চাঁদপুরে হাঁড়কাপানো শীত জেঁকে বসেছে, বাড়ছে ঠান্ডাজনিত রোগ

গরম কাপড়ের দোকানে ক্রেতাদের ভিড়

মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
চাঁদপুরে কনকনে ঠান্ডা বাতাস ও বৃষ্টির মতো নেমে আসা কুয়াশায় হাড়কাঁপানো শীত জেঁকে বসেছে। গত ৭২ ঘণ্টার মধ্যে দু’একবার সূর্যের দেখা মিললেও, ছিল না তেজ। দিনব্যাপী কুয়াশার চাদরে ঢাকা ছিল চারদিক। তবে দিনের বেলা একটু হালকা হলেও বাকি সময় মাঠ-ঘাট ঢেকে থাকছে ঘন কুয়াশায়। প্রয়োজনের বাইরে কেউ ঘর থেকে বের হচ্ছে না। এতে রাস্তা-ঘাটে মানুষের চলাচল ও যানবাহনের সংখ্যা কমে গেছে। এমন চিত্র সব উপজেলায় দেখা গেছে।
শীতের তীব্রতায় স্বাভাবিক কর্মক্ষমতা হারিয়েছে শ্রমজীবী ও ছিন্নমূল মানুষরা। খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের আপ্রাণ চেষ্টা করছে সহায়-সম্বলহীন লোকজন। এমন পরিস্থিতিতে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে শিশু ও বৃদ্ধরা। সেই সাথে বাড়ছে ঠান্ডাজনিত নানা রোগ। বিশেষ করে যারা অ্যাজমা ও ঠান্ডাজনিত রোগে ভুগছেন তারা নিদারুণ কষ্ট ভোগ করছেন। কাঁথা-কম্বল মুড়ি দিয়ে ঘরেই শুয়ে-বসে দিন পার করছেন তারা।
অন্যদিকে ঘন কুয়াশায় চাঁদপুর লঞ্চঘাটেও রাত থেকেই লঞ্চ চলাচল স্থবির হয়ে পড়ে। সকালে যে কয়েকটি লঞ্চ ছেড়ে গেছে তা মাঝ নদীতে গিয়ে বেশি দূর এগোতে পারেনি বলে জানা গেছে। দক্ষিণাঞ্চলসহ এই রুটে প্রতিদিন কমপক্ষে ৫০টি বিলাসবহুল লঞ্চ আসা-যাওয়া করে। বিআইডব্লিউটিএ’র নির্দেশনা মোতাবেক ঘন কুয়াশায় সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রাখার কথা থাকলেও আধুনিক যন্ত্রপাতি ব্যবহার করে লঞ্চের নির্ধারিত সময় ধরে রেখেছেন বলে জানিয়েছেন লঞ্চ কর্তৃপক্ষ। লঞ্চের মাস্টাররা জানিয়েছেন, ঘন কুয়াশার চাইতে যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচলে বেশি বিঘ্নতা সৃষ্টি হয় বালুবাহী নৌযানে।
শনিবার (৭ জানুয়ারি) চাঁদপুর লঞ্চেঘাটে গিয়ে দেখা গেছে, সকাল সাড়ে ৭টায় চাঁদপুর ঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে যায় এমভি ঈগল-৭। তবে যাত্রী সংখ্যা খুবই কম। এই লঞ্চের টিকিট মাস্টার ইসমাইল হোসেন জানান, ঘন কুয়াশায় লঞ্চ র্নিধারিত সময় পৌঁছাতে পারে না। কুয়াশা বেশি দেখা দিলে অপেক্ষা করতে হয়। তবে গত দু’দিন কুয়াশা বেড়েছে।
এমভি জমজম-৭ এর মাস্টার সাইফুল ইসলাম জানান, ঘন কুয়াশা থাকলেও আমরা সতর্ক থাকি। জাহাজে অত্যাধুনিক যন্ত্রপাতি আছে। সেগুলো ব্যবহার করে চলাচল করতে হয়। তবে রাতের বেলায় মেঘনায় বালুবাহী বাল্কহেডগুলো খুবই সমস্যা করে। এগুলো রাতের বেলায় চলাচল বন্ধ করতে ব্যবস্থা নেয়া দরকার।
লঞ্চ মালিক প্রতিনিধি বিপ্লব সরকার জানান, মাত্র ৩ ঘণ্টার মধ্যে ঢাকা-চাঁদপুর যাত্রীবাহী লঞ্চ চলাচল করে। এই রুটে সূর্যোদয় থেকে সূর্যাস্ত পর্যন্ত বালুবাহী বাল্কহেড চলাচল করার কথা থাকলেও তারা কর্তৃপক্ষের নিয়ম মানছেন না। বাল্কহেডগুলোর সাথে এ পর্যন্ত অনেক দুর্ঘটনা ঘটেছে। যার কারণে ঘন কুয়াশার মধ্যে খুবই সতর্ক থেকে লঞ্চগুলো চলাচল করছে।
বিআইডাব্লিউটিএ চাঁদপুর লঞ্চঘাটের দায়িত্বরত পরিবহন পরিদর্শক শাহ আলম জানান, চাঁদপুর-ঢাকা নৌরুটে প্রতিদিন ৫০টি লঞ্চ আসা-যাওয়া করে। ঘন কুয়াশার কারণে লঞ্চ চলাচলে কিছুটা বিঘ্ন হচ্ছে। ঘন কুয়াশায় আমরা লঞ্চগুলো সম্পূর্ণ বন্ধ রাখি। যখন আকাশ পরিস্কার হয় তখন ছেড়ে যাওয়ার জন্য নির্দেশ দেয়া হয়। আর রাতের বেলায় বালুবাহি বাল্কহেড চলাচল নিষিদ্ধ। এ বিষয়ে ব্যবস্থাগ্রহণের জন্য আমরা কোস্টগার্ড ও নৌ-পুলিশকে চিঠি দিয়েছি। তারা ব্যবস্থাগ্রহণ করবে।
এছাড়া কুয়াশায় ৬ ঘণ্টা বন্ধ থাকার পর চালু হয়েছে চাঁদপুর-শরীয়তপুর নৌরুটে ফেরি চলাচল। ঘন কুয়াশায় অনাকাঙ্ক্ষিত দুর্ঘটনা এড়াতে শুক্রবার রাত ২টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ফেরি চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
বিভিন্ন স্থান ঘুরে এবং লোকজনের সাথে কথা বলে জানা গেছে, কনকনে ঠান্ডা বাতাস ও ঘন কুয়াশায় জবুথুবু হয়ে পড়েছে গ্রামাঞ্চলের মানুষ। রাস্তাঘাটে লোকজন ও যানবাহনের চলাচল কমে গেছে। দিনের বেলায় সূর্যের আলো ভূপৃষ্ঠে পৌঁছায় না এবং দিন ও রাতে সমানতালে উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম কোণের হিমেল হাওয়া বইতে থাকে। আর বিকেল গড়িয়ে যখন সন্ধ্যা হয়, তখন ঘন কুয়াশার চাদরে ঢাকা পড়ে চারদিক।
রাত হলেই বৃষ্টির মতো কুয়াশা পড়তে থাকে। এই কুয়াশার চাদরে ঢাকা থাকে সকাল ১০টা পর্যন্ত। এতে অসহায় হয়ে পড়েছেন নিম্নবিত্ত শ্রেণির শ্রমজীবী মানুষরা। কর্মের তাগিয়ে যারা ঘর থেকে বের হয়েছেন, তারা বেশ বেকায়দায় পড়ছেন। সবারই গায়ে ছিল গরম কাপড়। তারপরও কনকনে শীত এবং হিমেল হাওয়ায় যেন শীত নিবারণ হচ্ছে না। তাই দিনের বেলা ও সন্ধ্যায় খড়কুটো জ্বালিয়ে শীত নিবারণের আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন অনেকে।
এই শীতে সবচে বেশি কাবু হয়ে পড়েছেন চরাঞ্চলের মানুষ। কনকনে ঠান্ডা বাতাস ও বৃষ্টির মতো নেমে আসা কুয়াশায় তাদের যেন দুর্ভোগের শেষ নেই। চরে গাছপালা না থাকায় এবং নদী ভাঙনের কারণে ভাঙা ঘরবাড়িতে হু-হু করে হিম বাতাস ঢোকে। কোনো রকমে কাঁথা-কাপড় মুড়িয়ে শীত পার করতে হচ্ছে। মাগরিবের আজানের পর কাউকে হাট-বাজারে বা পাড়া-মহল্লার দোকানে দেখা যায় না।
শীতে হাট-বাজার ঘুরে দেখা গেছে, গরম কাপড়ের দোকানে ক্রেতাদের ভিড়। বিশেষ করে হকার্স মার্কেটগুলো এবং ফুটপাত ও ভ্যান গাড়িতে বিক্রি করা গরম কাপড়ের দোকানে প্রচুর ক্রেতার সমাগম। সেখানে ৫০ টাকা থেকে ২৫০/৩০০/৪০০ টাকার মধ্যে ভারী গরম কাপড় পাওয়া যায়। যার ফলে নি¤œআয় ও শ্রমজীবী মানুষরা তাদের চাহিদা অনুযায়ী শীতের পোশাক কিনতে ওইসব দোকানগুলোতে ছুটছেন।
এদিকে শীতের তীব্রতার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে যেন বাড়ছে শীত ও ঠান্ডাজনিত রোগ। ইতোমধ্যে চাঁদপুর সদর হাসপাতালসহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সগুলোতে শীতজনিত রোগে আক্রান্ত রোগীর ভিড় বেড়েছে। হাসপাতালগুলোর আউটডোর এবং ইনডোর ঘুরে দেখা গেছে, চিকিৎসা নিতে আসা রোগীদের মধ্যে শিশু ও বৃদ্ধের সংখ্যায় বেশি। একজন অভিভাবক বলেন, প্রচন্ড শীত ও বাতাসের কারণে বাচ্চাটার শ^াসকষ্ট ও জ¦র দেখা দিয়েছে।
অটোরিকশা চালক কাশেম ও জিলানী জানান, ঠান্ডার কারণে মানুষজন ঘর থেকে বের না হওয়ায় যাত্রীর সংখ্যা কমে গেছে। ফলে যাত্রীর সংখ্যা কমে যাওয়া পরিবার-পরিজন নিয়ে খুবই বিপাকে আছি।
দিনমজুর নুরুল হক ও আবদুস সালাম বলেন, কোনোমতেই কাজ করলে পেট চলে। কাজ না করলে পেট চলে না, যে কারণে বাধ্য হয়ে কাজের সন্ধানে বের হতে হয়। কোনোদিন জোটে, কোনোদিন জোটেই না। গত কয়েকদিন যে শীত পড়ছে তাতে কাজে যোগদান করতে পারছি না।
কৃষক সালাউদ্দিন ও মোরশেদ বলেন, শীত ও ঘন কুয়াশার কারণে জমিতে হালচাষ করতে পারছি না। বোরো আবাদ শুরু হলেও ঠান্ডার কারণে জমিতে বোরো আবাদ করতে দেরি হচ্ছে। কোথাও স‚র্যের দেখা না হওয়ায় জমিতে বীজতলা তুলতে বিপাকে রয়েছি।
বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের মতে, বাংলাদেশে শীতকালীন স্বাভাবিক তাপমাত্রায় বিভিন্ন ধরনের রোগব্যাধী দেখা দেয়। এর মধ্যে সর্দি-কাশি, নিউমোনিয়া, ডায়রিয়া, হাঁপানি, টনসিলাটাইসিস, ব্রংকিওলাইটিস, সাইনোসাইটিস, বাত, আর্থাইটিস, চামড়ার শুষ্কতা অন্যতম। আবার তীব্র শীতে বয়স্কদের ক্ষেত্রে হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। তাই এসব রোগ থেকে সুরক্ষায় শীত এড়িয়ে চলতে হবে। প্রয়োজনে চিকিৎসক পরামর্শ নিতে হবে।
এ বিষয়ে হাজীগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. মো. গোলাম মাওলা বলেন, তীব্র শীতে বয়স্কদের হাইপোথার্মিয়া হতে পারে। কারণ, বয়স বাড়ার সাথে সাথে মানুষের শরীরের তাপ উৎপাদন ক্ষমতা কমতে থাকে। এতে বয়স্ক রোগীর শরীর ধীরে ধীরে ঠান্ডা হয়ে আসে এবং হাত-পা কুঁকড়ে যায়। এমনকি শরীর অবশ হয়ে আসতে থাকে। তাই শীতকালীন রোগসহ হাইপোথার্মিয়া রোগ থেকে বাঁচতে হলে অবশ্যই শীত এড়িয়ে চলতে হবে।
এসময় তিনি বলেন, শরীর গরম রাখতে গরম পোশাক পরিধান করতে হবে, গরম পানি খেতে হবে। এমনকি গোসলের সময় কুসুম বা হালকা গরম পানি ব্যবহার করতে হবে। যেহেতু এসব রোগে বয়স্ক ও শিশুরা বেশি আক্রান্ত হয়ে থাকে, তাই তাদের প্রতি বিশেষ নজর দিতে হবে। বয়স্করা যে রুমে থাকেন, প্রয়োজনে সেই রুমে হিটার ব্যবহার করা যেতে পারে। তাছাড়া রোগে আক্রান্ত হলে অবশ্যই চিকিৎসকের পরামর্শ নিতে হবে।
চাঁদপুর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক মো. জালাল উদ্দিন বলেন, শৈত্য প্রবাহ দীর্ঘস্থায়ী হলে বীজতলা নষ্ট হওয়ার আশংকা রয়েছে। এ বিষয়ে কৃষকদের বিভিন্নভাবে পরামর্শ দেয়া হচ্ছে।

০৮ জানুয়ারি, ২০২৩।