হাইমচরে কার্গোতে মিললো ৭ জনের মরদেহ

এস এম সোহেল
হাইমচর উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকায় মেঘনা নদীতে নোঙর অবস্থায় থাকা মেসার্স বৃষ্টি এন্টারপ্রাইজের ‘আল-বাখেরা’ নামক জাহাজ থেকে ৭ জনের মরদেহ উদ্ধার করেছে পুলিশ। এছাড়া গুরুতর আহত একজনকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় নেওয়া হয়েছে।
সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) বিকেলে নীলকমল ইউনিয়নের মাঝিরবাজার নামক স্থান থেকে নিহতদের মরদেহ ও আহতদের উদ্ধার করে কোস্টগার্ড ও পুলিশ। পুলিশের ধারণা জাহাজে ডাকাতিতে বাঁধা দেয়ায় এই ঘটনা ঘটে। এসব তথ্য নিশ্চিত করেন নৌ-পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার সৈয়দ মোশফিকুর রহমান।
নিহতরা হলেন- জাহাজের মাস্টার কিবরিয়া, ইঞ্জিনচালক সালাউদ্দিন, সুকানি আমিনুল মুন্সি, গ্রীজার সজিবুল, আজিজুল ও মাজেদুল ইসলাম। নিহত একজনের নাম জানা যায়নি। অন্যদিকে গুরুতর আহত জাহাজের আরেক সুকানি জুয়েলকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় পাঠানো হয়েছে। আহত ও নিহত সবার বাড়ি নড়াইল জেলায়।
পুলিশ ও কোস্টগার্ডসহ অন্যরা জানান, চট্টগ্রাম থেকে পাবনার বাঘাবাড়ীর উদ্দেশ্যে ছেড়ে আসে ইউরিয়া সার বোঝাই এমভি আল-বাখেরা। প্রথমে জাহাজ থেকে ৫ জনের মৃত্যু নিশ্চিত হলেও চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে আহত ৩ জনকে পাঠানোর পর আরো ২ জনের মৃত্যু হয়।
ডাকাতি নাকি শত্রুতার কারণে এই হত্যাকাণ্ড ঘটানো হয়েছে, তা নিয়ে জানতে চাইলে জাহাজটির মালিক দিপলু রানা বলেন, আমি জানি না কীভাবে এই হত্যাকাণ্ড ঘটেছে, কারা ঘটিয়েছে। পুলিশ তদন্ত করে আসল ঘটনা বের করতে পারবে।
তিনি আরো বলেন, চট্টগ্রাম থেকে রওয়ানা হওয়ার পর রোববার রাত সাড়ে ৮টার দিকে জাহাজটির চালকের (মাস্টার) সঙ্গে তার সর্বশেষ কথা হয়। তখন চালক জানিয়েছিলেন, মেঘনা নদীতে তারা জাহাজের বহরের মধ্যেই ছিলেন। তবে সকালে মুঠোফোনে যোগাযোগ করা হলেও কেউ সাড়া দেননি।
তিনি বলেন, বারবার যোগাযোগ করেও কাউকে না পেয়ে আমাদের আরেকটি জাহাজের (মুগনি-৩) নাবিকদের বিষয়টি জানাই। ওই জাহাজ এমভি আল-বাখেরা এর কাছাকাছি ছিল। তারা আল-বাখেরা এর কাছাকাছি যাওয়ার পরই হত্যাকাণ্ডের বিষয়টি জানতে পারেন।
মেসার্স বৃষ্টি এন্টারপ্রাইজের অপর জাহাজ মুগনি-৩ এর মাস্টার বাচ্চু মিয়া ও গ্রীজার মো. মাসুদ জানান, সার বহনকারী আল-বাখেরা গত রোববার (২২ ডিসেম্বর) সকাল ৮টায় চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসে। এরই মধ্যে কোম্পানির মালিক বাখেরাহ জাহাজে ফোন করে কাউকে পায়নি। যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন থাকায় মুগনি জাহাজ থেকে যোগাযোগ করার জন্য বলে। ওই সময় মুগনি জাহাজটি মাওয়া থেকে ঘটনাস্থল দিয়ে অতিক্রম করার সময় বাখেরাহ জাহাজটি দেখতে পায়। ওই সময় তারা জাহাজের লোকদের রক্তাক্ত অবস্থায় পড়ে থাকতে দেখে ‘৯৯৯’- নম্বরে কল দেয়।
এদিকে, ‘৯৯৯’ নম্বরে কলের সূত্র ধরে চাঁদপুর থেকে কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়। নৌ-পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার সৈয়দ মোশফিকুর রহমানের উপস্থিতিতে কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশ জাহাজ থেকে প্রথমে ৫ জনের মরদেহ উদ্ধার করে এবং ৩ জনকে আহত অবস্থায় চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালে পাঠায়।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক মেডিকেল অফিসার (আরএমও) ডা. আনিসুর রহমান বলেন, জুয়েল নামে আহত একজনের ধারালো অস্ত্রের আঘাতে গলা ও শ্বাসনালীও কাটা ছিল। প্রাথমিক চিকিৎসা শেষে তাকে উন্নত চিকিৎসার জন্য ঢাকায় প্রেরণ করা হয়। আর সজিবুল ও মাজেদুলকে মৃত অবস্থায় হাসপাতালে আনা হয়। তাদের মাথায় ও শরীরে আঘাতের চিহ্ন রয়েছে।
নৌ-পুলিশ চাঁদপুর অঞ্চলের পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান জানান, ‘৯৯৯’ নম্বরে খবর পেয়ে ঘটনাস্থলে ছুটে আসি। যে জাহাজটিতে মরদেহ পাওয়া গেছে সেটির নাম এমভি ‘আল-বাখেরা’। জাহাজটি মেঘনা নদীর পশ্চিম পাড়ে মাঝিরবাজার এলাকায় নোঙর করা অবস্থায় ছিল। ওই জাহাজের বিভিন্ন কক্ষে ৫ জনের মরদেহ পাওয়া গেছে। ৩ জন গুরুতর আহত অবস্থায় ছিল। চাঁদপুর জেনারেল হাসপাতালে পাঠানো হলে তাদের মধ্যে দু’জন মারা যান। একজনকে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে প্রেরণ করা হয়েছে। কীভাবে ৭ জনের মৃত্যু হলো, তা এখনো জানা যায়নি। তবে তাদের শরীরের বিভিন্ন অংশে মারাত্মক আঘাতের চিহ্ন রয়েছে। প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে দেশীয় অস্ত্র দিয়ে মারা হয়েছে। ২টি মোবাইল পাওয়া গেছে। তার সূত্রে ধরে রহস্য উদঘাটন করা হবে। এখনো পর্যন্ত নিহতদের নাম-পরিচয় পাওয়া যায়নি।
নৌ পুলিশ সুপার সাংবাদিকদের আরো বলেন, জাহাজের মালিকের বক্তব্য অনুযায়ী সারবোঝাই জাহাজটি চট্টগ্রামের কাফকো থেকে সিরাজগঞ্জের বাঘাবাড়ীতে যাচ্ছিল। গতকাল চট্টগ্রাম থেকে ছেড়ে আসা জাহাজটি আজ সিরাজগঞ্জে এসে পৌঁছার কথা ছিল। কিন্তু জাহাজের খবর না পেয়ে জাহাজের মালিক অন্য জাহাজের সঙ্গে যোগাযোগ করেন। একপর্যায়ে অন্য জাহাজের কর্মচারীর মাধ্যমে তার জাহাজটি চাঁদপুরে মেঘনা নদীর পাড়ে আছে শুনে ৯৯৯-এ পুলিশকে জানান।
গতকাল ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন। তিনি বলেন, আহত একজন হাতের ইশারায় জানিয়েছে তারা ৮ জন ছিলেন। ঘটনাটি কিভাবে হয়েছে এই মুহূর্তে বলা যাচ্ছে না। ডাকাতি, কিংবা অন্য কোনো কারণে হতে পারে। তদন্ত করার পরে জানা যাবে। নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ডের সঙ্গে নিরাপত্তা বিষয়ে কথা বলেছি। কারণ এই রুটে পণ্যবাহী জাহাজ চলাচল করে। যাতে করে নিরাপত্তা ব্যবস্থা আরও জোরদার করা হয়।
ইতোমধ্যে ঘটনাস্থলে জেলা পুলিশ, নৌ পুলিশ ও কোস্টগার্ড নিহতদের প্রাথমিক সুরতহাল প্রতিবেদন তৈরি করছে।
৭ খুনের ঘটনা তদন্তে কমিটি গঠন : হাইমচর উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী এলাকায় মেঘনা নদীতে সারবোঝাই এমভি আল-বাখেরা জাহাজে ক্রু সদস্যদের গলা কেটে নির্মমভাবে হত্যা ও আহতের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করেছে শিল্প মন্ত্রণালয়।
সোমবার শিল্প মন্ত্রণালয়ের পাঠানের সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে তথ্য জানানো হয়েছে। চার সদস্যের তদন্ত কমিটিতে মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক এবং যুগ্ম সচিবকে সদস্য সচিব করা হয়েছে।
কমিটিকে সংঘটিত হত্যাকাণ্ডের কারণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ও দায়দায়িত্ব নিরূপণ, অনুরূপ নৌ দুর্ঘটনা রোধে ভবিষ্যতে করণীয় নির্ধারণ করে সুস্পষ্ট সুপারিশসহ একটি প্রতিবেদন আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
জাহাজে একদল জলদস্যু/ডাকাতের হামলায় ক্রু সদস্যদের গলা কেটে নির্মমভাবে হত্যাকাণ্ড ও আহতের ঘটনায় শিল্প মন্ত্রণালয় গভীর শোক প্রকাশ এবং তাদের পরিবারের সদস্যদের প্রতি সমবেদনা জ্ঞাপন করছে। একই সঙ্গে মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে এ হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় জড়িতদের দ্রুত গ্রেফতার ও শাস্তির দাবি জানানো হয়েছে।

শ্বাসনালী কেটে যাওয়ায় কথা বলতে পারছেন না জুয়েল

হাইমচর উপজেলার নীলকমল ইউনিয়নের মেঘনায় সারবাহী জাহাজ থেকে আহত অবস্থায় উদ্ধার ফরিদপুরের জুয়েল (৩৫) ঘটনার বিষয়ে নৌ-পুলিশকে কিছু একটা বলতে চেয়েছেন; কিন্তু শ্বাসনালী কেটে যাওয়ায় তিনি কিছু বলতে পারছিলেন না। তাই নিজ হাতে লিখে সেটি বলার চেষ্টা করেন।
শেষ পর্যন্ত অবস্থা গুরুতর হওয়ায় লেখা শেষের আগেই সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় তাকে দ্রুত অ্যাম্বুলেন্সে করে চাঁদপুর সদর হাসপাতাল থেকে ঢাকার উদ্দেশে নিয়ে যাওয়া হয়।
সোমবার বেলা ৩টার দিকে হাইমচরের মেঘনা নদীর নীলকমল ইউনিয়নের খাল এলাকায় নোঙর করা এমভি আল-বাখেরা নামের একটি জাহাজ থেকে ৫ জনের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। আর ৩ জনকে গুরুতর আহত অবস্থায় উদ্ধার করে হাসপাতালে নেওয়া হলে চিকিৎসক দু’জনকে মৃত ঘোষণা করেন।
চাঁদপুর নৌ-থানার ওসি এ কে এম ইকবাল বলেন, আমরা আহত জুয়েলের সঙ্গে কথা বলার চেষ্টা করেছি; কিন্তু তিনি কথা বলতে পারেননি। শুধু একটি কাগজে তার নাম আর একটি মুঠোফোন নম্বর দিয়ে যান। আর শেষ দিকে ‘আমি স’ লেখার পর অ্যাম্বুলেন্সটি চাঁদপুর থেকে চলে যায়। আমাদের ধারণা, জুয়েল হয়তো কিছু একটা জানেন বলে বলার চেষ্টা করেছেন। তবে এখনো কোনো তথ্য নেওয়া সম্ভব হয়নি।
চাঁদপুর নৌ পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, সোমবার ভোরে বা সকালের মধ্যে কোনো এক সময়ে হত্যাকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে বলে তারা ধারণা করছেন। যেখানে ঘটনাটি ঘটেছে সেটি মেঘনা নদীর পশ্চিমাংশ চর এলাকায়। দুপুরে খবর পেয়ে নৌ পুলিশের সেখানে পৌঁছাতেও এক ঘণ্টা সময় লেগেছে। দুর্বৃত্তরা নিরিবিলি এলাকা নিশ্চিত হয়ে এ ঘটনা ঘটিয়ে সহজে পালিয়ে যায় বলে ধারণা করছেন।
২৫০ শয্যা চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের আবাসিক চিকিৎসা কর্মকর্তা ডা. মো. আনিসুর রহমান বলেন, সবাইকে ধারালো অস্ত্র দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়। এজন্য একজন ছাড়া বাকিরা রক্তক্ষরণে মারা যান। জুয়েল নামের একজনের শ্বাসনালী কাটার পরও তিনি শ্বাস নিতে না পারায় তাকে ঢাকায় পাঠানো হয়।

২৪ ডিসেম্বর, ২০২৪।