ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে সংঘর্ষ, হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগ
মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
সারাদেশে কোটা সংস্কারের দাবিতে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনকে ঘিরে চাঁদপুরের তিনটি উপজেলায় সংঘর্ষ, হামলা, ভাংচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় আটক অভিযান চালিয়ে যাচ্ছে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। ঘটনার পর থেকে বুধবার (৩১ জুলাই) পর্যন্ত জামায়াত-বিএনপির ৮০ জনকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠিয়েছে পুলিশ। এর মধ্যে অধিকতর জিজ্ঞাসাবাদের জন্য হাজীগঞ্জের ২ জনকে রিমান্ডে আনা হয়েছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন পুলিশ সুপার কার্যালয়ের বিশেষ শাখার পরিদর্শক (ডিআইও-১) মো. মনিরুল ইসলাম। তিনি বলেন, চাঁদপুর সদর, হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি থানায় সাতটি মামলা করা হয়েছে। এর মধ্যে সদরে দুটি, হাজীগঞ্জে চারটি ও শাহরাস্তি থানায় একটি মামলা করা হয়েছে। মামলায় গত ২৪ ঘণ্টায় ৩ জনকে আটক এবং বুধবার আটকদের আদালতে হাজির করলে বিচারক জামিন নামঞ্জুর করে জেলহাজতে পাঠায়।
সরকারি চাকরিতে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটাপ্রথা সংস্কারের দাবিতে শিক্ষার্থীদের টানা বিক্ষোভ কর্মসূচি শুরু হয় ১ জুলাই। গত ১৫ জুলাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষের পর বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে প্রায় সারাদেশে। এর পরদিন থেকে এই আন্দোলনকে কেন্দ্র করে রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, সংঘর্ষ, নাশকতা, ভাংচুর, অগ্নিসংযোগ ও হতাহতের ঘটনা ঘটে। যার ব্যতিক্রম চাঁদপুর জেলায়ও হয়নি।
এর মধ্যে ১৫ জুলাই (সোমবার) হাজীগঞ্জ বাজারে প্রথম মিছিল বের করে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীরা। এরপর ছাত্র আন্দোলনকে সমর্থন জানিয়ে এবং ১৬ জুলাই (মঙ্গলবার) দেশব্যাপী ৬ জন নিহতের প্রতিবাদে ১৭ জুলাই (বুধবার) আবারও হাজীগঞ্জ বাজারে বিক্ষোভ মিছিল ও সড়ক অবরোধের ঘটনা ঘটে এবং এদিন শিক্ষার্থীদের সাথে সরকারি দলীয় নেতাকর্মীদের সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। মূলত এদিন থেকে সংঘর্ষের সূত্রপাত।
যে সংঘর্ষ ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) সংহিসতায় রূপ নেয়। এদিন দেশব্যাপী কমপ্লিট শাটডাউন ঘোষণা করে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নেতৃবৃন্দ। এতে বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মীরা যোগ দেয়। এর ফলে ১৮ জুলাই (বৃহস্পতিবার) চাঁদপুর, হাজীগঞ্জ ও শাহরাস্তি, ১৯ জুলাই (শুক্রবার) হাজীগঞ্জ এবং ২০ জুলাই (শনিবার) চাঁদপুরে সড়ক অবরোধসহ পুলিশের সাথে দফায় দফায় ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া, হামলা, সংঘর্ষ, ভাংচুর ও যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে।
এসব ঘটনায় পুলিশ, সাংবাদিক, সরকার দলীয় নেতাকর্মী, আন্দোলনকারী, পিকেটিংয়ে জড়িত বিএনপি-জামায়াতের নেতাকর্মী, পথচারী, যানবাহনের চালক ও যাত্রীসহ প্রায় দুই শতাধিক লোকজন আহত হয়। আহতদের মধ্যে হাজীগঞ্জে সিমেন্টবাহী একটি কাভার্ডভ্যানে (চট্ট-মেট্রো-শ-১১-১৫৯৯) পেট্রোল বোমা হামলায় ওই কাভার্ডভ্যানের হেলপার আব্দুল মজিদ (২০) ঘটনার এক সপ্তাহ পর ২৫ জুলাই (বৃহস্পতিবার) চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ণ ইউনিটে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মারা যান। পরের দিন শুক্রবার তার গ্রামের বাড়ি খাগড়াছড়ি জেলার রামগড় উপজেলার রসূলপুর গ্রামে তাকে দাফন করা হয়।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, পুলিশের দায়েরকৃত ৬টি এবং ব্যক্তির করাসহ ৭টি মামলার এজাহারে ১৯২ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় অজ্ঞাত হিসেবে ২০/২৫ জন, অপর একটি মামলা ২৫০/৩০০ জন এবং অপর ৫টি মামলায় অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। এসব মামলা অনেক (আসামি) উল্লেখ করা হয়েছে এবং এ পর্যন্ত (৩১ জুলাই) ৮০ জনকে আটক করে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। আটকরা জামায়াত-বিএনপির রাজনীতির সাথে সম্পৃক্ত।
চাঁদপুরের দুইটি মামলার মধ্যে একটি পুলিশ এবং অপরটি জেলা আওয়ামী লীগ কার্যালয়ের কেয়ারটেকার বাদল গাজী বাদী হয়েছেন। পুলিশের মামলার এজাহারে ১৪ জন নামীয় এবং অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। এছাড়া জেলা আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে হামলা ও ভাংচুরের ঘটনায় বাদল গাজির মামলার এজাহারে নামীয় আসামি না থাকলেও ২৫০/৩০০ জন উল্লেখ করে অজ্ঞাত আসামি করা হয়েছে। মামলা দুটিতে এ পর্যন্ত ১৪ জনকে আটক করে আদালতে সোপর্দ করে পুলিশ।
মামলার উল্লেখযোগ্য আসামিরা হলেন- জেলা বিএনপির যুগ্ম সম্পাদক সেলিমুস ছালাম, জেলা যুবদলের সভাপতি মানিকুর রহমান মানিক, সাধারণ সম্পাদক নুরুল আমিন খান আকাশ, সাংগঠনিক সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ বাহার, সহ-দফতর সম্পাদক মো. ইউসুফ মিয়াজী, সদর উপজেলা যুবদলের ভারপ্রাপ্ত আহ্বায়ক নজরুল ইসলাম নজু, জেলা যুবদলের জেলা ছাত্রদলের সভাপতি ইমাম হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ইসমাইল হোসেন পাটওয়ারী, সাংগঠনিক সম্পাদক জিয়াউর রহমান সোহাগ, জেলা স্বেচ্ছাসেবক দলের আহ্বায়ক হযরত আলী, যুগ্ম-আহ্বায়ক মো. মাসুদ মাঝি, পৌর জামায়াতের বেলাল হোসেন প্রমুখ।
অপরদিকে চাঁদপুরে ৭টি মামলার মধ্যে হাজীগঞ্জ থানায় চারটি মামলা করা হয়। পুলিশের দায়েরকৃত চারটি মামলার এজাহারে ১৭৮ জনকে আসামি করা হয়েছে। এর মধ্যে একটি মামলায় ২০/২৫ জনকে অজ্ঞাত এবং অপর তিনটি মামলায় অজ্ঞাত আসামির সংখ্যা উল্লেখ করা হয়নি। মামলাগুলোতে এ পর্যন্ত ২৮ জনকে আটক করে আদালতের মাধ্যমে জেলহাজতে পাঠায় পুলিশ। এই ২৮ জনের মধ্যে জামায়াত নেতা মোজাম্মেল হক মজুমদার পরান ও মাহাদি হাসানকে ৫ দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদ করা হচ্ছে।
হাজীগঞ্জের মামলায় উল্লেখ্যযোগ্য নামীয় আসামিরা হলেন- উপজেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারী ও উপজেলা পরিষদের সাবেক ভাইস চেয়ারম্যান মোজাম্মেল হক মজুমদার পরান, উপজেলা যুবদলের যুগ্ম আহবায়ক জহির আহমেদ জহির, পৌর যুবদলের আহ্বায়ক মিজানুর রহমান সেলিম, সদস্য সচিব বিল্লাল হোসেন পাটোয়ারী, উপজেলা ছাত্রদলের আহ্বায়ক ফয়সাল হোসেন, ফরিদগঞ্জ উপজেলার ৩নং সুবিদপুর ইউনিয়নের জামায়াত নেতা মাহাদি হাসান ও হাজীগঞ্জ বাজারস্থ হলিকেয়ার হাসপাতালের এমডি ডা. মিনহাজুর রহমান।
এছাড়া শাহরাস্তি, মতলব উত্তর, মতলব দক্ষিণ থানায় বেশ কয়েকজন আটক হয়েছেন। এদিকে ব্লক রেইডসহ পুলিশের নিয়মিত অভিযান চলায় বিএনপি ও জামায়াতের নেতাকর্মীরা আটক আতঙ্কে গাঢাকা দিয়েছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর ব্লক রেইড অভিযানে প্রশাসন ও সেনাবাহিনীর সদস্যদের উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে। ব্লক রেইড অভিযানে যাদের আটক করা হচ্ছে, তাদের মধ্যে প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদের পর সম্পৃক্তদের আটক এবং অন্যদের ছেড়ে দিচ্ছে পুলিশ।
বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক ও শান্ত রয়েছে। তবে কোটা সংস্কারের পক্ষে আন্দোলনের অংশ হিসেবে সমন্বয়কদের একাংশের আদালত, ক্যাম্পাস ও রাজপথে ‘মার্চ ফর জাস্টিস’ পদযাত্রা কর্মসূচির অংশ হিসেবে চোখে-মুখে লাল কাপড় বেঁধে চাঁদপুর জেলা জজ আদালত ও জেলা প্রশাসক কার্যালয় এলাকায় প্রতিবাদ এবং বিক্ষোভ করেছে শিক্ষার্থীরা।
বুধবার (৩১ জুলাই) দুপুর ১টার দিকে জেলা প্রশাসক কার্যালয় সম্মুখে চাঁদপুর-কুমিল্লা আঞ্চলিক সড়কের উত্তর পাশে অবস্থান নিয়ে বিক্ষোভ করেন তারা। বিক্ষোভের শুরুতে শিক্ষার্থীরা জেলা জজ আদালতের সম্মুখে প্রবেশ করতে চাইলে পুলিশ তাদের বাঁধা দেয় এবং তাদের সরিয়ে সড়কের একপাশে নিয়ে আসে। সেখানে মুষলধারে বৃষ্টি উপেক্ষা করে কয়েক শতাধিক শিক্ষার্থী অবস্থান নেয়।
এ বিষয়ে চাঁদপুর সদর মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ মো. শেখ মুহসীন আলম জানান, মামলার আসামি আটকে পুলিশ মাঠে রয়েছে। মামলায় যাদের আটক করা হয়েছে তাদের আদালতের মাধ্যমে কারাগারে পাঠানো হয়েছে। সাধারণ শিক্ষার্থীদের মধ্যে কাউকে আটক করা হয়নি। চাঁদপুর সদরে পরিস্থিতি শান্ত রয়েছে।
হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মুহাম্মদ আবদুর রশিদ জানান, মামলায় নামীয় আসামি এবং আটকদের তথ্য ও পুলিশি তদন্তে যাদের নাম আসছে তাদের আটকে নিয়মিত অভিযান চলমান রয়েছে। সহিংসতা যারা জড়িত তাদের ধরিয়ে দিতে এবং জনগণের জানমালের নিরাপত্তায় যে কোন অপ্রিতিকর পরিস্থিতি দেখলে বা শুনলে পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতার আহ্বান জানান তিনি।
০১ আগস্ট, ২০২৪।