মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
২০১৩ সালের ৫ মে রাজধানীর শাপলা চত্বরে অনুষ্ঠিত হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ’র মহাসমাবেশে নিহতদের মধ্যে ৯৩ জনের নাম ও পরিচয় প্রকাশ করেছে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। গত রোববার (৪ মে) হেফাজতের জনসংযোগ বিভাগের দায়িত্বে থাকা মুফতি কেফায়েতুল্লাহ আজহারী গণমাধ্যমকে বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন।
প্রকাশিত তালিকায় নিহত ৯৩ জনের মধ্যে এক কিশোরসহ চাঁদপুরের ৫ জন রয়েছেন। তারা হলেন, কচুয়া উপজেলার হাবিবুল্লাহ (৩২), চাঁদপুর সদর উপজেলার মাসুম খান (২২), ফরিদগঞ্জ উপজেলার খালেদ মাহমুদ সাইফুল্লাহ (১৫) ও আব্দুল গফুর (৩৫), মতলব উপজেলার নাজির আহমদ (৩২)।
নিহত হাবিবুল্লাহ কচুয়া উপজেলার দারচর গ্রামের আবুল মুন্সীর ছেলে। তিনি নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্দিরগঞ্জ উপজেলার পূর্ব বাগমারা এলাকায় থাকতেন। ২০১৩ সালের ৬ মে সকালে সিদ্দিরগঞ্জ মাদানীনগর মাদ্রাসার কাছে মাথায় গুলিবিদ্ধ হয়ে তিনি মারা যান। তিনি পেশায় রিক্সা চালক ছিলেন। গ্রামের বাড়িতে তাকে দাফন করা হয়।
একই দিন সকালে চিটাগাং রোডে বুকে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, চাঁদপুর সদর উপজেলার সকদি গ্রামের বাবুল খানের ছেলে মাসুম খান। তিনি পেশায় ইলেকট্রিশিয়ান ছিলেন। রাজধানীর কাঁচপুর এলাকায় বসবাস করতেন। তিনি পেশায় ইলেকট্রিক কাজ করতেন। তাকে গ্রামের বাড়িতে পারিবারিক কবরস্থানে দাফন করা হয়।
একই সময়ে চিটাগাং রোডে কোমরে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান, ফরিদগঞ্জ উপজেলার মুন্সীরহাট গ্রামের আব্দুল জলিলের ছেলে খালেদ মাহমুদ সাইফুল্লাহ। সে নারায়ণগঞ্জ জেলার সিদ্দিরগঞ্জ উপজেলার রসূলবাগ বটতলা এলাকার আলী আকবর মডেল উচ্চ বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলো। তাকে রাজধানীর ডেমরা-সারুলিয়া এলাকার ডগাইর কবরস্থানে দাফন করা হয়।
৬ মে সকালে গলায় ও পিঠে গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী নাজির আহমদ। তিনি মতলব উপজেলার মো. শহিদুল্লাহর ছেলে। তিনি নারায়ানগঞ্জ জেলার সিদ্দিরগঞ্জ উপজেলার চট্টগ্রাম রোড, মাদানি নগর এলাকার ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী ছিলেন। তাকে রাজধানীর ডেমরা-সারুলিয়া এলাকার শুকুরশী কবরস্থানে দাফন করা হয়।
একই দিন সকালে নাকের মাঝামাঝি গুলিবিদ্ধ হয়ে মারা যান আব্দুল গফুর। তিনি ফরিদগঞ্জ উপজেলার সব্দিরামপুর কারিবাড়ি গ্রামের আবু তাহেরের ছেলে। তিনি নারায়নগঞ্জ জেলার সিদ্দিরগঞ্জ উপজেলার ঢাকা-চট্টগ্রাম রোড এলাকায় রাজমিস্ত্রির (নির্মাণ শ্রমিক) কাজ করতেন। তাকে গ্রামের বাড়িতেই দাফন করা হয়।
এদিকে ৫ মে’র ঘটনায় নিহতের সংখ্যা বাড়তে পারে বলে জানান, মুফতি কেফায়েতুল্লাহ আজহারী। গণমাধ্যমকে তিনি বলেন, এটি প্রাথমিক খসড়া তালিকা। তথ্য যাচাই ও অনুসন্ধান চলছে এবং তালিকা চূড়ান্ত করতে আরও সময় লাগবে। যাচাই-বাছাই শেষে এ সংখ্যা আরও বাড়তে পারে।
উল্লেখ্য, ব্লগারদের বিরুদ্ধে ইসলাম ধর্ম অবমাননা এবং নারীনীতির বিরোধিতাসহ ১৩ দফা দাবি তুলে ২০১৩ সালের ৫ মে ঢাকার শাপলা চত্বরে অবস্থান কর্মসূচি শুরু করে হেফাজতে ইসলাম বাংলাদেশ। সেদিন হাজার হাজার কওমি আলেম, শিক্ষার্থী এবং সাধারণ মুসলমান এ মহাসমাবেশে অংশ নেন।
সেদিন রাত গভীর হওয়ার পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী অভিযান চালিয়ে সরিয়ে দেয় তাদের। অভিযানে ব্যাপক গুলি, সাউন্ড গ্রেনেড ও টিয়ারশেল ছোড়া হয়। হেফাজতে ইসলামের দাবি, ওইদিন অসংখ্য মানুষ নিহত হয়েছেন। এর মধ্যে গত রোববার (৪ মে) প্রকাশিত তালিকায় ৯৩ জনের নাম উল্লেখ করা হয়।
প্রকাশিত ওই খসড়া তালিকায় নিহতদের নাম, ঠিকানা ও পরিবারের সদস্যদের তথ্য অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এতে দেখা গেছে, নিহতদের অধিকাংশই যুবক ছিলেন।
এদিকে ৫ মে’র ঘটনার পর দেশ-বিদেশে আলোড়ন সৃষ্টি করা ওই ঘটনার পর হেফাজতে ইসলাম দাবি করেছিল তাদের শত শত নেতাকর্মী নিহত হয়েছেন। তবে তারা কোনো তালিকা পেশ করতে পারেনি। এটা নিয়ে সাধারণ মানুষের পাশাপাশি হেফাজতের ভেতরেও অনেকের ক্ষোভ ছিল। অবশেষে ঘটনার একযুগ পর ৯৩ জন নিহতের তালিকা প্রকাশ করে হেফাজতে ইসলাম।
ওই সময়ে মানবাধিকার সংস্থা ‘অধিকার’ ঘটনার পরপর হেফাজতের কর্মসূচি ঘিরে ৬১ জন নিহতের তথ্য জানিয়েছিল। এর পাশাপাশি বিবিসি ঢাকা প্রতিনিধি মার্ক ডামেট মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধান করে জানান, ৫ ও ৬ মে’র সহিংসতায় অন্তত ৫৮ জন নিহত হন। তবে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকারের পক্ষ থেকে বারবার দাবি করা হচ্ছিল, শাপলা চত্বরের অভিযানে কেউ মারা যায়নি। যদিও তাদের এই বক্তব্য কেউই বিশ্বাস করেনি।
সে সময় পুলিশ বলেছিল, অভিযানের সময় আহত একজন পরে হাসপাতালে মারা যান। আর দিনের সহিংসতায় নিহত চারজনের মরদেহ পাওয়া গিয়েছিল মঞ্চের কাছে একটি ভ্যানে। তবে ৫ মে দিনের সহিংসতা এবং পরের দিন ৬ মে সারা দেশে সহিংসতায় ২৮ জন নিহত হওয়ার কথা বলেছিল স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়।
গত বছরের ৫ আগস্ট, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে সরকার পতনের পর শাপলা চত্বরে গণহত্যার অভিযোগ এনে ঘটনার ১১ বছর পর গত ১৮ আগস্ট ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) আদালতে মামলা এবং আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করা হয়।
ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম (সিএমএম) মো. জাকী-আল-ফারাবীর আদালতে করা এ মামলায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ ৩৪ জনকে আসামি করা হয়। মামলাটি করেন বাংলাদেশ পিপলস পার্টির চেয়ারম্যান বাবুল সরদার চাখারী। মামলার তদন্ত করে প্রতিবেদন দেওয়ার জন্য মতিঝিল থানার ওসিকে নির্দেশ দেন আদালত।
এ মামলায় অন্য আসামিদের মধ্যে আছেন- সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর নিরাপত্তা উপদেষ্টা তারিক আহমেদ সিদ্দিক, সাবেক উপদেষ্টা সালমান এফ রহমান, বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন, সাবেক তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সাবেক বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী জাহাঙ্গীর কবির নানক, পুলিশের সাবেক মহাপরিদর্শক (আইজিপি) বেনজীর আহমেদ, আওয়ামী লীগের যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ, সাবেক আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার, সাবেক আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক, এসবির সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলাম, পুলিশের যুগ্ম কমিশনার বিপ্লব কুমার, মতিঝিল থানার সাবেক ওসি ওমর ফারুক প্রমুখ।
এর পরের মাসেই আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে এ ঘটনায় হেফাজতে ইসলামের পক্ষে অভিযোগ করা হয়। এতে সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, সাবেক পুলিশপ্রধান বেনজীর আহমেদসহ ৫০ জনের বিরুদ্ধে অভিযোগ করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর বরাবর হেফাজতে ইসলামের নেতা জুনায়েদ আল হাবিব ও মাওলানা মামুনুল হকের পক্ষে আজিজুল হক ইসলামাবাদী গত বছরের ২৬ নভেম্বর এ অভিযোগ করেন।
০৬ মে, ২০২৫।