাতে সাড়া দেইনি। অপেক্ষায় রয়েছি স্বামী হত্যার বিচারের।
পাইকপাড়া দক্ষিণ ইউনিয়নের পূর্ব গাজীপুর গ্রামের তিনকড়ি বাড়ির মৃত আব্দুল মতিনের ৯ সন্তানের সবার ছোট জাহাঙ্গীর বেপারীও ওইদিন আরো নেতাকর্মীর মতই মিছিলে এসেছিলেন। কিন্তু তিনিও লাশ হয়েই ফিরেন।
বড় ভাই সেলিম বেপারী জানান, জাহাঙ্গীরের মৃত্যুতে সবকিছুই উলোটপালট হয়ে যায় তার সংসারে। এক পর্যায়ে তার স্ত্রী চলে যায়। মেয়েটির বিয়ে হয়ে গেছে। কিন্তু ছোট ভাইয়ের হারানোর ব্যথা ভুলতে পারছি না। ফ্যাসিস্টরা এতোদিন আমাদের কথা বলতে না দিলেও এখন বিশ^াস করি খুনিদের বিচার হবেই।
উপজেলা বিএনপির যুগ্ম-আহ্বায়ক ডাক্তার আবুল কালাম আজাদ বলেন, জাহাঙ্গীর, বাবুল ও আরিফের মৃত্যুর বিষয়ে মামলা হয়েছিল। কিন্তু স্বৈরাচার সরকারের প্রশাসন মামলাটির প্রকৃত অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে ব্যর্থ হয়েছিল। আমরা উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এমএ হান্নান চৌধুরীর পক্ষ থেকে আর্থিক ও মানসিক সহযোগিতার মধ্য দিয়ে ওই পরিবারগুলোর পাশে ছিলাম। এখন যেহেতু স্বৈরাচার সরকার চলে গেছে, আশা করি মামলাটি পূনঃতদন্তের মাধ্যমে প্রকৃত অপরাধীরা বিচারের আওতায় আসবে। আমরা বিএনপি পরিবার ভুক্তভোগী পরিবারগুলোকে সহযোগিতা করবো।
বিএনপি কেন্দ্রিয় কমিটির ব্যাংকিং ও রাজস্ব বিষয়ক সম্পাদক ও ফরিদগঞ্জের সাবেক এমপি লায়ন মো. হারুনুর রশিদ বলেন, জাহাঙ্গীর, বাবুল ও আরিফের পরিবারের আমরা নিয়মিত খোঁজখবর রেখে আসছি। তাদের হত্যার সঠিক বিচার পাওয়ার জন্য যা করা প্রয়োজন আমরা তাই করবো।
ফরিদগঞ্জ থানার ওসি মো. হানিফ সরকার বলেন, বিষয়টি আমি জেনেছি, বাদী পক্ষ আমাদের কাছে এসেছিল। মামলা যেহেতু আদালতে বিচারাধীন তাদের আদালতে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছি। আদালত আমাদের যে নির্দেশনা দিবে, আদালতের নির্দেশনা মোতাবেক আমরা ব্যবস্থাগ্রহণ করবো।
০৬ অক্টোবর, ২০২৪।