হাইমচরে মেঘনায় জাহাজে ৭ হত্যাকাণ্ড
এস এম সোহেল
হাইমচর নীলকমল ইউনিয়নে মেঘনা নদীর মাঝের বাজার এলাকায় সারবাহী জাহাজ এমভি আল-বাখেরার মাস্টার ও সুকানিসহ ৭ জন খুনের ঘটনাটি কেউ কেউ ডাকাতি বললেও স্বজনদের দাবি এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। হত্যাকাণ্ডের প্রতিটি দৃশ্য দেখেই এমন মন্তব্য করছেন তারা। পুলিশও এই ঘটনাকে সন্দেহের মধ্যে রেখে তদন্ত কার্যক্রম পরিচালনা করছেন।
মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের মর্গে রাখা লাশ শনাক্তের জন্য আসা স্বজনদের সঙ্গে কথা বলে এসব তথ্য জানা গেছে।
গতকাল মঙ্গলবার জাহাজে হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় ৭ জনের মরদেহ পরিবারের কাছে হস্তান্তর করা হয়েছে। চাঁদপুর শহরের স্বর্ণখোলা রোডে মর্গ থেকে এক এক করে মরদেহ নিয়ে যান পরিবারের সদস্যরা। এসময় স্বজনদের আহাজারিতে ভারী হয়ে ওঠে সেখানকার পরিবেশ। এ ঘটনাকে ‘পূর্ব পরিকল্পিত’ বলছেন তারা। জড়িতদের দ্রুত আইনের আওতায় আনার দাবি স্বজনদের।
হত্যাকাণ্ডের শিকাররা হলেন- জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া (৬০) ফরিদপুর জেলা সদরের জোয়াইর গ্রামের মৃত আনিছ বিশ্বাসের ছেলে। লস্কর শেখ সবুজ (৩৫) তারই আপন ভাগিনা। সবুজ একই গ্রামের মৃত আতাউর রহমানের ছেলে। সুকানি আমিনুল মুন্সী (৪০) নড়াইল জেলার লোহাগড়া তানার ইটনা ইউনিয়নের পাঙ্খারচর গ্রামের মৃত মজিবুর রহমানের ছেল। লস্কর মো. মাজেদুল (১৬) মাগুরা জেলার মোহাম্মদপুর থানার মো. আনিছুর রহমানের ছেলে। একই উপজেলা ও পলাশ বাড়িয়া গ্রামের লস্কর সজিবুল ইসলাম (২৬) দাউদ হোসেনের ছেলে। আর ইঞ্জিন চালক মো. সালাউদ্দিন (৪০) নড়াইল জেলার লোহাগড়া উপজেলার লাহোরিয়া ১১ নলি গ্রামের মৃত আবেদ মোল্লার ছেলে এবং ও বাবুর্চি কাজী রানা (২৪) মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর উপজেলার ভাগ্যকুল গ্রামের কাজী দেলোয়ার হোসেনের ছেলে।
এর আগে সোমবার (২৩ ডিসেম্বর) বিকেলে হাইমচর নীলকমল ইউনিয়নে মেঘনা নদীর মাঝের বাজার এলাকায় সারবাহী জাহাজ এমভি আল-বাখের থেকে লাশ ও আহতদের উদ্ধার করে কোস্টগার্ড ও নৌ পুলিশ। তবে এই ঘটনায় এখন পর্যন্ত হাইমচর থানায় মামলা হয়নি। মঙ্গলবার সকাল ১০টার পর থেকে লাশগুলো ময়নাতদন্তের জন্য মর্গে নেয়া হয়। সেখানেই তাদের স্বজনদের মধ্যে অনেকেই উপস্থিত ছিলেন। সোমবার সুরতহাল এবং ময়নাতদন্তে কাজ করছে নৌ পুলিশ।
এ ঘটনা উদঘাটনের জন্য সিআইডি, পিবিআই ও পুলিশের একাধিক টিম কাজ শুরু করেছে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় এখনো মামলা প্রক্রিয়াধীন। এদিকে, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাটি শুধু ডাকাতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নয় এটি পূর্বপরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড বলে দাবি স্বজনদের। তাই দ্রুত ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের আটক করার দাবি জানান তারা।
অপরদিকে, এ ঘটনায় বেঁচে ফেরা জুয়েল রানার অবস্থা কিছুটা আশঙ্কামুক্ত বলে জানিয়েছেন চিকিৎসকরা। বর্তমানে তিনি ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। চিকিৎসকরা জানান, জুয়েলের শ্বাসনালী কেটে গেছে। তবে শ্বাস নেয়ার জন্য কৃত্রিম নল লাগানো হয়েছে।
আহত জুয়েল কথা বলতে না পারলেও নৌ-পুলিশের কাছে ঘটনার বর্ণনা লিখে দিয়েছেন। তিনি জানিয়েছেন, দুর্বৃত্তরা ৭ থেকে ৮ জনের দল ছিল। রোববার দিবাগত রাত ৩টার দিকে চাঁদপুরে নোঙর করার পর ঘুমানোর প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন তারা। একপর্যায়ে রাত ৪টার দিকে কেবিনের দরজায় নক করে দৃর্বৃত্তরা। এ সময় দরজা খোলার সঙ্গে সঙ্গে আমার গলায় ছুরিকাঘাত করে তারা।
হত্যার শিকার জাহাজের লস্কর শেখ সবুজের ছোট ভাই সাদিকুর রহমান বলেন, জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়া আমার মামা। তার মাধ্যমেই আমার ছোট ভাই সবুজ কাজে আসেন। তিনি লস্কর হিসেবে কাজ করেন। ১ দিন আগে আমার সঙ্গে ভাইয়ের কথা হয়েছে। যে মর্মান্তিক ঘটনায় আমার ভাই হত্যার শিকার হয়েছে, আমি চাই এমন ধরনের ঘটনা যাতে না ঘটে। এই জাহাজে থাকা প্রত্যেকটি হত্যার সুষ্ঠু তদন্ত ও বিচার দাবি করছি। ঘটনাটি যাতে কেউ ভিন্নখাতে প্রবাহিত করার চেষ্টা না করে আমি এটিও দাবি করছি।
এই হত্যাকাণ্ডের একই ধরনের দাবি জানালেন জাহাজের মাস্টার গোলাম কিবরিয়ার ভাই আউয়াল হোসেন। তিনি বলেন, এই মাসেই আমার ভাইয়ের চাকরির মেয়াদ শেষ হতো। তিনি ১ জানুয়ারি থেকে অবসরে যেতেন। তার দুই মেয়ে ও এক ছেলে রয়েছে। বড় মেয়ের জানুয়ারি মাসে বিয়ে হওয়ার কথা। কিন্তু এই ঘটনার পরে সব পকিল্পনাই শেষ।
হত্যার শিকার আমিনুল মুন্সীর বড় ভাই মো. হুমায়ুন, ইঞ্জিন চালক সালাউদ্দিনের মামাতো ভাই জাহাঙ্গীর বলেন, ঘটনাটি আমরা ডাকাতি শুনলেও খুনের ঘটনার দৃশ্য দেখে মনে হয়েছে এটি পরিকল্পিত হত্যা। কারণ প্রত্যেকটি নিহতের মাথায় ধারলো অস্ত্রের আঘাত। যারা হত্যার শিকার হয়েছেন সবারই প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র জাহাজে পাওয়া গেছে। এমনকি জাহাজে থাকা ৫ জনকে উদ্ধারের সময় তাদেরকে শোয়া অবস্থায় উদ্ধার করা হয়।
চাঁদপুর মর্গে কান্নাজড়িত কণ্ঠে নিহত মাজেদুল ইসলামের বাবা আনিস মোল্লা বলেন, আমার ছেলে কিছুদিন আগে জাহাজে চাকরি নেয়। আমার ছেলেকে কেন মারলো? আমি আমার ছেলে হত্যার বিচার চাই।
হাইমচর থানার অফিসার ইনচার্জ মহিউদ্দিন সুমন বলেন, ঘটনার পর ৭ জনেরই ময়নাতদন্তের কাজ চলছে। ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের কাছে লাশ হস্তান্তর এবং একই সঙ্গে পরিবারের পক্ষ থেকে মামলার প্রস্তুতি চলছে।
নৌ-পুলিশ সুপার সৈয়দ মুশফিকুর রহমান বলেন, জাহাজের ঘটনাটি ডাকাতি বলে মনে হয়নি। আমাদের কাছে মনে হয়েছে এটি একটি নৃশংস হত্যাকাণ্ড। প্রত্যেকটি মরদেহ আলাদা রুমে রুমে পড়েছিল। যা দেখে পূর্বপরিকল্পিত মনে হয়। এরইমধ্যে অনেকগুলো ক্লু পাওয়া গেছে, যা তদন্তের স্বার্থে বলা যাচ্ছে না।
তিনি আরো বলেন, একটি পজিটিভ বিষয় হচ্ছে হাসপাতালে আহত ব্যক্তির অবস্থা এখন আগের তুলনায় অনেক ভালো। আমরা তার কাছ থেকে অনেক কিছু জানতে পারবো। ঘটনাটি যেহেতু চাঁদপুরের হাইমচরের নৌ সীমানায় পড়েছে, সেহেতু মামলাটি সেখানেই হবে। হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় মামলায় অনেক পরিবারের সদস্যরা বাদী হতে চাচ্ছেন। তাদের মধ্য থেকে একজনের সঙ্গে কথা বলে আমরা মামলাটি করবো।
জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ মোহসীন উদ্দিন বলেন, নিহত ৭ পরিবারকে জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে ২০ হাজার টাকা করে দেওয়া হবে। এই ঘটনায় নিহতদের পরিবারের থেকে থানায় মামলা হবে। এছাড়া নৌ-পুলিশের পক্ষ থেকে নগদ ১০ হাজার টাকা প্রদান করা হয়।
তিনি আরো বলেন, হত্যাকাণ্ডের ঘটনাকে কেন্দ্র করে তদন্তকারী সংস্থা আলাদা করে তদন্ত করবে। এর বাইরেও অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট, নৌ-পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার, কোস্টগার্ড কমান্ডার ও জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপারকে নিয়ে আমরা একটি তদন্ত কমিটি গঠন করেছি। ১০ দিনের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতে বলা হয়েছে।
শিল্প মন্ত্রণালয়ের জনসংযোগ কর্মকর্তা মো. আলমগীর হোসেন জানান, এমভি আল-বাখেরা জাহাজে সাত খুনের ঘটনায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিবকে আহ্বায়ক ও যুগ্ম সচিবকে সদস্যসচিব করা হয়েছে। কমিটিকে আগামী পাঁচ কর্মদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিলের নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
২৫ ডিসেম্বর, ২০২৪।