চাঁদপুরে বাড়ছে রাজনৈতিক উত্তাপ

ইলশেপাড় রিপোর্ট
চাঁদপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনকে নিয়ে রাজনৈতিক উত্তাপ প্রতিনিয়তই বৃদ্ধি পাচ্ছে। এমন উত্তাপ সরকার সমর্থিত নেতাকর্মীদের মাঝে কম-বেশি লক্ষ্য করা গেছে। দলটির কর্মী-সমর্থকরা তাদের প্রার্থীকে ভোটের মাঠে রাখতে না পারায় অনেকটা হতাশা প্রকাশ করছে। এমন পরিস্থিতিতে জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান পদটিতে প্রার্থী হিসেবে কাকে চূড়ান্ত বিজয়ী করা যায় তা নিয়েই এখন বিশ্লেষণ চলছে।
মাঠ পর্যায়ে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নির্বাচনের মাঠে টিকে থাকা দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রশাসক আলহাজ ওচমান গণি পাটওয়ারী ও প্রবাসী ব্যবসায়ী মো. জাকির হোসেন প্রধানীয়া উভয়ই আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের কাছে সমর্থনের জন্য দৌড়ঝাঁপ করেছেন। এতে সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রশাসক ওচমান গণি পাটওয়ারী।
তবে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক আওয়ামী লীগের কেউ কেউ বলছেন, প্রবাসী ব্যবসায়ী মো. জাকির হোসেন প্রধানীয়াকেও স্থানীয় এমপিরা সমর্থন দিয়েছে। এমন গুঞ্জনের সত্যতা পাওয়া না গেলেও ওচমান গণি পাটওয়ারী মতলব উত্তর ও দক্ষিণ উপজেলায় আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন মায়া চৌধুরী বীরবিক্রমের মাধ্যমে আওয়ামী লীগের সমর্থন আদায় করতে সমর্থন হয়েছেন। যা ইতোমধ্যে গণম্যাধ্যমে প্রকাশিত হয়েছে।
অপরদিকে সরকার সমর্থিত আওয়ামী লীগ মনোনীত প্রার্থী মো. ইউসুফ গাজীর মনোনয়নপত্র বাতিলে দলটির নীতিনির্ধারণী পর্যায়ে সিদ্ধান্ত মোতাবেক ভোটের মাঠে শেষ পর্যন্ত টিকে থাকতে দলীয় প্রার্থীকে খুলনার আদালতে আত্মসমর্পণ করান এবং উচ্চ আদালতের মাধ্যমে প্রার্থীতা বহাল রাখার চেষ্টা করেন। তবে আদালত আওয়ামী লীগ প্রার্থী মো. ইউসুফ গাজীর সাজা স্থগিত না করায় তিনি শেষ পর্যন্ত নির্বাচনের অযোগ্য হয়ে যান।
ভোটের মাঠে মো. ইউসুফ গাজী আছেন- এমন পরস্পর বিরোধী বক্তব্য জেলার রাজনীতির মাঠে ছড়িয়ে দেন তার সমর্থকরা। তারা দাবি করেন, উচ্চ আদালত চাঁদপুরসহ আরো একটি জেলা নির্বাচন স্থগিত করছেন। তবে জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা গণমাধ্যমকে এমন স্থগিতের কথা উড়িয়ে দিলে দুই স্বতন্ত্র চেয়ারম্যান প্রার্থী ভোটের মাঠে দৌড়ঝাঁপ শুরু করে দেন।
এদিকে জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রশাসক এবং বর্ষিয়ান রাজনীতিবিদ আলহাজ ওচমান গণি পাটওয়ারী বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং সড়ক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদেরের মাধ্যমে জেলা রিটার্নিং কর্মকর্তা ও জেলা প্রশাসককে টেলিফোনে নিশ্চিত করতে সক্ষম হন চাঁদপুরের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের কোন প্রার্থী নেই। এমন সংবাদে মো. ইউসুফ গাজীর সমর্থকরা অনেকটাই নিষ্ক্রিয় হয়ে পরেন।
বর্তমানে ভোটের সমীকরণ ও রাজনৈতিক মেরুকরণে জেলা পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রশাসক আলহাজ ওচমান গণি পাটওয়ারী সুবিধাজনক অবস্থানে আছেন বলে ভোটাররা বলছে। ভোটারদের দাবি, এই প্রার্থী দীর্ঘদিন জেলা আওয়ামী লীগের গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করায় জনপ্রতিনিধিদের কাছে তার ব্যক্তিগ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয়ে আছে। পাশাপাশি জেলা আওয়ামী লীগের একাংশের সমর্থন নিয়ে গত নির্বাচনেও তিনি স্বতন্ত্রভাবে চেয়ারম্যান নির্বাচিত হয়ে দায়িত্ব পালন করেছেন। পরবর্তীতে প্রধানমন্ত্রী তার উপর আস্থা রেখে ফের প্রশাসকের দায়িত্ব দেন।
অপরদিকে প্রবাসী ব্যবসায়ী মো. জাকির হোসেন প্রধানীয়া ভোটের মাঠে জানান দিতে সরকার সমর্থিত জনপ্রতিনিধিদের লিয়াজো করার শেষ চেষ্টা অব্যাহত রাখছেন। তবে চাউর আছে এই প্রার্থীর আর্থিক সামর্থ ভোটের ফলাফলে কম-বেশি প্রভাব ফেলতে পারে। যা জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে কম-বেশি আলোচনা-সমালোচনা চলছে বলে রাজনৈতিক মহল জানিয়েছে।
তবে আগামি ১৭ অক্টোবর এ নির্বাচনকে নিয়ে দেশের রাজনৈতিক বিরোধীদল বিএনপি নির্বাচন বর্জন করলেও স্থানীয় পর্যায়ে নির্বাচনকে পর্যবেক্ষণে রাখছে দলটি। আওয়ামী লীগের প্রার্থী নির্বাচনে অযোগ্য হওয়ায় দলটির সমর্থকদের মাঝে তা নিয়ে বিব্রতকর পরিস্থিতির পরিবেশ তৈরি হয়। তবে পরিস্থিতি হতে দ্রুত উত্তরণের জন্য জেলা আওয়ামী লীগ নির্বাচন নিয়ে কোন মন্তব্য করছে না। এখন দর্শক হিসেবে নির্বাচন পর্যবেক্ষণ করছে।
তবে এই নির্বাচনকে ঘিরে জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে চাউর আছে, ভোটের সমীকরণের কারণে প্রার্থীরা অনেকেই আর্থিক সঙ্কটে পরবেন। কেবলমাত্র জনপ্রতিনিধিরা ভোটার হওয়ায় এবং নির্বাচনের মাঠে সদস্য সংখ্যা কমে যাওয়ায় জয়-পরাজয় নির্ধারণে টাকাই ফ্যক্টর হবে বলে রাজনৈতিক নেতারা মন্তব্য করছেন।
তবে আগামি ১৭ অক্টোবর নির্বাচনে স্বতন্ত্র দুই চেয়ারম্যান প্রার্থী যে তুমুল লড়াইয়ের মুখোমখি হচ্ছেন তা জেলার রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনা চলছে। তবে এই নির্বাচনকে আওয়ামী লীগের একটি অংশ খরগোশ-কচ্ছপের লড়াইয়ের সাথে তুলনা করছেন। তারা দাবি করছেন, নির্বাচন শেষে চূড়ান্ত ফলাফলে তাদের মন্তব্যই সঠিক হবে।
চাঁদপুর জেলা নির্বাচন অফিস জানিয়েছে, জেলা পরিষদ নির্বাচনটি ইভিএম (ইলেক্টনিক্স ভোটিং মেশিন) এ। নির্বাচনে মোট ভোটার ১ হাজার ২শ’ ৭৩ জন। এরমধ্যে পুরুষ ৯শ’ ৭৪ জন ও নারী ২শ’ ৯৯ জন। উপজেলাভিত্তিক চাঁদপুর সদরে ২শ’ ৬ জন, হাইমচরে ৮০ জন, ফরিদগঞ্জে ২শ’ ১১ জন, মতলব দক্ষিণে ৯৪ জন, মতলব উত্তরে ১শ’৮৪ জন, কচুয়ায় ১শ’ ৭২ জন, হাজীগঞ্জে ১শ’ ৭৬ জন এবং শাহরাস্তি উপজেলায় ১শ’ ৫০ জন ভোটার।
রিটারিং কর্মকর্তার অফিস সূত্রে জানা গেছে, ইতোপূর্বে জেলা পরিষদ নির্বাচনে চেয়ারম্যান, সাধারণ সদস্য ১৫ জন ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য ৫ জনসহ মোট ২১ জন প্রার্থী নির্বাচিত হতো। এবারের নির্বাচনে চেয়ারম্যান ১ জন, সাধারণ সদস্য ৮ জন ও সংরক্ষিত মহিলা সদস্য ৩ জনসহ মোট ১২ জন প্রার্থী নির্বাচিত হবেন। নির্বাচনে রিটারিং কর্মকর্তার দায়িত্ব পালন করবেন জেলা প্রশাসক। সহকারী রিটানিং কর্মকর্তার দায়িত্ব থাকছেন জেলা নির্বাচন কর্মকর্তা।
এবারের নির্বাচনে ৮ জন সাধারণ সদস্যর পাশাপাশি সংরক্ষিত মহিলা সদস্য ৩ জনের ওয়ার্ড হচ্ছে ওয়ার্ড-১ চাঁদপুর সদর, হাইমচর ও ফরিদগঞ্জ। ওয়ার্ড-২ মতলব দক্ষিণ, মতলব উত্তর ও কচুয়া এবং ওয়ার্ড-৩ হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি উপজেলা। জেলার ৮ কেন্দ্রের মোট ১৬টি বুথে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হবে।
জানা যায়, এবারের চাঁদপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনে মোট মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন চেয়ারম্যান পদে ৭ জনসহ মোট ৭৩ জন। আর দাখিল করেন চেয়ারম্যান পদে ৬ জনসহ মোট ৫৮ জন। ১৫ জন প্রার্থী মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করলেও তা দাখিল করেন নি। বাছাইয়ে ১ চেয়ারম্যান, ৩ জন সাধারণ সদস্য ও ১ জন সংরক্ষিত মহিলা সদস্যসহ মোট ৫ জন বাতিল হয়। আর ৫ জন চেয়ারম্যান, ৩৬ জন সাধারণ সদস্য ও ১২ জন সংরক্ষিত মহিলা সদস্য যাচাই-বাছাইয়ে বৈধ হয়। বাছাইয়ে বাতিল হওয়ার পর আওয়ামী লীগের প্রার্থী মো. ইউসুফ গাজী, সাধারণ সদস্য প্রার্থী বাদল ফরাজী ও ফরহাদ খান প্রার্থীতা ফিরে পেতে বাছাইয়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন। ২১ সেপ্টেম্বর বাছাই সংক্রান্ত আপিলের শুনানী শেষে রাতে আপিল কর্মকর্তা চট্টগ্রাম বিভাগের অতিরিক্ত বিভাগীয় কমিশনার (রাজস্ব) ও জেলা পরিষদ নির্বাচনের আপিল কর্তৃপক্ষ ড. প্রকাশ কান্তি চৌধুরী স্বাক্ষরিত চিঠিতে প্রার্থীদের আপিল নামঞ্জুর ও মঞ্জুরের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়েছে। স্বাক্ষরিত পত্রে চাঁদপুর জেলা পরিষদ নির্বাচনের চেয়ারম্যান প্রার্থী ইউসুফ গাজীর মনোনয়নপত্র চূড়ান্তভাবে বাতিল করে মনোনয়ন নামঞ্জুর ঘোষণা করেন। একই সাথে ৪নং ওয়ার্ডের সদস্য প্রার্থী যথাক্রমে বাদল ফরাজীর আপিল মঞ্জুর ও মো. ফরহাদ হোসেনের আপিল নামঞ্জুর করা হয়েছে। ২৫ সেপ্টেম্বর মনোনয়নপত্র প্রত্যাহার করেন চেয়ারম্যান পদে এমএ ওয়াদুদ, তাফাজ্জল হোসেন এসডু পাটওয়ারী ও নাছির উদ্দিন। সাধারণ সদস্য পদে আবুল খায়ের ও জামাল হোসেন প্রার্থীতা প্রত্যাহার করেন। চেয়ারম্যান পদে চাঁদপুর জেলা পরিষদ সাবেক চেয়ারম্যান ও প্রশাসক আলহাজ ওচমান গনি পাটওয়ারী (মোবাইল) প্রতিক ও প্রবাসী জাকির হোসেন প্রধানিয়া (আনারস) প্রতিক নিয়ে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
সাধারণ সদস্য পদে ১নং ওয়ার্ড (চাঁদপুর সদর উপজেলা) থেকে মো. মুকবুল হোসেন মিজি (টিউবওয়েল), আবুল বারাকাত লিজন পাটওয়ারী (ঘুড়ি), মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান মানিক (হাতি), জাকির হোসেন হিরু (বৈদ্যুতিক পাখা), মো. শাহ আলম খান (তালা), মো. ইকবাল হোসেন পলাশ পাটওয়ারী (অটোরিক্সা), মো. মাহবুবুর রহমান (উট পাখি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ২নং ওয়ার্ড (হাইমচর উপজেলা) থেকে খোরশেদ আলম (তালা) ও এসএম কবির (টিউবওয়েল) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৩নং ওয়ার্ড (ফরিদগঞ্জ উপজেলা) থেকে মশিউর রহমান মিঠু (তালা), মো. শাহাবুদ্দিন হোসেন (হাতি), মো. মিজানুর রহমান ভূইয়া (ঘুড়ি), আলী আক্কাস (টিউবওয়েল) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৪নং ওয়ার্ড (মতলব দক্ষিণ উপজেলা) থেকে সাবেক জেলা পরিষদ সদস্য মো. আল-আমিন ফরাজী (হাতি), জসিম উদ্দিন (টিউবওয়েল), মো. রিয়াদুল আলম (তালা), বাদল ফরাজী (উটপাখি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৫নং ওয়ার্ড (মতলব উত্তর উপজেলা) থেকে মো. আলাউদ্দিন সরকার (তালা), মিনহাজ উদ্দিন খান (হাতি), মো. হাবিবুর রহমান (বৈদ্যুতিক পাখা), আব্দুল্লাহ মোহাম্মদ ইসা (টিউবওয়েল) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৬নং ওয়ার্ড (কচুয়া উপজেলা) থেকে জোবায়ের হোসেন (হাতি), তৌহিদ ইসলাম (টিউবওয়েল), বিল্লাল হোসেন (বৈদ্যুতিক পাখা), আহসান হাবিব প্রাঞ্জল (তালা), মো. সালাউদ্দিন (অটোরিক্সা), শামসুল হক (উটপাখি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। ৭নং ওয়ার্ড (হাজীগঞ্জ উপজেলা) থেকে মো. জসিম উদ্দিন (তালা), মো. বিল্লাল হোসেন (টিউবওয়েল) ও আ. রব মিয়া (হাতি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন এবং ৮নং ওয়ার্ড (শাহরাস্তি উপজেলা) থেকে মাহবুব আলম (বৈদ্যুতিক পাখা), মো. জাকির হোসেন (ক্রিকেট ব্যাট), মো. মনির হোসেন (টিউবওয়েল), মো. বিল্লাল হোসেন (অটোরিক্সা), মো. ইব্রাহিম খলিল পন্ডিত (তালা) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।
এছাড়া সংরক্ষিত মহিলা সদস্য প্রার্থী হিসাবে ১নং ওয়ার্ড (সদর, ফরিদগঞ্জ, হাইমচর) থেকে আয়শা রহমান (দোয়াত কলম), জোবেদা মজুমদার খুশি (ফুটবল); ২নং ওয়ার্ড (মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিন, কচুয়া) থেকে শামছুন নাহার (দেওয়াল ঘড়ি), নাজমা আক্তার আখি (দোয়াত কলম), রোকেয়া বেগম (বই), তাছলিমা আক্তার (ফুটবল) ও রওনক আরা (টেলিফোন) এবং ৩নং ওয়ার্ড (হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি) থেকে জান্নাতুল ফেরদৌসী (ফুটবল), মুক্তা আক্তার (দোয়াত কলম), রুবি আক্তার (বই), ছকিনা বেগম (মাইক), শিউলি আক্তার (হরিণ) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন।

১২ অক্টোবর, ২০২২।