মেঘনা তীরবর্তী এলাকায় জীববৈচিত্রের সীমাহীন ক্ষতির আশঙ্কা

জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব-৫
নদীতে শুকনো, বর্ষা ও শীত মৌসুমে তাপমাত্রার তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে.
ছোট ছোট অনেক মাছ বিলুপ্তির পথে…

মাহবুবুর রহমান সুমন
জলবায়ুর বৈশ্বিক পরির্বতনের প্রভাবে সমুদ্রপৃষ্টে ব্যাপক পানি বৃদ্ধিতে বঙ্গপোসাগরের লবণাক্ত পানি দেশের নদ-নদীগুলোতে প্রবেশের কারণে নদীর মিঠা পানি ধীরে ধীরে লবণাক্ত হয়ে পড়ছে। ফলে বাংলাদেশের বৃহত্তম মেঘনা নদীর তীরবর্তী বিস্তৃর্ণ এলাকার জীববৈচিত্র এখন হুমকির মুখে রয়েছে। এখনি তা রোধের উদ্যোগ না নিলে দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতির আশঙ্কাটি উড়িয়ে দিচ্ছেন না পানি ও নদী গবেষকরা।
এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের জন্য এ এলাকার মাছ, প্রাণি, মাটি, পানি, বৃক্ষ, পরিবেশসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়গুলোকে নিয়ে আলাদা-আলাদা বিশেষজ্ঞদের গবেষণা প্রতিবেদন তৈরি ও প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ জরুরি। অন্যথায় সংশ্লিষ্ট এলাকার কৃষি, মৎস্য, বনজ সম্পদের সম্ভাব্য অর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা অসম্ভব হয়ে পরবে।
চাঁদপুর মৎস্য গবেষণা কেন্দ্রের ‘Effect of climate change on the Ecology and Biodiversity of Inland open water fishes’ ৫ বছর মেয়াদী চলমান এমন গবেষণার প্রাথমিক প্রতিবেদনে এ দাবি করছে সংশ্লিষ্টরা। গবেষকরা কেবলমাত্র মেঘনা, তেতুলিয়া ও আগুনমুখী নদীর উপর তাদের চলমান গবেষণা ফলাফলের ভিত্তিতে উদ্বেগ প্রকাশ করছে। তবে তার ক্ষতিকর প্রভাব কবে থেকে শুরু হতে পারে তা নিশ্চিত করতে না পারলেও আশঙ্কা থেকে সরে আসছেন না সংশ্লিষ্ট গবেষকরা।
মেঘনা ও তেতুলিয়া এ দু’টি নদীতে তাদের চলমান গবেষণা কার্যক্রম অব্যাহত রাখছেন। সমুদ্রের উপকূলীয় এলাকার উত্তাল ও ভয়ংকর স্রোতের আগুনমুখী নদীতে এখনো গবেষণা করা সম্ভব হয়ে উঠেনি, সংশ্লিষ্টদের আর্থিক ও দক্ষ জনবলের অভাবে। তিনটি নদীর গবেষণা কার্যক্রম শেষ হলে কেবলমাত্র মৎস্যখাতের অর্থিক ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয় করা সম্ভব হবে।
গবেষণায় মেঘনা নদী ও তেতুলিয়া নদীর লবণাক্ততার অনুপ্রবেশের চিত্রে Global Positioning System (GPS) বা বিশ্বজনীন অবস্থান নির্ণয়ক ব্যবস্থার মধ্যে মেঘনার ষাটনল, চাঁদপুর, হরিণা ঘাট, চর ভৈরবী, চর-লুধুয়া, চর-আলেকজান্ডার, রামগতি, কালিগঞ্জ, হিলসা ঘাট তেতুলিয়া নদীর ডুলিয়া ও কালিয়া এলাকায় লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। এসব এলকায় নদীতে অক্সিজেন ও কার্বন-ডাই-অক্সাইডের তারতম্য লক্ষ্য করা গেছে। এছাড়া শুকনো, বর্ষা ও শীত মৌসুমে তাপমাত্রার তারতম্যও লক্ষ্য করা গেছে।
শুকনো মৌসুমে মেঘনার ষাটনলে বাতাসের আর্দ্রতা রেকর্ড করা হয়েছে ৩১.৯ শতাংশ, চাঁদপুরে ৩০.৮, হরিণা ঘাটে ৩০.৮ চর ভৈরবীতে ৩১.৩, চর-লুধুয়ায় ৩১.১, চর-আলেকজান্ডারে ৩১.৩, রামগতিতে ৩১.৫, হিজলায় ৩১.৪ কালিগঞ্জে ৩২, তেতুলিয়ার হিলসা ঘাটে ৩২.১ ও ডুলিয়ায় ৩২।
শুকনো মৌসুমে পনির তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ষাটনলে ২৬.৫ শতাংশ, চাঁদপুরে ২৭, হরিণা ঘাটে ২৭.৬ চর ভৈরবীতে ২৭.৫, চর-লুধুয়ায় ২৬.৮, চর-আলেকজান্ডারে ২৬.৫, রামগতিতে ২৭, হিজলায় ২৮ কালিগঞ্জে ২৭.৫, তেতুলিয়ার হিলসা ঘাটে ২৮.৪ ও ডুলিয়ায় ২৭.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
বর্ষা মৌসুমে মেঘনার ষাটনলে বাতাসের আর্দ্রতা থাকে ৩১.৫ শতাংশ, চাঁদপুরে ৩০.৫, হরিণা ঘাটে ৩০.৩ চর ভৈরবীতে ৩২, চর-লুধুয়ায় ৩১.৪, চর-আলেকজান্ডারে ২৯.৫, রামগতিতে ৩১, হিজলায় ৩১.৩ কালিগঞ্জে ৩১.৬, তেতুলিয়ার হিলসা ঘাটে ৩১.৪ ও ডুলিয়ায় ৩২.৩।
বর্ষা মৌসুমে পানির তাপমাত্রা রেকর্ড অনুযায়ী ষাটনলে ২৯.১ শতাংশ, চাঁদপুরে ২৮.৫, হরিণা ঘাটে ২৯ চর ভৈরবীতে ২৯, চর-লুধুয়ায় ২৯, চর-আলেকজান্ডারে ২৭.৯, রামগতিতে ২৮, হিজলায় ২৯.১ কালিগঞ্জে ২৯.৩, তেতুলিয়ার হিলসা ঘাটে ২৮.৯ ও ডুলিয়ায় ৩০.২ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
শীত মৌসুমে মেঘনার ষাটনলে বাতাসের আর্দ্রতা থাকে ২৩.৫ শতাংশ, চাঁদপুরে ২২.৩, হরিণা ঘাটে ২৩.৫, চর ভৈরবীতে ২২.৮, চর-লুধুয়ায় ২২.৮, চর-আলেকজান্ডারে ২২.৯, রামগতিতে ২২.৩, হিজলায় ২৩.৮ কালিগঞ্জে ২২.৮, তেতুলিয়ার হিলসা ঘাটে ২২.৫ ও ডুলিয়ায় ২৪.৫।
এছাড়া শীত মৌসুমে পানির তাপমাত্রা রেকর্ড হয় ষাটনলে ২১.৮ শতাংশ, চাঁদপুরে ২১.৫, হরিণা ঘাটে ২০.৫ চর ভৈরবীতে ২১.৬, চর-লুধুয়ায় ২১.৪, চর-আলেকজান্ডারে ২০.৬, রামগতিতে ২১, হিজলায় ২২ কালিগঞ্জে ২২, তেতুলিয়ার হিলসা ঘাটে ২১ ও ডুলিয়ায় ২৩.৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস।
দু’টি নদীতেই তাপমাত্রা ও বাতাসের আর্দ্রতার তারতম্যের কারণে লবণের উপস্থিতি জানুয়ারি, ফেব্রুয়ারি, মার্চ ও এপ্রিল অর্থাৎ শুকনো মৌসুমে বেশি থাকে। যার প্রভাবে আস্তে-আস্তে নদীর পানির লবণাক্ততা বাড়ছে। গবেষকরা দাবি করছেন- প্রাকৃতিকভাবেই সমুদ্রের পানির লবণাক্ততা ৩০/৩৫ পিপিটি (পানির লবণাক্ততার পরিমাণ)। এছাড়া সমুদ্রের উপকূল এলাকায় এর মাত্রা কিছুটা কম থাকে। বর্তমানে গভীর মেঘনা নদীর পানিতে ৮ পিপিটি পর্যন্ত লবণাক্ততা পাওয়া গেছে। যা এখনো সহনীয় পর্যায়ে আছে।
গবেষকরা আরো দাবি করছে, যে কোন নদীতে যদি ১৫/১৬ পিপিটি লবণাক্ততার উপস্থিতি পাওয়া যায় কেবল তখনি ঐ নদীর পানি খাওয়ার উপযোগিতা হারাবে। সাথে সাথে মিঠা পানির মাছের জীবন প্রণালী ধ্বংস হতে থাকবে। যদিও এখনকার এই সহনীয় মাত্রায় ছোট ছোট অনেক মাছ বিলুপ্তির পথে আছে।
ঐ গবেষকরা দাবি করছেন, নদীর পানিতে যখন লবণাক্ততা বাড়ে তখন অক্সিজেনের পরিমাণ কমে। ফলে নদীর মাছসহ অন্যান্য প্রাণির বেঁচে থাকার প্রয়োজনীয় অক্সিজেন সংকট দেখা দেয়। এছাড়া পানির রাসায়ানিক তারতম্য ঘটে থাকে।
তবে চলমান এই গবেষণা অব্যাহত থাকবে বলে সংশ্লিষ্ট গবেষক ও সিনিয়র বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা তায়ফা আহমেদ জানিয়েছেন। এজন্য সরকারের অর্থ বরাদ্দসহ দক্ষ জনবলও প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। তবে প্রাথমিক পর্যায়ে প্রস্তুতি নিলে ভবিষ্যতে ক্ষতির পরিমাণ সহনীয় পর্যায়ে রাখা সম্ভব হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেছেন।

১৭ অক্টোবর, ২০১৯।