চাঁদপুরে বিদ্যুৎ সাশ্রয়ে ‘বাঁধা’ আটোরিক্সা

 জেলায় প্রায় ৬০ হাজার অটোরিক্সা
 ১টি চার্জ দিতে বিদ্যুৎ লাগে ১০-১৩ ইউনিট
 চার্জ দিতে বিদ্যুৎ লাগবে ৬০০ মেগাওয়াট

এস এম সোহেল
অবৈধ ঘোষণা দিয়ে বার-বার বন্ধের উদ্যোগ নিলেও চাঁদপুরের বিভিন্ন এলাকা দাপিয়ে বেড়াচ্ছে ব্যাটারিচালিত অটো ও রিকশা। সাধারণ প্যাডেলচালিত রিকশার মতো দেখতে হলেও সিটের নিচে ব্যাটারি ও চেইনের সঙ্গে মোটর সংযুক্ত করে চলছে অলিগলিতে। একদিকে এসব রিকশার বেপরোয়া গতির কারণে যেমন হরহামেশা দুর্ঘটনা ঘটছে, তেমনি অবৈধ লাইনে ব্যাটারি চার্জ দিতে গিয়ে অপচয় হচ্ছে বিদ্যুতের। আবার বিদ্যুতের ক্রাইসিস মুহূর্তে এগুলো বন্ধ রাখাও উচিত মনে করেন সচেতন মহল।
সামাজিক বিভিন্ন অব্যবস্থাপনার কারণেই এসব বন্ধ করা সম্ভব হয় না। জেলার বিভিন্ন পৌরসভার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের যদি এসব নিয়ে সঠিক পরিকল্পনা থাকতো, তবে এত বিস্তার ঘটতো না। বৈশ্বিক সংকটে বিদ্যুৎ ব্যাটারিচালিত অটো ও রিকশার বিরুদ্ধে পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন।
বিদ্যুতের এই সংকটের মুহূর্তে আবারও আলোচনায় আসে ব্যাটারিচালিত রিকশা। এর আগে ২০২১ সালের মাঝামাঝি ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ ঘোষণা করে সরকার। হাইকোর্টের পক্ষ থেকেও বন্ধের নির্দেশনা আসে। তবে ব্যাটারিচালিত রিকশাকে পরিবেশবান্ধব ও সাশ্রয়ী দাবি করে বন্ধের বিপক্ষে দাঁড়ায় বেশ কিছু সংগঠন।
গতকাল বুধবার কালীবাড়ি এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, কালাম নামে এক কিশোর ব্যাটারিচালিত রিকশাচালক যাত্রী ডাকাডাকি করছে। বয়স ১৪ নাকি ১৫। তবে রিকশা পার্কিং আর ডাকাডাকিতে অন্যান্য রিকশাচালকের চেয়ে কোনো অংশেই কম যায় না।
জানতে চাইলে কালাম জানায়, অটোরিক্সাটি তার বাবার হলেও বেশিরভাগ সময় সে নিজেই চালায়। বড়স্টেশন এলাকায় একটি গ্যারেজে রাতে ব্যাটারি চার্জ দেয়। এক রাতে ৪ ব্যাটারি চার্জ দিতে ১৬০ টাকা গুণতে হয়।
পুরাণবাজার এলাকায় গিয়ে দেখা যায়, বেশ কয়েকটি রিকশার গ্যারেজ রয়েছে ওই এলাকায়। মূলত প্যাডেলচালিত রিকশার গ্যারেজে লাইট জ্বালানোর জন্য বিদ্যুতের লাইন নিয়েছেন তারা। কিন্তু একই গ্যারেজে লাইটের লাইন থেকে বাড়তি লাইন নিয়ে চার্জ দেওয়া হচ্ছে ব্যাটারিচালিত রিকশা।
চাঁদপুর জেলার ৮ উপজেলার তথ্যমতে- চাঁদপুর পৌরসভায় ২০২৩ সাল পর্যন্ত ২৬২৭টি আটোরিক্সা ও ১ হাজারটি রিকশার লাইসেন্স দেওয়া হয়েছে। চাঁদপুর পৌরসভা কর্তৃক দেওয়া লাইসেন্সের থেকে ৫ গুণ আটোরিক্সা চলাচল করে। আর পায়ে (প্যাডেলচালিত) হাজার রিকশা লাইসেন্স দিলেও তা, পায়ে না চালিয়ে সিটের নিচে ব্যাটারি সংযুক্ত করে তা চালানো হয়ে। পৌর এলাকায় অন্তঃত ৩-৫ হাজার ব্যাটারি সংযুক্ত রিকশা চলাচল করছে।
এছাড়া চাঁদপুর সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে অনুমানিক ৫ হাজার আটো ও রিকশা চলাচল করছে। চাঁদপুর পৌর এলাকা ও সদর উপজেলার ১৪টি ইউনিয়নে প্রায় ২০ হাজারের বেশি অটো ও রিকশা চলাচল করছে।
মতলব উত্তর উপজেলায় কোন অটো ও রিকশা লাইসেন্সের আওতায় এখনো আনা হয়নি। তবে এ উপজেলায় এখন আর কোন রিক্সা চলাচল করে না। তবে ব্যাঙের ছাতার মতো দিন দিন ব্যাটারিচালিত অটো বেড়েই চলছে। ধারণা করা হচ্ছে মতলব উত্তর উপজেলায় অন্তঃত ১০-১৫ হাজার ব্যাটারিচালিত অটো চলাচল করছে।
মতলব দক্ষিণ উপজেলার পৌরসভায় ১৫০টি অটো লাইসেন্সের আওতায় আনা হলেও চলাচল করে অন্তঃত ১০ হাজার অটো ও রিকশা। হাজীগঞ্জ পৌরসভায় ৫২৯টি অটো লাইসেন্সের আওতায় আনা হলেও পুরো উপজেলায় বৈধ ও অবৈধভাবে চলাচল করে অন্তঃত ২ হাজারের বেশি অটো ও রিকশা।
শাহরাস্তি পৌরসভায় ২৫০টি অটো লাইসেন্সের আওতায় আনা হলেও চলাচল করে অন্তঃত ১০০০ থেকে ১৫শ’ অটো ও রিকশা।
হাইমচর উপজেলায় কোন অটো ও রিকশা লাইসেন্সের আওতায় এখনো আনা হয়নি। তবে এ উপজেলায় তেমন রিক্সা না থাকলেও ব্যাটারিচালিত অটো চলাচল করে অন্তঃত ২-৩ হাজার। কচুয়া উপজেলার পৌরসভায় কিছু অটো লাইসেন্সের আওতায় আনা হলেও অবৈধভাবে চলাচল করে অন্তঃত ৫ হাজারের বেশি অটো ও রিকশা।
ফরিদগঞ্জ পৌরসভায় কয়েকশ’ অটো লাইসেন্সের আওতায় আনা হলেও অবৈধভাবে চলাচল করে অন্তঃত ৪ হাজারের বেশি অটো ও রিকশা।
চাঁদপুর পৌরসভা ও জেলার সব উপজেলার তথ্য অনুযায়ী অনুমানিক ৪ হাজার আটো ও রিকশার লাইসেন্সের আওতায় আনা হয়। পুরো জেলায় আটো ও রিকশার চলাচল করে আনুমানিক ৬০ হাজার।
বিদ্যুৎ অফিস, অটো ও রিকশা গ্যারেজ সূত্রে জানা যায়, একটি অটো পুরো চার্জ হতে সময় লাগে ৮ ঘণ্টা। একটি নতুন অটোরিক্সা চার্জ দিতে বিদ্যুৎ খরচ হয় ৯ থেকে ১০ ইউনিট। অটোরিক্সা যখন কয়েক মাস পুরোনো হয়ে যায় তখন চার্জ দিলে বিদ্যুৎ খরচ হয় ১০-১৩ ইউনিট। তাহলে পুরো জেলায় অনুমানিক আটো ও রিকশার চলাচল করে আনুমানিক ৬০ হাজার। ১০ ইউনিট করে ধরলেও ৬০ হাজার অটোরিক্সা চার্জ দিতে বিদ্যুৎ লাগবে প্রায় ৬ লাখ ইউনিট। ১০০০ ইউনিটে ১ মেগাওয়াট হলে চাঁদপুর জেলায় অটোরিক্সা চার্জ দিতে বিদ্যুৎ লাগবে ৬০০ মেগাওয়াট।
আর জেলায় যদি বৈধ ৪,০০০ অটোরিক্সা থাকে তাহলে ১০ ইউনিট করে খরচ হলে লাগবে ৪০ হাজার ইউনিট বিদ্যুৎ। ১০০০ ইউনিটে ১ মেগাওয়াট হলে বৈধ ৪০০০ অটোর জন্য ৪০ মেগাওয়াট লাগবে। অথচ, পুরো জেলায় বাসা-বাড়ি ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ও অফিস-আদালতের জন্য বিদ্যুৎ লাগে ৪৫-৫০ মেগাওয়াট।
সচেতনমহল মনে করেন, পুরো চাঁদপুর জেলার ৮টি উপজেলায় ব্যাটারিচালিত অটো ও রিকশা কত চলাচল করে তার সঠিক হিসেব নেই। তবে আনুমানিক প্রায় অর্ধ লক্ষাধিক ব্যাটারিচালিত অটো ও রিকশা চলাচল করে মূল সড়কসহ অলিতে-গলিতে। একটা রিকশা রাতে চার্জ দিলে সারা-দিন চলে। এতে যে পরিমাণ বিদ্যুৎ খরচ হয়, একটি এসি এক ঘণ্টা চালাতে সেই পরিমাণ বিদ্যুৎ লাগে।
তারা আরো বলেন, রাস্তা-মহল্লা অটোরিকশায় সয়লাব। ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করা দরকার। কিন্তু রিকশার মতোই দেখতে ব্যাটারিচালিত রিকশা বন্ধ করা উচিত। সংকটকাল, সবারই বিদ্যুৎ প্রয়োজন। একেকটা অটোরিকশায় চারটি করে ব্যাটারি থাকে। সারাদিন চালানোর পর এগুলো সারারাত চার্জে রাখা হয়। এসব অটোরিকশা বিদ্যুৎবিধ্বংসী। এতে প্রচুর বিদ্যুতের অপচয় হচ্ছে। পাশাপাশি এগুলোতে প্রচুর দুর্ঘটনাও ঘটছে। শহরে আগে প্রচুর পায়েচালিত রিকশা চলতো।
সরকারকে যথেষ্ট বিল দিয়েই ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জ দেওয়া হয় দাবি করে একাধিক গ্যারেজ মালিক এবং ব্যাটারিচালিত অটোরিকসা ও রিকশা মালিক-চালিকরা বলেন, একটা রিকশা চার্জ দিতে বিদ্যুৎ খরচ হয় ১০-১৩ ইউনিট। যেসব জায়গায় ব্যাটারিচালিত রিকশা চার্জ দেওয়া হয়, তারা বাণিজ্যিক মিটার বসিয়েই চার্জ দেয়। এতে তো সরকারের কোনো লস হওয়ার প্রশ্নই ওঠে না।
খোঁজ নিয়ে জানা যায়, চাঁদপুর শহরের পুরাণবাজারের বিভিন্ন এলাকা, রঘুনাথপুর, দোকানঘর, নতুন বাজার প্রফেসার পাড়া, বড়স্টেশন, আদালত পাড়া, রহমতপুর কলোনী, গুণরাজদী, ইচলী, বঙ্গবন্ধু সড়কসহ চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন উপজেলার অলিতে-গলিতে দেদারছে চলছে ব্যাটারিচালিত অটো ও রিকশা।
চাঁদপুর বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড বিক্রয় ও বিপণন কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. মেহেদী হাসান ভূঞা জানান, চাঁদপুর নতুনবাজার ও পুরাণবাজার এলাকার জন্য সর্বোচ্চ বিদ্যুৎ লাগে ২৫ থেকে ২৬ মেগাওয়াট।

২০ জুলাই, ২০২৩।