ইল্শেপাড় রিপোর্ট
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের যৌথ গবেষণায় উদ্ভাবিত ‘ইলিশ ক্র্যাকারস’ দেশে নতুন একটি মৎস্যপণ্য। যা স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় একটি পুষ্টিকর ও স্বাস্থ্যসম্মত রুচিকর খাদ্য হিসেবে বিবেচিত। সংশ্লিষ্টদের গবেষণায় ইলিশ ক্র্যাকারস মা ও শিশুর স্বাস্থ্য রক্ষায় পুষ্টি সরবরাহে করে বলে জানা যায়।
সংশ্লিষ্টরা আশাবাদী ইলিশ ক্র্যাকারস অভ্যন্তরীণ বাজার ও রপ্তানি বাজার সৃষ্টি করতে পারলে তা জাতীয় অর্থনীতিতে তারা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারবে। এই পণ্যটি দেশে ইলিশ মাছের সুষম ব্যবহার নিশ্চিত করতে পারবে। যা সব শ্রেণি-পেশার খাদ্য তালিকায় স্থান করে নিতে পারে। সাথে সাথে উৎপাদনকারীদের নিজস্ব আয়সহ ব্যপক কর্মসংস্থান সৃষ্টির সুযোগ রয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলছে, কয়েক বছর আগে তারা আনুষ্ঠানিকভাবে মৎস্যপণ্য হিসেবে বাজারজাত করার উপযোগী বলে ঘোষণা দেন। এখন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা কিংবা দেশীয় বহুজাতীয় কোন প্রতিষ্ঠান চাইলে ইলিশ মাছের ইলিশ ক্র্যাকারস বাজারজাত করতে পারে।
মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউট, চাঁদপুর নদীকেন্দ্রের সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ইলিশ ক্র্যাকারস তৈরিতে লাগে ইলিশ কিমা, ট্যাপি ও কর্নফ্লাওয়ার, চিনি, লবণ, বেকিং ছোডা ও বরফ কুচি। এই উপাদানগুলো ব্যবহার করেই স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয় ইলিশ খাদ্যমানের ইলিশ ক্র্যাকারস তৈরি করা যায়।
তারা বলছেন, তৈরিকৃত ইলিশ ক্র্যাকারসে রয়েছে, অত্যন্ত সমৃদ্ধ উচ্চমাত্রায় আমিষ ও ৯ ধরনের অত্যাবশ্যকীয় অ্যামাইনো অ্যাসিড, লিপিড বা চর্বি ও খনিজ পদার্থ। বিশেষ করে অপরিহার্য উচ্চমাত্রায় অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিড যা আমাদের মানব স্বাস্থ্যের জন্য খুবই উপকারী। এই অসম্পৃক্ত ফ্যাটি অ্যাসিডের শতকরা ২ ভাগ ওমেগা-৩ ফ্যাটি অ্যাসিড যা মানুষের দেহে রক্তের কোলেস্টারল কমাতে সহায়তা করে থাকে। এছাড়া ইলিশের তেলে উচ্চমাত্রায় ভিটামিন এ, ডি এবং স্বল্পমাত্রায় ভিটামিন-বি রয়েছে। যার কারণে এই পণ্য একটি রুচিকর ও আকর্ষণীয় খাদ্য হিসেবে বিবেচনা করা যায়।
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা ইনস্টিটিউটের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তারা বলছেন, বর্তমান বাজারে ইলিশ ক্র্যাকারস মূল্য সংযোজিত মৎস্যপণ্যের গুরুত্ব রয়েছে ব্যাপক। যা সহজেই রান্না ছাড়া নিরাপদে খাওয়া যায়। প্যাকেটজাত মৎস্যপণ্য এমনভাবে স্বাস্থ্যসম্মত উপায়ে তৈরি করা হয় যাতে তৈরিকৃত পণ্যের মাঝে কোন ক্ষতিকর পদার্থ বা জীবাণু থাকে না এবং পণ্যের মেয়াদকালেও কোন ক্ষতিকর জীবাণু জন্মও না নেয়।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ক্ষুদ্র কিংবা মাঝারী মানের প্রতিষ্ঠানের যে কোন উদ্যোক্তা চাইলে তা এই নিয়মে ইলিস ক্র্যাকারস প্রস্তুত করতে পারে। প্রথমে তারা বাটিতে ৮৫ গ্রাম ইলিশ মাছের কিমা নিয়ে তার সাথে অন্যান্য উপাদান ও অর্ধেক পরিমাণ বরফ কুচি নিয়ে সবগুলি উপাদান দিয়ে ভালোভাবে মেশাতে হবে। এরপর বাকি বরফকুচি দিয়ে ভালোভাবে মিশিয়ে খামি তৈরি করে চারভাগের একভাগ খামি একটি চপিং/কাটিং বোর্ডে নিয়ে ট্যাপি ও কর্নফ্লাওয়ার দিয়ে বেলে রোল তৈরি করবে।
তারপর এই রোলগুলো একটি পাত্রে নিয়ে র্যাপিং পেপার দিয়ে মুড়িয়ে রেফ্রিজারেটরে (৪০ সে.) প্রায় ১২-১৮ ঘণ্টা রাখার পর রোলগুলি ধারালো ছুরি দিয়ে ২ মিমি পুরুত্বে পাতলা করে কাটতে হবে। তারপর ওভেনে ৫০০ সে. তাপমাত্রায় ১০-১২ ঘণ্টা শুকাতে হবে যাতে পানির পরিমাণ ১০-১২% এর মধ্যে বা তার নিচে থাকে। এই শুকনা ক্র্যাকারসকে তাৎক্ষণিক ভাজার উপযুক্ত হিসেবে সংরক্ষণ করতে হবে। শুকনা ক্র্যাকারসকে ১৮০-২০০০ সে. তাপমাত্রায় ভেজিটেবল তেলে ভাজতে হবে।
এভাবে চাইলে যে কেউ মচমচে ইলিশ ক্র্যাকারস তৈরি করতে পারে বাসা-বাড়িতে এবং তা তাৎক্ষণিক খাওয়ার জন্য উপযুক্ত। আবার চাইলে প্যাকেটজাত করে সংরক্ষণ করেও তা বাজারজাত করে আর্থিকভাবে লাভবান হতে পারে।
তারা বলছেন, উদ্যোক্তারা চাইলে ইলিশ ক্র্যাকারস সংরক্ষণ করতে পারে। এজন্য গবেষণায় ইলিশ ক্র্যাকারসের জন্য সংরক্ষণের তিনটি প্যাকেজিং পরীক্ষা করা হয়েছে। প্রতিটি প্যাকেজিং পদ্ধতিতে গবেষণাগারে রাসায়নিক ও জীবাণু সংক্রান্ত পরীক্ষায় দেখা যায় ৬ মাস পর্যন্ত গুণাগুণ অক্ষুণ্ন থাকে।
বাংলাদেশ মৎস্য গবেষণা ইনষ্টিটিউট (বিএফআরআই) এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের যৌথ গবেষণার প্রধান ও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিশারিজ বিভাগের অধ্যাপক ড. মো. তারিকুল ইসলাম ইল্শেপাড়কে জানান, মাছের ক্র্যাকারস বিশে^র অনেক দেশে পাওয়া গেলেও আমাদের দেশে ব্যয়বহুল হওয়ায় তা সাধারণের নাগালের মধ্যে আসেনি। এ কারণে ইলিশ মাছের ক্র্যাকারস নিয়ে ইতোপূর্বে আমরা গবেষণা করে তা সফল হই। যা দেশের সমুদ্র উপকূলীয় এলাকার সুটকির দোকানে কম বেশি পাওয়া যায়। এছাড়া অনলাইনে দেশের বিভিন্ন উদ্যোক্তারা বিক্রি করে আসছে।
তবে এই অধ্যাপক অনেকটা আক্ষেপ করেই জানান, দেশের বড় কোন শিল্প প্রতিষ্ঠান এগিয়ে না আসায় সেভাবে তা বাজারজাত হচ্ছে না। তবে বগুড়ার মাঝারি মানের একটি শিল্প প্রতিষ্ঠান ইলিশ ক্র্যাকারস বাজারজাত করার জন্য কাজ শুরু করে দিয়েছে। তার মতে কেবল একক ইলিশ মাছের ইলিশ ক্র্যাকারস তৈরি করলে দাম তুলনামূলক বেশি হতে পারে। বড় শিল্প উদ্যোক্তারা বাজারজাত করলে হয়তো তা অনেকাংশে কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
অধ্যাপক ড. মো. তারিকুল ইসলাম ইল্শেপাড়কে আরো জানান, বাংলাদেশ এগ্রিকালসার রিসার্স কাউন্সিল (বিএআরসি) ইলিশ ক্র্যাকারস বা মৎস্যপণ্যের পদ্ধতিটাকে টেকনোলজি হিসেবে নেয়। কিন্তু এই উদ্যোগকে টেকনোলজি হিসেবে নিলেই হবে না তা ভেরিফিকেশন প্রয়োজন হয়। তবে বিএআরসি’র গাজীপুর ল্যাবে তা উদ্যোক্তাদের নিয়ে ইলিশ ক্র্যাকারস তৈরি করে এবং সফল হয়। পরবর্তীতে তারা স্থানীয় পর্যায়ে তা বিভিন্ন মেলায় তা বাজারজাত করে। বর্তমানে তা টেকনোলজি হিসেবে যোগ্য এবং বাজারজাত করতে কোন সমস্যা নেই বলে জানান এই গবেষক ও অধ্যাপক।
০১ মার্চ, ২০২৪।