হাজীগঞ্জে খোর্দ্দ-জগন্নাথপুর সেতুর দুই পাশ থেকে বালু উত্তোলন

 উত্তোলনকৃত বালু দিয়ে প্রায় অর্ধ-শতাধিক পুকুর, নর্দমা ও ডোবা ভরাট
 এখনো ভরাট হচ্ছে একের পর এক জলাশয়
 দ্রুত ব্যবস্থাগ্রহণের দাবি সচেতন মহলের

মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলার সীমানাবর্তী ডাকাতিয়া নদীর উপর নির্মিত খোর্দ্দ ও জগন্নাথপুর সেতু হিসাবে পরিচিত গুলজার সেতুর দুই পাশ থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে। ডাকাতিয়া নদী খননের (ড্রেজিং) ড্রেজার দিয়ে গত দুই দিন ধরে টানা বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে নিয়মের কোনো তোয়াক্কা না করে বালু উত্তোলন করায় হুমকি ও ঝুঁকির মধ্যে পড়তে পারে এই সেতু।
বুধবার (২৫ মে) দুপুরে সরেজমিন পরিদর্শনে এর সত্যতা পাওয়া যায়। যা বালু ও মাটি ব্যবস্থাপনা আইন-২০১০ এর ৪নং ধারার ‘খ’ উপধারার স্পষ্ট লঙ্ঘন। উল্লেখ রয়েছে, সেতু, কালভার্ট, ড্যাম, ব্যারেজ, বাঁধ, সড়ক, মহাসড়ক, বন, রেললাইন ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ সরকারি ও বেসরকারি স্থাপনা হলে, অথবা আবাসিক এলাকা হইতে সর্বনিম্ন ১ (এক) কিলোমিটারের মধ্যে বালু উত্তোলন করা যাবে না।
অথচ সেতুর মাত্র ৫০-৬০ ফুটের মধ্য থেকে বালু উত্তোলন করা হচ্ছে। স্থানীয়রা জানান, মঙ্গলবার দিনব্যাপী ডাকাতিয়া নদীর খোর্দ্দ ও জগন্নাথপুর সেতুর (গুলজার সেতু) পূর্ব পাশ থেকে বালু উত্তোলন করা হয়। এরপর বুধবার সেতুর পশ্চিম পাশ থেকে বালু উত্তোলন শুরু করা হলে সংবাদকর্মীদের খবর দেন এলাকাবাসী। খবর পেয়ে সংবাদকর্মীরা ঘটনাস্থলে ছুটে গেলে বিষয়টির সত্যতা দেখতে পান।
এ বিষয়ে ডাকাতিয় নদী খনন (ড্রেজিং) কাজের ঠিকাদার মনতা কনস্ট্রাকশনের পরিচালক মাকসুদুর রহমানকে একাধিকবার ফোন দিলে তিনি ফোন রিসিভ করেননি এবং পরে ফোনও ব্যাক করেনি।
তবে এ সময় মুঠোফোনে কথা হয়, মনতা কনস্ট্রাকশনের ম্যানেজার মো. নাজমুল ইসলামের সাথে। তিনি এর সত্যতা স্বীকার করেন এবং সেতুর পাশ থেকে তাৎখনিক বালু উত্তোলন বন্ধের নির্দেশনা দেন।
এসময় তিনি বলেন, সেতুর ১২০ ফুট পর থেকে বালু উত্তোলন করা যায়। কিন্তু ড্রেজারের অপারেটর ভুল করে সেতুর কাছ থেকে বালু উত্তোলন করছেন। তাই তাৎখনিক বালু উত্তোলন বন্ধ করে তাকে (ড্রেজার অপারেট) সেতুর অন্তত দুইশ’ ফুট পর থেকে বালু উত্তোলনের নির্দেশনা দিয়েছে।
এদিকে উত্তোলনকৃত বালু দিয়ে হাজীগঞ্জের গন্ধর্ব্যপুর উত্তর ইউনিয়নসহ পাশর্^বর্তীয় শাহরাস্তি উপজেলার টামটা দক্ষিণ ইউনিয়নের বেশ কয়েকটি গ্রামে বালু দিয়ে অবাধে পুকুর, নর্দমা ও ডোবাসহ জলাশয় ভরাট করা হচ্ছে। ডাকাতিয়া নদী থেকে ড্রেজিংয়ের মাধ্যমে বালু উত্তোলন করে পাইপ দিয়ে ভরাট করা হচ্ছ্ েএসব পুকুর, নর্দমা ও ডোবাসহ ব্যক্তি পর্যায়ের এসব জলাশয়।
জানা গেছে, ডাকাতিয়া নদী ও নৌপথের নাব্য বাড়ানোর লক্ষ্যে ২০১৭ সালে তৎকালিন নৌ-পরিবহণমন্ত্রী শাহাজান খান হাজীগঞ্জ পৌরসভাধীন হাজীগঞ্জ ডিগ্রি কলেজ মাঠে ডাকাতিয়া নদী খনন কাজের উদ্বোধন করেন। এরপর থেকেই শুরু হয় নদী খননের (ড্রেজিং) বালু দিয়ে অপরিকল্পিতভাবে পুকুর ও ডোবাসহ জলাধার ভরাট।
ডাকাতিয়া নদীর হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলার যে অংশে ড্রেজিং হয়েছে এবং এখনো হচ্ছে, নদীর পাড় সংলগ্ন সেসব এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, ওইসব গ্রামের লোকজন তাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন পুকুর, নর্দমা ও ডোবাসহ জলাধারগুলো ভরাট করেছেন। এতে করে গত চার বছরে প্রায় অর্ধ-শতাধিক জলাশর ভরাট হয়েছে।
এই ভরাটের কাজ এখনো চলছে। বর্তমানে হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলার সংলগ্ন ডাকাতিয়া নদীর অংশে এই খনন কাজ চলছে। এতে করে হাজীগঞ্জের গন্ধর্ব্যপুর উত্তর ইউনিয়ন ও শাহরাস্তির টামটা দক্ষিণ ইউনিয়নের নদীর পাড় সংগলœ গ্রামগুলোর পুকুর, নর্দমা ও ডোবাসহ জলাশয়গুলো অবাধে ভরাট করা হচ্ছে।
দেখা গেছে, ডাকাতিয়া নদী থেকে বালু উত্তোলনে প্রশাসনের কোনো নজরদারি ও সমন্বয় নেই। ফলে সহজেই ভরাটের বালু পাওয়া যাচ্ছে। ড্রেজিংয়ের বালু পাইপের মাধ্যমে নদী থেকে পৌর এলাকা কিংবা ইউনিয়নের যে কোনো জায়গায় নেওয়া যাচ্ছে। রাতারাতি ভরাট হয়ে যাচ্ছে শতকের পর শতক জলাশয়।
যখন নদীর যে উপজেলায় অংশে ড্রেজিং হচ্ছে, সে উপজেলার রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় ও প্রভাবশালী মহলের আশীর্বাদপুষ্ট হয়ে স্থানীয় দুই একজনের মাধ্যমে টাকার বিনিময়ে ব্যক্তিগত পর্যায়ের এসব জলাশয় ভরাট করছেন লোকজন। এরকম কয়েকজনের সাথে কথা হলে, তারা কম টাকায় ভরাটের সুযোগ পাচ্ছেন বলে জানান। তবে উত্তোলনকৃত বালু বিক্রি করা যাবে বলে জানান, মনতা কনস্ট্রাকশনের ম্যানেজার মো. নাজমুল ইসলাম।
অথচ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন (২০১০ সালে সংশোধিত) অনুযায়ী বলা হয়েছে, যে কোনো ধরনের জলাধার বা পুকুর ভরাট সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ এবং ভরাটকারীর বিরুদ্ধে আইনের ৭ ধারায় প্রাকৃতিক বৈশিষ্ট্য ও জীববৈচিত্র নষ্ট করে পরিবেশগত ক্ষতি ও বিধ্বংসী কর্মকা-ের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণের বিধান রয়েছে।
এছাড়া জলাধার সংরক্ষণ আইন-২০০০ বলা হয়েছে, কোনো পুকুর-জলাশয়, নদী-খাল ইত্যাদি ভরাট করা বেআইনি। ওই আইনের ৫ ধারা মতে, জলাধার হিসেবে চিহ্নিত জায়গার শ্রেণিও পরিবর্তন করা যাবে না। কিন্তু এসব আইনের কোনো তোয়াক্কাই করছেন না পুকুর ভরাটকারীরা। এতে পরিবেশ ও জীব বৈচিত্রের ব্যাপক ক্ষতি হচ্ছে।
সচেতনমহল মনে করেন, এভাবে পুকুর ভরাট করা সম্পূর্ণ বেআইনি। তারা বলেন, নিজের পুকুর হলেও কোনো ব্যক্তি তা ভরাট করতে পারবে না। তাই দ্রুত এ ভরাট বন্ধ করা উচিত এবং আইনের যথাযথ প্রয়োগের মাধ্যমে ভরাটকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া উচিত। তা না হলে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখিন হতে হবে।
কারণ হিসাবে তারা বলেন, আমাদের এই জলাধারগুলো অতিরিক্ত বৃষ্টিপাতকে শোষণ করে এবং শুষ্ক মৌসুমের জন্য পানি সংরক্ষণ করে, যা জনসাধারণকে খরা বা অনাবৃষ্টির মতো বিপর্যয় থেকে রক্ষা করে। এছাড়াও এই জলাধারগুলো মাছের চাহিদা পূরণ এবং মৎস্যচাষীসহ বেকারদের আয়ের অন্যতম অবলম্বন। তাই, গ্রামাঞ্চলের এই জলাধারগুলো রক্ষায় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ ও প্রশাসন।
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. রাশেদুল ইসলাম জানান, বিষয়টি দেখছি।

২৬ মে, ২০২২।