ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র প্রভাবে চাঁদপুরে ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি

স্টাফ রিপোর্টার
বঙ্গোপসাগরে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’র প্রভাবে চাঁদপুর শহরের বিভিন্ন স্থানে গাছ উল্টে ও বিদ্যুতের পিলার পড়ে বিদ্যুৎ সরবরাহ সঞ্চালন লাইনের ওপরে পড়ে। যে কারণে চাঁদপুরের বিভিন্ন স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ ছিলো।
শহরের বঙ্গবন্ধু সড়ক ও পুরানবাজার সেতু সংলগ্ন এলাকায় গাছ উল্টে সড়কে পড়ে যান চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ২৪ ঘণ্টায় জেলায় বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২১৯ মিলিমিটার। ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে স্বাভাবিক হওয়ার কারনে ২১ ঘণ্টা পর এ রুটের চাঁদপুর থেকে সব ধরনের লঞ্চ চলাচল শুরু হয়েছে। শনিবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত চাঁদপুর থেকে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে কমপক্ষে ২০টির মত লঞ্চ।
এর আগে মিধিলির কারণে শুক্রবার সকালে চাঁদপুর থেকে সবধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ করে বিআইডব্লিউটিএ। রাত ১২টা থেকে লঞ্চ চলাচল শুরু হয়।
গত শনিবার চাঁদপুর আবহাওয়া কর্মকর্তা মো. শামসুল আলম জানান, শুক্রবার (১৭ নভেম্বর) ভোর ৬টা থেকে শনিবার সকাল ৭টা পর্যন্ত বৃষ্টিপাত রেকর্ড করা হয়েছে ২১৯ মিলিমিটার। সকাল ৬টা থেকে বিকেল ৩টা পর্যন্তই রেকর্ড হয় ১৪১ মিলিমিটার বৃষ্টিপাত। তবে শনিবার ভোরেই সূর্যের আলো দেখা গেছে। সকাল সাড়ে ৭টা থেকে চালু হয়েছে চাঁদপুর থেকে লঞ্চসহ সব ধরনের নৌযান।
চাঁদপুর বিআইডব্লিউটিএ’র উপ-পরিচালক মো. শাহাদাত হোসেন জানান, প্রতিক‚ল আবহাওয়া অনুক‚লে আসায় এবং নদী বন্দরের জন্য কোনো সতর্কতা সংকেত না থাকায় সকাল থেকে সব রুটে লঞ্চ চলাচল স্বাভাবিক রয়েছে। প্রায় ২১ ঘণ্টা পর চাঁদপুর-ঢাকা এবং চাঁদপুর-নারায়ণগঞ্জসহ সব নৌপথে পুনরায় নৌযান চলাচল শুরু হয়েছে।
চাঁদপুর-লাকসাম রেলপথের বিভিন্ন স্থানে বড় আকারের গাছ পড়ে রেলপথের ক্ষতিসাধিত হয়। এতে করে এ পথের ট্রেন চলাচলে মারাত্বক বিঘœ সৃষ্টি হয়েছে। রেলপথের হাজীগঞ্জ, উয়ারুক, বলাখাল, চাঁদপুর মিশনরোড ও শহরের বড় স্টেশন এলাকার আক্কাছ আলী স্কুল সংলগ্ন স্থানে রেলপথে কমপক্ষে ছোট ও বড় ১৫টি গাছ রেললাইনের উপর পড়ে ট্রেন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।
ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ এর প্রভাবে বাতাসের গতি বৃদ্ধি ও ব্যাপক বৃষ্টিপাত হয়ে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হওয়ায় চাঁদপুর জেলায় ১৯০ হেক্টর আধাপকা ও পাকা আমন ধান এবং অন্যান্য ৪২০ হেক্টর জমির বিভিন্ন ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। যার ফলে খুবই দুশ্চিন্তার মধ্যে পড়েছেন কৃষকরা। গতকাল শনিবার দুপুরে কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তর চাঁদপুর জেলা কার্যালয় থেকে এই তথ্য জানানো হয়।
সরেজমিন জেলা সদরের বাগাদী ইউনিয়নের ছোবহানপুর, বাগাদী গ্রাম, নানুপুর, বালিয়া ইউনিয়নের সাপদি, ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের সকদি রামপুর ও আশাপাশের এলাকায় গিয়ে আমন ধানের অধিকাংশ জমি পানিতে তলিয়ে থাকতে দেখা গেছে।
শহরের বঙ্গবন্ধু সড়কের বাসিন্দা কবির হোসেন মিজি জানান, শুক্রবার দুপুরে বাতাসের গতি বেড়ে যায়। যার ফলে এই সড়কে গাছ উল্টে পড়ে সড়কে এবং একটি বৈদ্যুতিক খুঁটি ভেঙে পড়ে। এদিন দুপুর থেকেই এই সড়কে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ থাকে।
শহরের গুয়াখোলা এলাকার বাসিন্দা ওমর ফারুক জানান, শুক্রবার বিকেলে ঘূর্ণিঝড়ের ফলে বাতাসের তীব্রতা বেড়ে যায়। যে কারণে এলাকার বিদ্যুতের মেইন লাইনের তার ছিড়ে ঝুলে পড়ে। বিষয়টি বিদ্যুৎ বিভাগকে তাৎক্ষণিক জানানো হয়। শনিবার রাত পর্যন্ত গুয়াখোলা এলাকায় বিদ্যুৎ বন্ধ ছিলো।
এদিকে বিকেলে শহরের পুরানবাজার ব্রিজ সংলগ্ন এলাকায় একটি বড় আকারের গাছ উল্টে সড়কে পড়ে। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, গাছ উল্টে সড়কে পড়লে কিছু সময় যান চলাচল বন্ধ থাকে। পরে স্থানীয়দের সহযোগিতায় গাছটি কেটে অপসারণ করা হয়। এরপর সড়ক চলাচল স্বাভাবিক হয়।
ছোবহানপুর ও বাগাদী গ্রামের জমিগুলোতে কৃষকরা পাকা ধান দুদিন আগে কেটে জমিতে শুকানোর জন্য রেখেছেন। সেবসব জমিতে এখন হাটু সমান পানি। অনেক জমির পাকা ও আধাপকা ধান বাতাসে নুয়ে পড়েছে। এসব এলাকার খাল ও নালা ভরাট হয়ে যাওয়ার কারণে পানি নিস্কাশনের ব্যবস্থা নেই।
ছোবহানপুর মাঠে দুদিন আগে কেটে রাখা ধান পানি থেকে তুলে আনছেন কৃষক মো. হাবিব। তিনি জানান, এ বছর তিনি পৌনে ৩ একর জমতি আমন ধানের আবাদ করেছেন। অধিকাংশ জমি এখন পানির নিচে। প্রায় ১ লাখ টাকা খরচ হয়েছে। এখন কি করবেন তিনি বুঝতে পারছেন না।
বাগাদী মাঠের কৃষক হাবিব বেপারী ও ওবাদ শেখ জানান, তাদের পুরো মাঠের অধিকাংশ জমির ধান হাটু সমান পানির নিচে। অনেকেই ধান কেটে শুকানোর জন্য দু’তিন দিন আগে রেখেছেন। চিন্তাও করতে পারেননি ঘূর্ণিঝড়ে এমন ক্ষতির সম্মুখীন হবেন।
ফরিদগঞ্জ উপজেলার বালিথুবা পশ্চিম ইউনিয়নের কৃষক ছিদ্দিকুর রহমান জানান, সকদিরামপুর মাঠে তার দেড় একর জমিতে বিআর-৪৯, বিনা-৭ ও ১৭ ধানের আবাদ করেছেন। আগে কেটে রাখা ধান শ্রমিক নিয়ে তুলছেন। পানিতে ভিজে যাওয়ার কারণে ওজন বেড়েগেছে।
ওই এলাকার আরেক কৃষক আব্দুল খালেক বেপারী কান্নাজড়িত কণ্ঠে জানালেন, তার সব শেষ। প্রায় ৫০ হাজার টাকা খরচ করে এক একর জমিতে বিআর-২২ জাতের ধানের আবাদ করেছেন। এই ধানগুলো উচ্চতায় অনেক বড়। যার ফলে ঘূর্ণিঝড়ে বাতাসের তীব্রতায় সব ধান জমিতে নুয়ে পড়েছে। এবছর তিনি বড় ধরনের লোকসানে পড়বেন। তিনি সরকারের কাছে সহায়তা কামনা করেন।
চাঁদপুর-লাকসাম রেলপথের দায়িত্বরত কর্মকর্তা লিয়াকত আলী মজুমদার ও চাঁদপুর স্টেশন মাস্টার শোয়েবুল শিকদার জানিয়েছেন, শুক্রবার সন্ধ্যায় ও রাতের মধ্যে এ পথে বিভিন্ন স্থানে যারা দায়িত্বরত আছে তারা ঘূর্ণিঝড় মিধিলির প্রভাবে পড়ে যাওয়া গাছগুলো দ্রæত গতিতে অপসারন করে ও রেলপথ মেরামত করে ট্রেন চলাচল স্বাবিক করে তুলে। চট্টগ্রাম-চাঁদপুরের মধ্যে চলাচলকারী মেঘনা এক্যপ্রেস রেলপথে গাছ পড়ে বিঘœ সৃষ্টি হওয়ায় বিলম্বে রাত ১১টায় চাঁদপুর এসে পৌছে। তবে চাঁদপুর থেকে পরবর্তী ট্রেনগুলো যথাযথ সময়ে শনিবার গন্তব্যের উদ্দেশ্যে ছেড়ে গেছে বলে জানান চাঁদপুর স্টেশন মাস্টার শোয়েবুল শিকদার।
বাংলাদেশ অভ্যন্তরীণ নৌ-পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআইডাব্লিউটিএ) চাঁদপুর বন্দর ও পরিবহন কর্মকর্তা শাহাদাত হোসেন জানান, ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে শুক্রবার সকাল ১০টা ৪০ মিনিটে চাঁদপুর থেকে সব রুটে লঞ্চ ও নৌযান চলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। শনিবার সকাল সাড়ে ৭টা থেকে সব রুটে লঞ্চ ও নৌযান চলাচল শুরু হয়েছে। চাঁদপুর ঘাট থেকে ঢাকার উদ্দেশে নিয়মিত লঞ্চগুলো ছেড়ে যায়।
বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (চাঁদপুর) বিক্রয় ও বিতরণ বিভাগের উপ-বিভাগীয় প্রকৌশলী আবদুল মোকতাদির জানান, ঘূর্ণিঝড়ের কারণে বেশ কিছু স্থানে বিদ্যুৎ সরবরাহ লাইন ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। শুক্রবার রাতেই কয়েক স্থানে মেরামত করে লাইন চালু করা হয়। বাকি লাইনগুলো মেরামত করার চেষ্টা চলছে।
চাঁদপুর জেলা কৃষি স¤প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক ড. সাফায়েত আহম্মদ সিদ্দিকী জানান, ঘূর্ণিঝড় ‘মিধিলি’ এর প্রভাবে কারণে জেলায় আধাপাকা ও পাকা রোপা আমান ১৯০ হেক্টর, সরিষা ১৪০ হেক্টর, আগাম শীতকালীন সব্জি ২৭০ হেক্টর ও বীজতলা (ধান) ১০ হেক্টর জমির ফসলের ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। আমাদের কর্মকর্তারা মাঠে কাজ করছেন। জরিপ কার্যক্রম শেষ হলে আর্থিক ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ জানা যাবে।

২০ নভেম্বর, ২০২৩।