চাঁদপুরে শিক্ষার্থীদের পদচারণায় মুখরিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো

সজীব খান
দীর্ঘ দেড় বছর পর প্রাণের টানে ছাত্র-ছাত্রীরা ছুটছে বিদ্যালয়ে। ঘণ্টা বাজবে, ক্লাসে-ক্লাসে প্রবেশ করবে, দেড় বছর পর ক্লাসে প্রবেশের এমন চিত্র ঈদের আমেজে মত সবাই মেতে উঠেছে। অনেক দিন পর ঘণ্টার আওয়াজে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রাণের বিদ্যাপীঠ মুখরিত হয়ে উঠেছে। নতুন বইয়ের ঘ্রাণ আর শিক্ষকদের কড়া শাসনে মানুষ গড়ার কারিগরসহ সবাই একত্রিত হয়েছে। মানসম্মত পরিবেশ নিশ্চিত করার উপর নজরদারী রাখার নির্দেশনা রয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের। দীর্ঘ ১৭ মাস বন্ধ থাকার পর রোববার (১২ সেপ্টেম্বর) খুলেছে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান। শিক্ষার্থীদের পদচারণায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আবারো মুখরিত হচ্ছে।
রোববার স্কুল খোলার প্রথম দিন চাঁদপুরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে উৎসবমুখর পরিবেশে শিক্ষার্থীরা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রবেশ করেছে। কাঁধে স্কুল ব্যাগ, মাথায় ছাতা, আর স্কুল ড্রেস পড়ে শিক্ষার্থীরা বিদ্যালয়ের যাওয়ার চিত্র অনেক দিন পড়ে চোখে পড়েছে। স্কুলে যেতে ছাত্র-ছাত্রীরা এতোদিন মরিয়া হয়েছিল। মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা অনেকদিন ঝিমিয়ে ছিল। এখন বিদ্যালয়গুলো খোলার কারণে খাতা-কলম হাতে নিয়ে লেখাপড়া মনোনিবেশ থাকবে।
সরেজমিনে গতকাল রোববার চাঁদপুরের বিভিন্ন বিদ্যালয় ঘুরে দেখা যায়, বিদ্যালয়ে ছাত্র-ছাত্রীদের প্রবেশের গেটে স্বাস্থ্য সুরক্ষা সামগ্রী রাখা হয়েছে। হ্যান্ড সেনিটাইজার, সামাজিক দূরত্ব বজিয়ে রাখার লাল গোল চিহ্ন, মুখে মাস্ক ও স্বাস্থ্যবিধি মেনে ক্লাস করেছে। করোনার সংক্রমণ এড়াতে বিদ্যালয়গুলোও সার্বিক ব্যবস্থা রেখেছে। শাহতলী জিলানী চিশতী কলেজে ছাত্র-ছাত্রীদের ফুল দিয়ে বরণ করে নিয়েছে। বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের বরণের মহাৎসবে যেন সবাই মেতে উঠেছে।
বিদ্যালয়ে প্রবেশের সময় ছাত্র-ছাত্রীদের সাথে কথা হলে তারা জানায়, অনেকদিন পর বিদ্যালয়ের যাচ্ছি, খুব ভাল লাগছে। ক্লাসের বাইরে অনেকদিন ছিলাম, এখন নিয়মিত ক্লাসে যেতে পারবো, নিজেদের জ্ঞান বিকাশে বিদ্যালয়ে যাওয়ার কোন বিকল্প নেই। করোনা সংক্রমণে যেন শিক্ষাকে আর গ্রাস করতে না পরে, সে প্রত্যাশা আমাদের রয়েছে। তারা জানান, শিক্ষকদের সাথে আমাদের দীর্ঘ সময়ে দূরত্ব হয়েছে। এখন নিয়মিত বিদ্যালয়ে যেতে পারলে বিগত দিনের লেখাপড়া রিকভারি দিতে পারবো বলে আমরা আশাবাদী। করোনাভাইরাসের কারণে প্রায় দেড় বছর ধরে বন্ধ ছিলো দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। করোনা সংক্রমণ নিম্নমুখী হওয়ায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খুলে দেওয়ার শুরু করেছে সরকার। শিক্ষা কার্যক্রম চালুর প্রস্তুতি নিতে স্কুল কলেজগুলোকে শিক্ষার্থীদের স্বাস্থ্যবিধি মানতে উদ্বুদ্ধ করা, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান পরিচ্ছন্ন করাসহ মোট ১৯ দফা নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। প্রকাশ করা হয়েছে স্বাস্থ্যবিধি মেনে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার গাইড লাইন। এ গাইড লাইন অনুসরণ করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোকে প্রস্তুত করতে বলা হয়েছে।
সরকারের নির্দেশিত ১৯ দফা নির্দেশনা হলো- শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশ মুখসহ অন্যান্য স্থানে কোডিড-১৯ অতিমারি সম্পর্কিত স্বাস্থ্যবিধি প্রতিপালনে করণীয় বিষয়গুলো ব্যানার বা অন্য কোনো উপায়ে প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে; শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রবেশপথে সব শিক্ষক-কর্মচারী শিক্ষার্থী-অভিভাবকদের তাপমাত্রা পরিমাপক যন্ত্রের মাধ্যমে নিয়মিত তাপমাত্রা মাপা ও তা পর্যবেক্ষণ করার ব্যবস্থা করতে হবে; শিক্ষার্থীদের ভিড় এড়ানোর জন্য প্রতিষ্ঠানের সবগুলো প্রবেশমুখ ব্যবহার করার ব্যবস্থা করা; যদি কেবল একটি প্রবেশমুখ থাকে সেক্ষেত্রে একাধিক প্রবেশমুখের ব্যবস্থা করার চেষ্টা করতে হবে; প্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিনে শিক্ষার্থীদের আনন্দঘন পরিবেশে শ্রেণি কার্যক্রমে স্বাগত জানানোর ব্যবস্থা করতে হবে; প্রতিষ্ঠান খোলার প্রথম দিন শিক্ষার্থীরা কিভাবে স্বাস্থ্যবিধি মেনে প্রতিষ্ঠানে অবস্থান করবে এবং বাসা থেকে যাওয়া-আসা করবে সে বিষয়ে শিক্ষণীয় ও উদ্বুদ্ধকারী ব্রিফিং দেওয়ার ব্যবস্থা করতে হবে।
এছাড়া মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা অধিদপ্তরের দেওয়া ভিডিও প্রদর্শনের ব্যবস্থা করতে হবে- প্রতিষ্ঠানের একটি কক্ষ প্রাথমিক চিকিৎসার ব্যবস্থাসহ আইসোলেশন কক্ষ হিসেবে প্রস্তুত রাখতে হবে, প্রতিষ্ঠানের সব ভবনের কক্ষ, বারান্দা, সিঁড়ি, ছাদ এবং আঙ্গিনা যথাযথভাবে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন করার ব্যবস্থা করতে হবে, প্রতিষ্ঠানের সব ওয়াশরুম নিয়মিত সঠিকভাবে পরিষ্কার রাখা এবং পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থা করতে হবে, প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, শিক্ষার্থী, কর্মচারী এবং অভিভাবক প্রবেশের সময় সরকার দেওয়া স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালনের ব্যবস্থা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষক, শিক্ষার্থী ও কর্মচারীর সঠিকভাবে মাস্ক (সম্ভব হলে কাপড়ের মাস্ক) পরিধান করার বিষয়টি নিশ্চিত করতে হবে, প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন স্থানে সাবান বা হ্যান্ডওয়াশ দ্বারা হাত ধোয়ার এমন ব্যবস্থা করা যাতে শিক্ষার্থীরা ক্লাসে ঢোকার আগে সবাই সাবান দিয়ে হাত ধুঁতে পারে, শ্রেণিকক্ষে শিক্ষার্থীদের বসার ক্ষেত্রে স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে অনুসরণ করতে হবে। এক্ষেত্রে পারস্পারিক ৩ ফুট শারীরিক দূরত্ব বজায় রাখার ব্যবস্থা করতে হবে, শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের খেলার মাঠ, ড্রেন ও বাগান যথাযথভাবে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা এবং কোথাও পানি জমে না থাকে তা নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে, প্রতিষ্ঠানসমূহে শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের উপস্থিতির সংখ্যা নিরুপণ করতে হবে, প্রতিষ্ঠানের সব শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি নিশ্চিত করার ব্যবস্থা করতে হবে, স্বাস্থ্যবিধি যথাযথভাবে প্রতিপালন করা হচ্ছে কিনা তা পর্যবেক্ষণ ও বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানের শিক্ষকবৃন্দের সমন্বয়ে কমিটি গঠন করতে হবে।
প্রয়োজনীয় স্বাস্থ্যবিধি মেনে আনন্দঘন শিখন কার্যক্রমের মাধ্যমে শ্রেণি কার্যক্রম পরিচালিত করতে হবে- প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় অবকাঠামোগত মেরামত, বৈদ্যুতিক মেরামত এবং পানি সংযোগজনিত মেরামত সম্পন্ন করতে হবে, প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজিং কমিটি ও অভিভাবকদের সাথে সভা করে এতদসংক্রান্ত বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
করোনার কারণে গত বছরের ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ছুটি চলছে। সরকারের সর্বশেষ ঘোষণা অনুযায়ী ১১ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত ছুটি ছিলো। প্রাথমিক থেকে উচ্চ মাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ১২ সেপ্টেম্বর থেকে খুলে দেওয়া হয়েছে।
চাঁদপুর সদর উপজেলার এমএম নুরুল হক উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শাখাওয়াত হোসেন বলেন, আমরা স্কুল খোলার জন্য যাবতীয় ব্যবস্থা নিয়েছি। বিদ্যালয়ে সামাজিক দূরত্ব মানার জন্য আমরা দাগ টেনে দিয়েছি। ক্লাশরুমগুলোতে কয়জন কীভাবে বসবে সেজন্যও আমরা ছাত্র-ছাত্রীদের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। বিদ্যালয়ের পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতার যাবতীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছি।
তিনি বলেন, আমাদের শিক্ষক-শিক্ষিকা, কর্মচারী সবাই আমাদের টিকা গ্রহণ করেছে। আমাদের প্রস্তুতি শতভাগ রয়েছে।
পশ্চিম ভাটেরগাঁও সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকরা জানান, খুব ভাল লাগছে। বিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের লেখাপড়া নিয়ে আবার ব্যস্ত থাকতে পারবো।
১৩ সেপ্টেম্বর, ২০২১।