আবারো চাঁদপুরে ডেসটিনির কার্যক্রম শুরুর পাঁয়তারা

এস এম সোহেল

আবারো চাঁদপুরে ডেসটিনির কার্যক্রম শুরুর পাঁয়তারা চলছে। অনেক আলোচনা-সমালোচনা শেষ হতে না হতে চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন লোকজনদের আবোল-তাবোল বুঝিয়ে অর্থ হাতানোর চেষ্টা চালাতে দেখা যায়। গতকাল শনিবার হঠাৎ করে জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে চাঁদপুর ডেসটিনি বিনিয়োগকারী ও ক্রেতা পরিবেশক ঐক্য ফোরাম নামে একটি সংগঠন জেলার তথ্যভিত্তিক আলোচনা ও দোয়া মাহফিল নামে একটি অনুষ্ঠান করতে দেখা যায়। এ নিয়ে শিল্পকলা একাডেমীর আশপাশের লোকজনের মুখে নানা গুঞ্জন শোনা যায়।

জানা যায়, ডেসটিনি-২০০০ লিমিটেড নামে মাল্টিলেভেল মার্কেটিং কোম্পানি দিয়ে ২০০০ সালে ডেসটিনি গ্রুপের যাত্রা শুরু হয়। এক দশকের মধ্যে বিমান পরিবহন, আবাসন, কোল্ড স্টোরেজ, জুট মিল, মিডিয়া, বনায়নসহ বিভিন্ন খাতে ৩৪টি কোম্পানি চালু করে এই গ্রুপ। কিন্তু মাল্টিলেভেল মার্কেটিংয়ের নামে লাখ লাখ মানুষের কাছ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা নিয়ে তা আত্মসাতের অভিযোগ ওঠে। এরপর দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ২০১২ সালের ৩১ জুলাই রাজধানীর কলাবাগান থানায় ডেসটিনি গ্রুপের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে দু’টি মামলা করে। তদন্ত শেষে ২০১৪ সালের ৫ মে দুদক আদালতে অভিযোগপত্র  জমা দেয়।

গতকাল শনিবার চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে ডেসটিনির কর্মকর্তাদের ক্রেস্ট দিতে দেখা যায়। -ইল্শেপাড়

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০০৮ সাল থেকে ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশন প্রজেক্টের মাধ্যমে বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ২৪৪৫ কোটি টাকা সংগ্রহ করে। এর মধ্যে ২২৫৭ কোটি ৭৮ লাখ ৭৭ হাজার টাকা আত্মসাত করা হয়। এর ফলে ক্ষতিগ্রস্ত হন সাড়ে ১৭ লাখ বিনিয়োগকারী। আর মাল্টিপারপাস কো-অপারেটিভ প্রজেক্টের নামে ডেসটিনি বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিল ১৯০১ কোটি টাকা। সেখান থেকে ১৮৬১ কোটি টাকা আত্মসাৎ করা হয় বলে দুদকের অনুসন্ধানে ধরা পড়ে। ওই অর্থ আত্মসাতের ফলে সাড়ে ৮ লাখ বিনিয়োগকারী ক্ষতির মুখে পড়েন।

তদন্ত প্রতিবেদনে বলা হয়, ডেসটিনি গ্রুপের নামে ২৮টি প্রতিষ্ঠানের মধ্যে বেশ কয়েকটি ছিল নামসর্বস্ব। আসামিরা প্রথমে প্রজেক্টের টাকা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের হিসাবে জমা করতেন, তারপর বিভিন্ন ব্যাংকের হিসাবে তা স্থানান্তর করা হতো। দুদক ৩৪টি ব্যাংকে এ রকম ৭২২টি হিসাবের সন্ধান পায়, যেগুলো পরে জব্দ করা হয়। আত্মসাৎ করা ৪১১৯ কোটি টাকার মধ্যে ৯৬ কোটি টাকা বিদেশে পাচারের অভিযোগও আনা হয় দুই মামলায়। এরপর ২০১৬ সালের ২৪শে আগস্ট অভিযোগ গঠনের মধ্যদিয়ে এ দুই মামলায় আসামিদের বিচার শুরু হয়। শর্তসাপেক্ষে ডেসটিনির কর্ণধার রফিকুল আমিন ও মোহাম্মদ হোসাইনকে জামিন দেন হাইকোর্ট। পরে দুদকের আবেদনে তা স্থগিত করে দেন আপিল বিভাগ। এ আবেদনের শুনানির একপর্যায়ে আত্মসাৎ করা টাকা জমা দেয়ার কথা বলেন সর্বোচ্চ আদালত। সে অনুসারে ১৩ই নভেম্বর ডেসটিনির পক্ষ থেকে গাছ বিক্রি করে টাকা দেয়ার কথা বলা হয়। ওইদিন হলফনামা দিয়ে আদালতকে জানানো হয় যে, তাদের কাছে ৩৫ লাখ গাছ আছে। প্রতিটি গাছ ৮ হাজার টাকায় বিক্রি করে ২৮০০ কোটি টাকা দিতে পারবেন তারা। এর পরিপ্রেক্ষিতে জামিনের শর্ত পূরণে আপিল বিভাগ দুই আসামি যে কারাগারে আছেন, সেখানে তাদের সঙ্গে গাছ বিক্রির সকল কাগজপত্রে স্বাক্ষর ও আলোচনার সুযোগ দিতে কারা কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেন। ডেসটিনি ট্রি প্লান্টেশনের সিইও ড. শামসুল হক ভূঁইয়া এমপির তত্ত্বাবধানে সব কাজ সম্পন্ন হবে। যদি গাছ বিক্রি করে ২৮০০ কোটি টাকা দিতে না পারেন, তাহলে নগদ ২৫০০ কোটি টাকা ট্রেজারি চালানের মাধ্যমে জমা দেবেন তারা। এর অনুলিপি দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যানকে পাঠাতে হবে। এরপর যারা ক্ষতিগ্রস্ত ব্যক্তি, যাচাই করে তাদের কাছে টাকা হস্তান্তরের পর জামিনে মুক্তি পাবেন দুই কর্মকর্তা। নির্দেশনা অনুযায়ী শর্ত পূরণ করলে তবেই তারা জামিনে মুক্তি পাবেন। কিন্তু বছর পার হয়ে গেছে আদালতের দেয়া কোনো শর্তই পূরণ করতে পারেননি রফিকুল আমিন ও মোহাম্মদ হোসাইন।

আমানতকারীরা তাদের টাকা ফেরত পাবেন কি-না এ নিয়েও রয়েছে অনিশ্চয়তা। অর্থ আত্মসাৎ ও পাচারের অভিযোগে ডেসটিনি গ্রুপের কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে মামলার কার্যক্রম কয়েক বছর ধরে চলছে। অভিযুক্তদের কেউ এখনো জেলে আছেন, কেউ চিকিৎসার নামে হাসপাতালে আছেন। কেউ জামিন পেয়েছেন। কিন্তু ক্ষতিগ্রস্তদের টাকা ফেরত পাওয়ার ব্যবস্থা হচ্ছে না দীর্ঘ সময়েও। গত ৮ বছরের বেশ কয়েকটি আলোচিত আর্থিক কেলেঙ্কারির মধ্যে ডেসটিনি গ্রুপ অন্যতম। সাধারণ বিনিয়োগকারীদের কাছ থেকে ৪ হাজার কোটি টাকার বেশি অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ রয়েছে প্রতিষ্ঠানটির বিরুদ্ধে।

এদিকে চাঁদপুর শহরে কিছু অসাধু ব্যক্তি ডেসটিনির নামে আবারো অর্থ হাতিয়ে নেয়ার জন্য উঠে-পড়ে লেগেছে। জেলার বিভিন্ন গ্রাম থেকে নারীদের লোভ দেখিয়ে আবারো ডেসটিনির কার্যক্রম পরিচালনা করতে দেখা যায়। গতকাল শনিবার দুপুরে জেলা শিল্পকলা একাডেমীতে গিয়ে দেখা যায় শিল্পকলা একাডেমীর সদর দরজা বন্ধ করে তারা ডেসটিনির গুণগান করছে। দুপুর দেড়টার দিকে দেখা যায়, বিভিন্নজনকে ক্রেস্ট দেয়ার ছড়াছড়ি।

বর্তমানে ডেসটিনির চাঁদপুর জেলা কার্যক্রম পরিচালনা করছেন এরশাদুজ্জামান খান, সুমন কুমার দত্ত, জামাল খান, চাঁদপুর সদরে মো. হাসান খান ও মো. শাহ্আলম, হাজীগঞ্জে মো. আল-আমিন, মতলব উত্তরে মাও. মো. শাহ্আলম, ফরিদগঞ্জে মো. জগলুল হায়দার (মুন্না), হাইমচরে মো. জাফর ইকবাল এবং কচুয়ায় স্বাধীন সুমন।

ডেসটিনির মামলার সমাধান না হওয়া পর্যন্ত যেন আবারো অর্থ হাতিয়ে নিতে তারা না পারেন সেদিকে নজর রাখতে সচেতন মহল জেলা ও পুলিশ প্রশাসনের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন।