হাজীগঞ্জে সহিংসতায় ক্ষতিগ্রস্ত স্থানসমূহ শিক্ষামন্ত্রীর পরিদর্শন

মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
হাজীগঞ্জে পূজামন্ডপে হামলা ও পুলিশ-জনতা সংঘর্ষে পুলিশের গুলিতে ৫ জন নিহতের ঘটনায় উদ্ভুত পরিস্থিতি ও ক্ষতিগ্রস্ত স্থানসমূহ দেখতে সরজমিনে পরিদর্শনে আসেন শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি। মঙ্গলবার (১৯ অক্টোবর) বিকালে তিনি ভাঙচুরকৃত মন্দির পরিদর্শন করেন এবং হিন্দু ধর্মাবলম্বী নেতৃবৃন্দের সাথে কথা বলেন। এরপর তিনি এটি অপশক্তির কাজ এবং পরিকল্পিত ঘটনা উল্লেখ করে সংবাদকর্মীদের উদ্দেশ্যে বক্তব্য রাখেন।
তিনি বলেন, এটা শুধুমাত্র ধর্মীয় সম্প্রীতি ধ্বংস করা নয়, নির্বাচনকে সামনে রেখে দেশকে অস্থিতিশীল করার অপচেষ্টা মাত্র। তারা (অপশক্তি) নানাভাবে চেষ্টা করেছে, কোন কিছুতেই যখন কাজ হচ্ছেনা। তখন বিভিন্ন ধর্মীয় সম্প্রদায়ের উৎসবে হামলার মধ্য দিয়ে তারা দেশের স্থিতিশীলতা এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করতে চায়।
তিনি সনাতন ধর্মালম্বীদের আশ্বস্ত করে বলেন, দেশের যেসব স্থানে এসব ঘটনা ঘটেছে এবং এই ঘটনার সাথে যারা জড়িত আছে, সরকার অবশ্যই তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিবে। আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সরকার আপনাদের পাশে আছে। আমরাও আছি। আমাদের স্থানীয় প্রশাসন, পুলিশ ও আপনারাসহ (গণমাধ্যম) আমাদের দলীয় নেতাকর্মীরা আপনাদের পাশে আছে।
যেদিন থেকে এখানে (হাজীগঞ্জে) ঘটনা ঘটেছে, সেদিন থেকে তারা সবার পাশে আছে উল্লেখ করে ডা. দীপু মনি বলেন, ইতোমধ্যে প্রধানমন্ত্রী সম্প্রীতি সমাবেশের ঢাক দিয়েছেন। আওয়ামী লীগও সম্প্রীতি সমাবেশের ঢাক দিয়েছে এবং আজকে চাঁদপুরসহ সারাদেশে শান্তি ও সম্প্রীতির শোভাযাত্রা হয়েছে। সেই কর্মসূচীর অংশ হিসেবে আমি চাঁদপুর ও আজকে এখানে (হাজীগঞ্জ) এসেছি।
তিনি বলেন, তারা (অপশক্তি) ধর্মের উপর আঘাত হেনে এবং ধর্মীয় বিভেদ তৈরি করে ঘোলা পানিতে মাছ শিকার করতে অপচেষ্টা চালাচ্ছে। এদের বিরুদ্ধে সকল ধর্মের এবং শুভবুদ্ধি সম্পন্ন মানুষকে একযোগে রুখে দাঁড়াতে হবে। আমি মনে করি, প্রতিটি এলাকায় প্রত্যেক প্রতিবেশি তার প্রতিবেশীকে রক্ষা করবার জন্য সজাগ, সর্তক ও সচেষ্ট এবং সক্রিয় থাকতে হবে। সেখানে গণমাধ্যমেরও একটা বড় ভূমিকা রয়েছে।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সমাজে অন্তঃর্নিহিত অনেক শক্তি আছে। সেই শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। সরকার, প্রশাসন, পুলিশ সবাই যেমন মাঠে আছে, তেমনি আমাদের জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক ও সমাজকর্মী, ধর্মীয় নেতৃবৃন্দ, সংবাদকর্মী, পেশাজীবীসহ সর্বস্তরের জনসাধারণকে মিলে প্রতিরোধ গড়ে তোলতে হবে এবং প্রতিটা এলাকায় সবার সমন্বিত এই উদ্যোগ প্রয়োজন।
তিনি আরো বলেন, এই উদ্যোগ শহরকেন্দ্রিক, মফস্বল কিংবা পৌরসভাকেন্দ্রিক নয়, সব এলাকায় নিতে হবে। কারণ এই অপশক্তি যে কোন জায়গায় এবং যে কোন ধর্মীয় উপাসনালয়ে আঘাত হানতে পারে। ভুলে গেলে হবে না, এই উগ্র সাম্প্রদায়িক শক্তি রামুতে, আমাদের বাইতুল মোকাররম মসজিদেও আঘাত হেনেছিলো এবং কুরআন মাজিদ পুড়িয়েছিলো। কাজেই এই অপশক্তি কোন ধর্মের মানুষকেই রেহাই দেয়নি।
সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম বিষয়ে ডা. দীপু মনি বলেন, অপশক্তি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের অপব্যবহার করছে। সেটি যেন তারা করতে না পারে, এ জন্য আমাদের অনেক বেশি সচেতন ও দায়িত্বশীল হতে হবে। দেখা গেছে, অনেকে না বুঝেও পোস্ট করছেন। এতে করে অস্থিতিশীল পরিবেশ ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়।
বক্তব্য শেষে এক প্রশ্নের জবাবে ডা. দীপু মনি বলেন, আমাদের এই সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশে এমন ঘটনা ঘটার উচিত ছিল না। কিন্তু তারপরও অপশক্তির মাধ্যমে এমন ঘটনা ঘটে গেছে। ৭১ এর পরাজিত অপশক্তি এবং ৭৫ এর ঘাতক তারাই কিন্তু কোন না কোন চেহারায় আমাদের এই ধর্মীয় সম্প্রীতি নষ্ট করার অপচেষ্ট চালাচ্ছে।
এ ধরনের ঘটনা আর যেন পূনরাবৃত্তি না হয় উল্লেখ করে তিনি বলেন, পুলিশ এককভাবে সারাদেশের সবাইকে এককভাবে নিরাপত্তা দিতে পারবে না। প্রত্যেকে নিজের এবং প্রতিবেশির ঘর সুরক্ষা ও নিরাপত্তা দেওয়ার জন্য আমাদের সবাইকে অনেক বেশি সজাগ এবং সক্রিয় হতে হবে। বঙ্গবন্ধু কন্যা যেই বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন, বঙ্গবন্ধুর অসাম্প্রদায়িক ও গণতান্ত্রিক বাংলাদেশ। সেই বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে অব্যাহত রাখতে হলে আমাদের প্রত্যেকের প্রত্যেকের পাশে দাঁড়াতে হবে।
অপর এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বিদেশী শক্তি আছে কিনা সেটি তদন্তের বিষয়। তবে বিদেশে বসে যে কোন কোন অপশক্তির এবং অপশক্তির ধারব-বাহক বিদেশে বসে ষড়যন্ত্রের জাল বুনছে এটি তো স্পষ্ট। তাদের বিভিন্ন কথা-বার্তা নানা জায়গায় পাওয়া যাচ্ছে। কাজেই কারা এই অপশক্তি, কারা ২০১৩, ২০১৪ সালে মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা করেছে। কারা আজকেও অস্থিতিশীল একটা পরিস্থিতি তৈরি করতে চায়। যারা রাজনীতির নামে অপরাজনীতি করে এটি তাদের কাজ।
তিনি আরো বলেন, আমাদের সজাগ থাকতে হবে কেউ যেন কোন ভাবে দেশে অস্থিতিশীল পরিস্থিতি সৃষ্টি এবং ঘোলা পানিতে মাছ শিকারের অপচেষ্টা করতে না পারে। আমরা ঐক্যবদ্ধ থাকলে কোন অপশক্তি আমাদের এই সম্প্রীতি নষ্ট এবং মানুষের নিরাপত্তা ও আমাদের অগ্রযাত্রাকে বিঘ্নিত করতে পারবে না।
এসময় উপস্থিত ছিলেন জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ, পুলিশ সুপার মো. মিলন মাহমুদ, জেলা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি ডা. জে আর ওয়াদুদ টিপু, চাঁদপুর পৌরসভার মেয়র অ্যাড. জিল্লুর রহমান জুয়েল, হাজীগঞ্জের উপজেলা চেয়ারম্যান গাজী মাইনুদ্দিন, ফরিদগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান অ্যাড. জাহিদুল ইসলাম রোমান, হাজীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তার, জেলা আওয়ামী লীগের কোষাধ্যক্ষ রোটা. আহসান হাবিব অরুন, হাজীগঞ্জ উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ হেলাল উদ্দিন মিয়াজীসহ উপজেলা ও পৌর আওয়ামী লীগ, যুবলীগ, ছাত্রলীগসহ অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতৃবৃন্দ।
উল্লেখ্য, কুমিল্লা শহরের দিঘিরপাড়ের একটি দুর্গাপূজার মণ্ডপে হনুমান মূর্তির কোলে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বুধবার রাত আটটার দিকে হাজীগঞ্জে তৌহিদি জনতা একটি মিছিল হাজীগঞ্জ-রামগঞ্জ সড়কের দিক থেকে হাজীগঞ্জ বাজারে দিকে আসে।
পরবর্তীতে মিছিলটি বাজার হাজীগঞ্জ বাজার দুইবার প্রদক্ষিণ করে পশ্চিম বাজারস্থ রাজা লক্ষ্মী নারায়ন জিউর আখড়ায় অবস্থিত পূজামণ্ডপের সামনে আসলে মিছিল থেকে কে বা কারা পূজামণ্ডপের গেটের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারে। এতে ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ মিছিলকারীদের প্রতিরোধের চেষ্টা করলে পুলিশের উপর ইট-পাটকেল ছুড়ে মারে মিছিলকারীরা।
এসময় মিছিলকারীরা পুলিশের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালালে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সৃষ্টি হয় এবং পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়ে। এদিকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় এবং পুলিশের গুলিতে ৫ জন নিহত এবং ৪ জন আহত হয়। এছাড়া মিছিলকারীদের ইট-পাটকেলের আঘাতে ১৭ জন পুলিশসহ সাংবাদিক ও পথচারী আহত হয়েছেন।

২০ অক্টোবর, ২০২১।