মনিরুল ইসলাম মনির
শীতের আগমনীতে কাঁথা সেলাইয়ের কাজে ব্যস্ত থাকেন গ্রামাঞ্চলের কিশোরী ও গৃহবধূরা। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যে মিশে আছে প্রাচীন শিল্পকলার নিদর্শন এই সুচশিল্পটি। আমাদের সংস্কৃতি আর ঐতিহ্যের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িত নকশী কাঁথা। এ যেন এক লোকায়ত শিল্প নিদর্শনের মূর্তপ্রতিক। অনুপম শিল্প মাধুর্যের বাস্তব রুপ নকশী কাথাঁ। কিন্তু কালের বিবর্তনে এই শিল্পটি আজ বিলুপ্তির পথে। দেশের প্রায় সব অঞ্চল থেকে হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের নকশী কাঁথা শিল্পের ঐতিহ্য।
পুরাতন জীর্ণ বস্ত্রে প্রস্তুতকৃত রঙ-বেরঙ্গের সুতা দিয়ে সুনিপুন হাতে গড়া গ্রাম-বাংলার বধূ-কন্যাদের মনের মাধুরী মেশানো অনুভুতি দিয়ে নান্দনিক রুপ-রস ও বর্ণ-বৈচিত্রে ভরা এই নকশী কাঁথা। যে শিল্পে মুগ্ধ হয়ে পল্লীকবি জসীম উদ্দিন রচনা করেছেন তার অনবদ্য কাব্যগ্রন্থ ‘নকশী কাঁথার মাঠ’।
শুধু তাই নয়, এ শিল্পের সাথে নিবিড়ভাবে জড়িয়ে রয়েছে আমাদের আর্থ-সামাজিক কর্মকাণ্ড। কিন্তু বর্তমান সময়ে আধুনিকতার ছোঁয়ায় হাতের সেলাইয়ে গড়া এই নকশী কাঁথার ঐতিহ্য আজ প্রায় বিলুপ্তির পথে। বড় বড় কারখানায় তৈরীকৃত দেশী-বিদেশী রঙ-বেরঙ্গের রেডিমেট কাঁথা-কম্বলের ভীড়ে কোথায় যেন হারিয়ে যাচ্ছে আমাদের গ্রাম-বাংলার এই দেশীয় শিল্পটি।
একটা সময় দেখা যেত বিভিন্ন গ্রাম-গঞ্জের হাট-বাজার ও শহরের পাড়া-মহল্লার ওলিতে-গলিতে নানী-দাদী, খালা-ফুফু ও বধু-কন্যাদের হাতে তৈরী নানা রকমের ফুল-ফল, পশু-পাখি, গাছ-পালা ও প্রকৃতির ডিজাইনে গড়া নকশী কাঁথা সাইকেলের পিছনে বেঁধে অথবা ভার বয়ে সারাদিন ঘুরে ঘুরে বিক্রি করতেন শীত মৌসুমের ব্যাবসায়ীরা। কালের বিবর্তনে এসব আজকাল আর চোখেও পড়ে না।
একসময় এই হস্তশিল্প দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও ব্যাপক সুনাম কুড়িয়েছিল। বহিঃর্বিশ্বে তথা জাপান, আমেরিকা, ভারত, নেপাল, শ্রীলঙ্কা, সুইডেন, নরওয়ে, জর্মানী, ইতালীসহ বিভিন্ন দেশে এর চাহিদা ব্যাপক। কিন্তু আধুনিক যুগের ডিজিটাল বাংলাদেশে সময়ের ব্যবধানে রেডিমেটের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে সেসব ঐতিহ্য আজ বিলুপ্তির পথে।
অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড হিসেবে উৎপাদন, আয় বৃদ্ধি ও নতুন কর্ম-সংস্থান তৈরীর ক্ষেত্রে এ খাতের রয়েছে অমিত সম্ভাবনা। এ খাতকে আরো বিকোশিত ও প্রগতিশীল করার লক্ষ্যে সংশ্লিষ্ট কারু শিল্পীদের প্রতি বিশেষ নজর দেয়া প্রয়োজন। এজন্য সব সরকারি-বেসরকারি সংস্থা ও স্বেচ্ছাসেবী প্রতিষ্ঠানসমূহকে আন্তরিকতার মনোভাব নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
২২ ডিসেম্বর, ২০২০।