মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
তুচ্ছ ঘটনায় ২ দিনব্যাপী সংঘর্ষে রণক্ষেত্র পরিণত হয়েছে হাজীগঞ্জ। এতে দুই পক্ষের ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় আহত হয়েছেন অন্তত অর্ধ-শতাধিক। আহতদের মধ্যে কয়েকজনকে কুমিল্লা ও ঢাকায় রেফার করা হয়েছে। এর মধ্যে সাইমুন নামের এক কিশোরের অবস্থা আশংকাজনক। সবশেষ গত শুক্রবার রাত ১১টার দিকে সংঘর্ষস্থল হাজীগঞ্জ বাজারে সেনাবাহিনী ও পুলিশ উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
একই সময়ে ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন জেলা প্রশাসক মুহম্মদ মোহসীন উদ্দিন ও পুলিশ সুপার মোহাম্মদ আব্দুর রকিব। এর আগে বৃহস্পতিবার (১৯ সেপ্টেম্বর) বিকালে সংঘর্ষের সূত্রপাত হয়। হাজীগঞ্জ পৌরসভাধীন টোরাগড় ও মকিমাবাদ এলাকার কিশোর-যুবকদের সাথে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। সংঘর্ষে উভয় পক্ষের লোকজন ও পথচারী আহত হন এবং আগুন দিয়ে সড়ক অবরোধ ও একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান ভাংচুর করা হয়।
একাধিক সূত্রে জানা গেছে, গত মাসে (আগস্ট) তুচ্ছ ঘটনায় হাজীগঞ্জ পৌরসভাধীন টোরাগড়ে হাজীগঞ্জ সরকারি মডেল পাইলট হাই স্কুল এন্ড কলেজ সংলগ্ন এলাকায় মকিমাবাদ গ্রামের সর্দার বাড়ির এক ছেলেকে মারধর করে। ওই ঘটনায় ক্ষিপ্ত হয়ে গত ১৯ সেপ্টেম্বর বিকালে সর্দার বাড়ির ছেলেরা হাজীগঞ্জ বাজারে টোরাগড় এলাকার অপর এক ছেলেকে মারধর করে।
বিষয়টি জানতে পেরে বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় টোরাগড়ের কয়েকজন কিশোর একত্রিত হয়ে আবারো সর্দার বাড়ির দুইজনকে মারধর করে। এতেই সংঘর্ষের সূত্রপাত। এই ঘটনায় দুই গ্রামের কিশোর-যুবকরা সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ে। যা বৃহস্পতিবার ও শুক্রবার সন্ধ্যা থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত চলে। দুইদিন রাতেই সেনাবাহিনীর সহায়তায় পুলিশ ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনে।
এদিকে দুইদিনের সংঘর্ষে হাজীগঞ্জ বাজার রণক্ষেত্রে পরিণত হয়। উভয়পক্ষের লোকজন দেশীয় অস্ত্র, লাঠিসোঁটা, ইট, পাটকেল ও কাঁচের বোতল নিয়ে মারামারিতে লিপ্ত হন। এতে দোকানপাট ও যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ক্ষতিগ্রস্ত হন ব্যবসায়ীরা এবং ভোগান্তিতে পড়েন সাধারণ মানুষ। ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় পথচারীসহ আহত হন অর্ধ-শতাধিক ব্যক্তি। এরমধ্যে দেশীয় অস্ত্রের আঘাতে গুরুতর আহত কয়েকজনকে কুমিল্লা ও ঢাকা পাঠানো হয়েছে।
দুই দিনের এ সংঘর্ষের ঘটনায় ফেসবুকে বিএনপির নেতাকর্মীদের দোষারোপ এবং সংঘর্ষে ২/৪/৬/১০ জন নিহতের সংখ্যা উল্লেখ করে গুজব ছড়ানো হয়। তবে দুই পক্ষের লোকজন বিএনপির নেতাকর্মী ও সমর্থক হলেও দলীয় কোনো কারণে এ সংঘাত হয়নি এবং এই সংবাদ লিখা পর্যন্ত কোন ব্যক্তির মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত হওয়া যায়নি। তবে সাইমন নামের এক কিশোরের অবস্থা আশংকাজনক। বিষয়টি তার পরিবার নিশ্চিত করেছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স, আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসন সূত্রেও মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়নি। সংবাদকর্মীরা প্রত্যক্ষদর্শী ও বিভিন্ন মাধ্যমে কথা বলে কোনো মৃত ব্যক্তির সত্যতা পায়নি। তারা (সংবাদকর্মী) যার সাথেই কথা বলেছেন, সবাই শুনেছেন বলে জানতে পেরেছেন। কেউই মৃত্যুর সত্যতা বা কারো নাম-পরিচয় নিশ্চিত করতে পারেননি।
এ বিষয়ে সদ্য সাবেক উপজেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক এম.এ রহিম পাটওয়ারী, উপজেলা যুবদলের আহ্বায়ক আকতার হোসেন দুলাল ও পৌর যুবদলের সদস্য সচিব বিল্লাল হোসেন পাটওয়ারী। তারা একই বক্তব্য দিয়ে বলেন, টোরাগড় ও মকিমাবাদ এলাকার কয়েকজনের মধ্যে বিবাদের কারণে এ সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে। এখানে দলীয় কোন সম্পৃক্ততা নেই।
এ বিষয়ে হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ফারুক জানান, সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনা হয়। বর্তমানে (শনিবার) স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজমান। সংঘর্ষে আহতের খবর পাওয়া গেলেও কেউ নিহত হয়েছেন, এমন তথ্য পাওয়া যায়নি।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাপস শীল বলেন, এখন পরিস্থিতি স্বাভাবিক। সংঘর্ষের ঘটনায় এখন পর্যন্ত মৃত্যুর কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি। তবে বেশ কয়েকজন আহত হয়েছেন বলে জানতে পেরেছি।
চিকিৎসাধীন অবস্থায় আহত কিশোর সাইমুনের মৃত্যু : হাজীগঞ্জে টোরাগড় ও মকিমাবাদের দুই গ্রুপের সংঘর্ষের ঘটনায় আহত কিশোর মো. সাইমুন হোসেন (১৬) মারা গেছেন। শনিবার (২১ সেপ্টেম্বর) রাতে রাজধানীর একটি বেসরকারি হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন তার বাবা মো. ইউনুছ ও মামা গোলাম সরোয়ার।
নিহত সাইমুন হাজীগঞ্জ পৌরসভাধীন তাহফিজুল কোরআন হাফেজিয়া মাদ্রাসার শিক্ষার্থী। তার নানার বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলার সুবিদপুর ইউনিয়নের দিঘদাইর গ্রামে এবং তার সৎ বাবার বাড়ি চাঁদপুর সদর উপজেলার মহামায়া চরবাকিলা প্রধানীয়া বাড়ি। সে তার সৎ বাবা ও মায়ের সাথে হাজীগঞ্জ পৌরসভাধীন খাটরা-বিলওয়াই কোকাকোলা ঘাট সংলগ্ন এলাকায় ভাড়া বাসায় থাকতো।
বাবা ইউনুছ সংবাদকর্মীদের জানান, শুক্রবার সন্ধ্যায় সাইমুন হাজীগঞ্জ বাজারে যায়। সে বড় মসজিদে এশার নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার উদ্দেশে সাধনার সামনে দাঁড়িয়েছিলো। এসময় মারামারি মধ্যে পড়ে গেলে অজ্ঞাত ব্যক্তিরা তাকে কুপিয়ে ফেলে রাখে। পরে কয়েকজন লোকে তাকে উদ্ধার করে হাজীগঞ্জ বাজারস্থ একটি বেসরকারি হাসপাতালে নিয়ে যায়।
তিনি বলেন, সাইমুনের অবস্থা খারাপ হলে আমরা কুমিল্লা নিয়ে যাই। কুমিল্লায় তার অবস্থার অবনিত হলে শনিবার দুপুরে ঢাকা নিয়ে যাই। সেখানে রাত ৮টার দিকে সাইমুন মারা যায়।
এসময় কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি আরও বলেন, তার (সাইমুন) বাবা মারা যাওয়ার পর আমি তার মা বিউটিকে বিয়ে করি। এরপর থেকে আমার ছেলে হিসেবেই আমি তাকে লালন-পালন করছি এবং পড়ালেখা করাচ্ছি। যারা আমার বুকের ধন কেড়ে নিয়েছে, আমি তাদের ফাঁসি চাই।
এ বিষয়ে হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ মহিউদ্দিন ফারুককে বলেন, সাইমুমের মৃত্যুর বিষয়টি আমি শুনেছি। বিষয়টি আমরা দেখছি এবং খোঁজ-খবর নিচ্ছি।
২২ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।