জামায়াত সমর্থিত ৩ কাউন্সিলরসহ ৮ মামলায় আসামি সহস্রাধিক
জাহাঙ্গীর আলম ইমরুল
কুমিল্লা নগরীর নানুয়ার দিঘীর উত্তর পাড়ের একটি অস্থায়ী পূজামণ্ডপে হনুমানের পায়ের কাছে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার অভিযোগে গত ১৩ অক্টোবর কুমিল্লায় বিচ্ছিন্ন সহিংসতাসহ উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে শহরে। পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে মোতায়েন করা হয় পুলিশ, র্যাব ও বিজিবির বিপুলসংখ্যক সদস্য।
আলোচিত ওই মণ্ডপে পূজার আয়োজকরা জানান, সেখানে পবিত্র কোরআন শরিফ কী করে এলো সে বিষয়ে তাদের কোনো ধারণা নেই। ১৩ অক্টোবর সকালে বিষয়টি পূজারীদের নজরে আসলে ‘৯৯৯’ নম্বরে ফোন পেয়ে কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আনওয়ারুল আজিম সেখানে যান।
নগরীর নানুয়ার দিঘীর উত্তর পাড়ের অস্থায়ী পূজামণ্ডপে আয়োজক দর্পণ সংঘের সভাপতি সুবোধ রায় জানান, কম বাজেটের অস্থায়ী মণ্ডপ বলে সিসি ক্যামেরা বসানো হয়নি।
এ কারণে সহিংস ঘটনায় নগরীর বেশ কয়েকটি পূজামণ্ডপ ও মন্দির ক্ষতিগ্রস্ত হয়। সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয় নানুয়ার দিঘীর মণ্ডপ এবং নগরীর কাপড়িয়া পট্টির চান্দমনি রক্ষা কালীমন্দির ও পূজামন্ডপ। মন্দির সংলগ্ন বাড়ির বাসিন্দা মিতু সরকারসহ বেশ কয়েকজন প্রত্যক্ষদর্শী নারী জানান, জন্ম হয়ে এমন তান্ডব আর দেখিনি। হাজারো উশৃঙ্খল যুবক এসে মা কালীর মন্দির ভেঙে ফেলেছে! তিনি বলেন, আমরা বাংলাদেশে থাকাটাই কি অপরাধ? ৭০ বছর বয়সী লক্ষ্মী বলেন, ‘আল্লাহু আকবার’ বলে তারা হামলা চালিয়েছিলো।
তারা জানান, তাদের মনের আতঙ্ক এখনো কাটেনি।
এই মণ্ডপের পুরুহিত অমর চন্দ্র বলেন, এ মণ্ডপে তিনি যে তান্ডব সেদিন দেখেছেন তা কখনোই ভুলার নয়। তিনি জানান, পূজোর মণ্ডপে পেট্রোল ঢেলে আগুন ধরিয়ে দেয়া হয়, ভাংচুর করা হয় প্রতিমা, পুড়িয়ে দেয়া হয় প্যান্ডেল, মন্দিরের শিব লিঙ্গসহ অন্যান্য মুর্তিও ভেঙে ফেলা হয়। তবে ক্ষয়ক্ষতি নিরুপণ করা যায়নি।
এ ঘটনায় পরদিন ১৪ অক্টোবর চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি আনোয়ার হোসেনসহ পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা নগরীর নানুয়ার দীঘির পাড়ের আলোচিত মণ্ডপ এলাকা পরিদর্শনে আসেন।
কুমিল্লা কোতোয়ালি মডেল থানার ওসি আনওয়ারুল আজিম জানান, পবিত্র কোরআন অবমাননা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে চারটি মামলা করেছে। এর মধ্যে ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত ও ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দুটি মামলা হয়েছে। অন্য দুটি মামলা বিশেষ ক্ষমতা আইনে। তিনি জানান, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেপ্তার করা হয়েছে ফয়েজ আহমেদ নামের এক ব্যক্তিকে। ফয়েজ মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়। যা মুহূর্তে ভাইরাল হয়ে যায়। এ নিয়ে উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে।
এছাড়া পবিত্র কোরআন অবমাননার অভিযোগের ও সহিংসতার ঘটনায় কুমিল্লা সিটি করপোরেশনের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন, ৮ নম্বর ওয়ার্ডের ইকরাম হোসেন বাবু ও ১ নম্বর ওয়ার্ডের কাজী গোলাম কিবরিয়া এই ৩ কাউন্সিলরসহ ১,০৫৫ জনকে আসামি করে কুমিল্লায় ৮টি মামলা হয়েছে। এসব মামলায় মঙ্গলবার দুপুর পর্যন্ত গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৪৪ জনকে। জামায়াতের রাজনীতির সঙ্গে জড়িত এই কাউন্সিলররা বিশেষ ক্ষমতা আইনে করা মামলার আসামি।
কুমিল্লা জেলা পুলিশের ডিআইও-১ মনির আহমেদ জানান, পূজামণ্ডপে হামলা ও প্রতিমা ভাঙচুরের ঘটনায় কুমিল্লা কোতোয়ালি, সদর দক্ষিণ ও দাউদকান্দি থানায় ৮টি মামলা হয়েছে। এখন পর্যন্ত কোতোয়ালিতে ৪০ এবং সদর দক্ষিণে ৪ জনসহ ইতিমধ্যেই মোট ৪৪জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
কুমিল্লার পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, আমরা গভীরভাবে তদন্ত করে দেখছি আসামিদের কারও কোনো রাজনৈতিক সম্পৃক্ততা আছে কি না।
কুমিল্লার ঘটনায় গত ১৪ অক্টোবর অপপ্রচারকারী গোলাম মাওলাকে সাইবার মনিটরিংয়ের মাধ্যমে সনাক্ত করে আটক করেছে র্যাব। পবিত্র কোরআন শরিফ পাওয়ার অভিযোগ তুলে ফেসবুকে লাইভ করা ফয়েজ আহমেদকে আটক করে পুলিশ।
গেলো বুধবার থেকেই কুমিল্লায় অ্যান্টি টেররিজম ইউনিটের একটি দল কাজ করছে। পুলিশের বেশ কয়েকটি ইউনিট একযোগে কাজ করছে উল্লেখ করে পুলিশ সুপার ফারুক আহমেদ বলেন, অভিযান চলছে, শিগগিরই ধরা পড়বে ঘটনায় জড়িতরা।
এদিকে পূজামন্ডপকে কেন্দ্র করে সৃষ্ট সহিংসতায় জেলার কোতয়ালি, সদর দক্ষিণ, দাউদকান্দি থানায় রোববার পর্যন্ত ৮টি মামলা রেকর্ড হয়েছে। এসব মামলায় কুমিল্লা সিটি কর্পোরেশনের জামায়াত সমর্থিত ১নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর গোলাম কিবরিয়া, ৮ নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর ইকরাম হোসেন বাবু, ও ৬নং ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোশাররফ হোসেন, তাছাড়া জামাত নেতা শ্রমিক কল্যান ফেডারেশনের কেন্দ্রিয় সহ-সভাপতি মুজিবুর রহমান ভূইয়াসহ ৭৯২ জনকে আসামি করা হয়। এসব মামলায় ৯২ জনের নাম এজাহারে অন্তর্ভূক্ত করা হয়।
এ ঘটনা তদন্তে ঘটনার দিন বুধবারই তিন সদস্য তদন্ত কমিটি গঠন করে জেলা প্রশাসন। এ তদন্ত কমিটির তিন কার্য দিবসে সোমবার তদন্ত রিপোর্ট দেওয়ার কথা থাকলেও তা বাড়িয়ে ১৫ দিনের সময় চাওয়া হয়েছে। ১৫ দিনের সময় বাড়ানো কথা জানান তদন্ত টিমের সদস্য আদর্শ সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা জাকিয়া আফরিন। তিনি বলেন, শুনানির কাজ চলছে। আজও (সোমবার) অনেকের শুনানি হয়েছে। অনেক আসামি জেলে রয়েছে তাদেরও শুনানি করতে হবে। তাই ১৫ দিনের সময় চাওয়া হয়েছে।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ কামরুল হাসান বলেন, তদন্ত কমিটি তাদের কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। কুমিল্লার সার্বিক পরিস্থিতি অনেক ভাল। প্রশাসনের প্রচেষ্টা, বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ, রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দসহ সর্বস্তরের মানুষ পারস্পারিক সম্প্রীতি ধরে রাখতে ভূমিকা পালন করছে।
পূজামণ্ডপের ঘটনায় নগরীর সার্বিক পরিস্থিতি স্বাভাবিক হয়ে আসলেও নগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ মোতায়েন রয়েছে। নগরীতে প্রতিদিনই হচ্ছে বিভিন্ন সভা, মানববন্ধন ও সমাবেশ।
এদিকে কুমিল্লায় পূজামন্ডপের ঘটনায় নগরীতে বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিবাদ অব্যাহত রয়েছে। ঘটনাস্থল নানুয়াদীঘির পাড় পরিদর্শনে আসছেন দেশের রাজনৈতিক ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা।
পরিদর্শনে আসেন জাতীয় সংসদের হুইপ ও কেন্দ্রীয় আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাইদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি। তিনি বলেন, বিভিন্ন ধর্মের মানুষ তাদের নিজ ধর্ম পালন করছে। হঠাৎ করে দেশকে অস্থিতিশীল করার জন্য দেশবিরোধী কোনো একটি নির্দিষ্ট পক্ষ পবিত্র কোরআনকে সামনে এনে দেশকে পিছিয়ে দিচ্ছে।
এদিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক সমিতির সভাপতি ড. রহমত উল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক ড. মো. নিজামুল হক ভূইয়া, অধ্যাপক শফিউল আলম ভূইয়া, অধ্যাপক ড. একেএম গোলাম রব্বানী, অধ্যাপক সৌরভ সিকদার, অধ্যাপক রুবাইয়াত ফেরদৌস, অধ্যাপক ড. চন্দ্রনাথ পোদ্দারসহ শিক্ষক নেতৃবৃন্দ আসেন নানুয়ার দিঘিরপাড় দুর্গা পূজামন্ডপের স্থান পরিদর্শন।
গত ১৫ অক্টোবর কুমিল্লায় আসেন গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের প্রতিষ্ঠাতা জাফরুল্লাহ চৌধুরী। তিনি বলেন, ঘটনার দায় সরকারকে নিতে হবে।
গতকাল মঙ্গলবার কুমিল্লায় ক্ষতিগ্রস্ত পূজামন্ডপ এলাকা পরিদর্শন করেছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক পঙ্কজ দেবনাথ এমপি। পরিদর্শন শেষে পঙ্কজ দেবনাথ এমপি সাংবাদিকদের বলেন, বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে রক্ত দিয়ে স্বাধীনতা এনেছি। বঙ্গবন্ধুকে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দেশ এগিয়ে যাচ্ছে। যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বিশ্বাস করে না, তারাই আজ ইন্ধন যোগাচ্ছে। তাই এখন সাম্প্রদায়িক শক্তিকে ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবেলা করতে হবে। কারণ এদেশ আমাদের। এদেশে আমরাই থাকবো।
সোমবার বিকালে সাম্প্রদায়িক অপশক্তির বিরুদ্ধে সাম্প্রীতির পক্ষে নগরীর টাউন হলে এক বিশাল গণজমায়েত করেন কুমিল্লা মহানগর আওয়ামী লীগ। এতে প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার।
মহানগর পূজা উদযাপন পরিষদের সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্য দাশ টিটু বলেন, আজ আমরা হিন্দু-মুসলমান সবাই ব্যথিত। তিনি বলেন, আমাদের বিশ্বাস, আসল অপরাধী ধরা পড়বে।
২০ অক্টোবর, ২০২১।