হাজীগঞ্জে পুত্রের ধূম্রজালে ভিটেমাটি হারাতে বসেছেন অসহায় বৃদ্ধা মা

স্টাফ রিপোর্টার
হাজীগঞ্জে নিজ গর্ভধারিত লালিত-পালিত পুত্রের প্রতারণার শিকার হয়ে ভিটেমাটি হারাতে বসেছেন এক অসহায় কর্মহীন বৃদ্ধা মা। নিজ সন্তানের এরূপ জঘণ্য কাজে লজ্জিত ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছে এলাকাবাসীও। তাই সমস্যা সমাধানে স্থানীয় এমপি মেজর রফিকুল ইসলাম বীর উত্তমের হস্তক্ষেপ চেয়েছেন ভুক্তভোগী ও সুধীমহল। ঘটনাটি হাজীগঞ্জের জাকনি গ্রামে।
সরজমিনে গিয়ে জানা যায়, হাজীগঞ্জ উপজেলার জাকনি গ্রামে বৃদ্ধা অহিদা বেগম তিন ছেলে বাচ্চু বেপারী, আব্দুর রশীদ ও শাহআলম বেপারী এবং এক মেয়ে সংসার। অহিদা বেগমের স্বামী প্রায় ১৭ বছর আগে মারা যায়। এ পর্যন্ত তাদের সম্পত্তির কোন ভাগ-বাটোয়ারা হয়নি। তিন ভাই-বোনই বিবাহিত। বাবা মারা যাওয়ার ৪/৫ বছর পর বৃদ্ধা অহিদা বেগমকে তার ২ ছেলে আব্দুর রশীদ ও শাহআলম বেপারী আর দেখাশোনা, এমনকি ভোরণ-পোষণ পর্যন্ত দেয় না। ৫/৬ বছর আগে বৃদ্ধা অসহায় মা ও তার সন্তানদের যৌথ সম্পত্তি অন্যদের স্বাক্ষর ও মতামত না নিয়েই বিক্রি করেছেন তার আরেক পুত্র। একই বাড়ির প্রতিবেশী প্রবাসী আবুল খায়েরের মোটা অংকের টাকায় প্রলোভিত হয়ে এই ধূম্রজালের ঘটানো হয়েছে। আর প্রবাসী ব্যক্তিও নিজের গোপন স্বার্থ হাসিলের জন্য স্থানীয়দের ভাষ্যে ৪০/৫০ হাজার টাকার শতাংশের জায়গা কিনে নিয়েছেন ১ লাখ ৩০ হাজার টাকা করে অর্থাৎ দ্বিগুণেরও বেশি দাম দিয়ে। যার ভাগ-বাটোয়ারার আংশিক টাকা অনেকের পটেকে ঢুকলেও কপাল পুড়েছে অসহায় বৃদ্ধা মায়ের! এমন ঘটনার বর্ণণা করলো ওই বৃদ্ধা অসহায় মা, তার এক ভবঘুরে ছেলে এবং স্থানীয় এলাকাবাসী।
এ ব্যাপারে অসহায় বৃদ্ধা অহিদা বেগম বলেন, আব্দুর রশীদ আমার ছেলে। তার বাবা মারা গেছে প্রায় ১৭ বছর। বাপ মারা যাওয়ার প্রায় ১২/১৩ বছর যাবৎ সে আমাকে ভাত খাওয়ায় না। আমার দেখাশোনা পর্যন্ত করে না। আমি বাড়িতে ছিলাম না। পরে সে না জানিয়ে চুরি করে আমার জায়গা বিক্রি করে ফেলে। ওই জয়াগা বিক্রির সময় আমার দেবর আব্দুল লতিফ ছিলো। এছাড়া এ এলাকার মেম্বারও ছিলো। কিন্তÍ কেউ আমাকে জানায়নি। আমি ঐ সময় আমার বাবার বাড়িতে ছিলাম। তিনি আরও বলেন, গত ২১ মে আমার এক ছেলে আব্দুর রশীদ ৩০/৪০ জন লোক খবর দিয়ে নিয়ে এসে আমার ঘর-দরজা ভেঙ্গে দেয়। আমার বড় ছেলেকে একা পেয়ে লোকজন দিয়ে মেরেছে। আমি এখন কোথায় যাবো। সুষ্ঠু বিচার না পেলে আমি আত্মহত্যা করবো!
বৃদ্ধা অহিদা বেগমের বড় ছেলে ভ্যানচালক বাচ্চু বেপারী বলেন, আমার মাঝারো ভাই আব্দুর রশীদ ভুয়া দলিল করে মোটা অংকের টাকা নিয়ে আমাদের বসত ভিটার জায়গা বিক্রি করছে। আমি হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ, ভূমি অফিস এবং কোর্টে অভিযোগ দিছি। কিন্তু আব্দুর রশীদ এসব কিছু না মেনেই মামলার রায় সে পেয়েছে জানিয়ে প্রবাসি আবুল খায়েরের টাকার লোভে জায়গা বিক্রি করে দেয়। এমনকি অবৈধভাবে ঘর ভেঙ্গে দিয়ে আমার মা ও আমাকে জায়গা থেকে উচ্ছেদ করে দেয়। আমার ছেলের নামের বিদ্যুতের মিটার। সে মিটারও তারা বিদ্যুতের লোকজনকে না জানিয়ে অবৈধভাবে বিচ্ছিন্ন করে তার কেটে দিছে।
বাচ্চু বেপারীর স্ত্রী আয়েশা বেগম বলেন, যৌথ সম্পত্তি কতুটুকু কার তা নির্ধারণ না করেই আমার দেবর আব্দুর রশীদ চাচা লতিফ মিয়ার সাথে যোগসাজশ করে ষড়যন্ত্র করে বিক্রি করে দিয়েছে। আমাদের বসতভিটা থেকে উচ্ছেদ করে বিদ্যুতের লাইন কেটে দিছে। আমরা এই অত্যাচারের সুষ্ঠু বিচার চাই।
স্থানীয় এলাকাবাসী জানান, বৃদ্ধা অহিদা বেগম, তাঁর ৩ ছেলে ১ মেয়ের সম্পত্তি কারো কোন স্বাক্ষর বা সিল/সই না নিয়ে অবৈধভাবে এক ভাই আব্দুর রশীদ প্রবাসী আবুল খায়েরের কাছে বিক্রি করছে। এখন বড় ভাই বাচ্চু বেপারী তার বৃদ্ধা মাকে নিয়ে পথে পথে ঘুরে। বিষয়টি তদন্ত করে প্রশাসন যাতে একটা সুষ্ঠু সমাধান দেয় এই দাবি জানাচ্ছি।
তারা আরো জানান, জায়গা বিক্রি করা আব্দুর রশীদকে জিজ্ঞাসা করলে সে বলে- বাপের জায়গার মালিক আমিও। বোন জামাই ও চাচার উপস্থিতিতে জায়গা বিক্রি করছি। আমার বিরুদ্ধে কোর্টে সন্ত্রাসী মামলা দিছে। সে মামলার রায় পাওয়ার পরই জায়গা বুজিয়ে দিছি। এটা নিয়ে এখন কেন সবাইর মাতামাতি বুজলাম না? কেননা আমি জায়গা বিক্রির সময় সবাইকে জানাইছি তখন কেউ না আসলে আমি কি করতে পারি!
এ বিষয়ে জায়গা বিক্রিতে মধ্যস্থতাকারী বৃদ্ধা অহিদা বেগমের দেবর ও বাচ্চু, চাচা আব্দুল লতিফ জানান, আবুল খায়ের এবং আব্দুর রশীদ উভয়েই আমার ভাতিজা। ওরা নিজেরা নিজেরা দামদস্তুর করে জায়গা কিনেছে। আমি শুধু সাক্ষী হিসেবে স্বাক্ষর করেছি। তবে আমি এই জায়গা বেচা-বিক্রি করতে বাঁধা দেই। তখন আব্দুর রশীদ আমাকে বলে যে, আপোশ বন্টনে এই জায়গা সে বিক্রি করছি। তবে আব্দুল লতিফ বলেন, এটা আইনগতভাবে অবৈধ।
এদিকে জায়গা ক্রয় করা প্রবাসি আবুল খায়েরের স্ত্রী শামসুন নাহার বলেন, আব্দুর রশীদ তার ভাই শাহআলমের থেকে ১ শতাংশ কিনেছে। সেটিসহ তার বাবার থেকে ১ শতাংশ মিলিয়ে আমাদের কাছে ২ শতাংশ বিক্রি করেছে ২ লাখ ৬০ হাজার টাকায়। এখন আমাদের জায়গা বুজিয়ে না দেয়ায় পরবর্তীতে আব্দুর রশীদের নির্দেশে লোকজন এসে জায়গা উচ্ছেদ করে। আমরা আমাদেরটা বুজে নিয়েছি।
অন্যদিকে এ বিষয়ে মুঠোফোনে জায়গা ক্রয় করা প্রবাসী আবুল খায়ের বলেন, যৌথ জায়গা একা কেউ বিক্রি করতে পারে না এটা জানি। কিন্তু জায়গা তো আমি টাকা দিয়ে আব্দুর রশীদের থেকে কিনছি এটা সত্য। এখন এটার সুষ্ঠু সমাধান দিতে পারলে দেন আমি মানবো।
জাকনির ইউপি সদস্য মুক্তিযোদ্ধা শফিকুল ইসলাম বলেন, জায়গা বেচাকেনার পর আমি জেনেছি যে এটার অন্য ওয়ারিশরা কেউ জানে না। আমাকে জানানোর পর আমি বলেছি এটা সমাধানে হাজীগঞ্জ থানায় বসবো। তবে ওয়ারিশদারদের না জানিয়ে বিক্রি করা ঠিক হয়নি।
এ বিষয়ে হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ হারুন আর রশীদ বলেন, আদালতের নির্দেশে আমরা ঘটনাস্থলে যাই। মানবিক দিক চিন্তা করে বৃদ্ধা জন্য ১টি ঘর উঠানোর জন্য বলা হয়েছে। এ ঘটনার সুষ্ঠু সমাধানে আইনগত যা যা করা দরকার সে ব্যবস্থা নেয়া হচ্ছে।

০১ জুন, ২০২১।