হাইমচরে ৭ খুনের মূল হোতা ইরফানের ৭ দিনের রিমান্ডে

জাহাজের মাস্টারের উপর ক্ষোভেই ৭ জনকে খুন

এস এম সোহেল
দেশব্যাপী চাঞ্চল্যকর হাইমচরে এমভি আল বাখেরা জাহাজে ৭ খুনের ঘটনায় মূল হোতা জাহাজের লস্কর আকাশ মন্ডল ইরফানকে (২৬) আটক করেছে র‌্যাব। বুধবার (২৫ ডিসেম্বর) বিকেলে র‌্যাব-১১ আটক ইরফানকে নৌ-পুলিশ সুপার কার্যালয়ে সোপর্দ করেন। পরে সন্ধ্যায় চাঁদপুর জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট মুহাম্মদ ফারহান সাদিকের আদালতে হাজির করে মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাঁদপুর নৌ-পুলিশের পরিদর্শক মো. কালাম খা ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেন।
রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী ও আদালতের এপিপি অ্যাড. শরীফ মাহমুদ সায়েম বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। তিনি বলেন, এই সেভেন মার্ডার চাঁদপুর তথা সারা বাংলাদেশে একটি আলোচিত ঘটনা। ইতোমধ্যে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় জাহাজের লস্কর আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে আটকের পর আদালতে হাজির করা হয়েছে। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ১০ দিনের রিমান্ড চাইলে আদালত ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আমরা শুনানি করেছি। এই হত্যার আরও কেউ জড়িত আছে কিনা এবং আলামত আছে কি না, তা উদ্ধারের জন্য আদালত ব্যাপক শুনানি নিয়েছে এবং তাকে ৭ দিনের রিমান্ড মঞ্জুর করেছেন। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পক্ষ থেকে বলা হয়েছে প্রাথমিকভাবে তিনি এ হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে জড়িত। তাকে ব্যাপক জিজ্ঞাসাবাদের পর আরও তথ্য বেরিয়ে আসবে বলে আশা করছি।
জামিন শুনানিকালে উপস্থিত ছিলেন এপিপি অ্যাড. মাসুদ প্রধানীয়া, অ্যাড. ইয়াসিন আরাফাত ইকরাম, অ্যাড. শাহজাহান খান এবং আইনজীবী শামিম হোসেন, মিল্টন ও তোফায়েল। তবে আসামিপক্ষে কোনো আইনজীবী ছিলেন না।
এর আগে মঙ্গলবার বাগেরহাটের চিতলমারী এলাকা থেকে আকাশ মণ্ডল ওরফে ইরফানকে আটক করা হয়। পরে গতকাল বুধবার দুপুর সোয়া ১২টায় র‌্যাব-১১ সিপিসি-২ কুমিল্লা কার্যালয়ে র‌্যাব-১১ এর উপ-অধিনায়ক মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন সংবাদ সম্মেলনে আটক বাগেরহাটের ফকিরহাট উপজেলার জগদীশ মন্ডলের ছেলে আকাশ মন্ডল ইরফানের বরাত দিয়ে ঘটনা তুলে ধরেন।
আটকের সময় তার কাছ থেকে একটি হ্যান্ডগ্লাভস, একটি লোটো ব্যাগ, ঘুমের ওষুধের খালি পাতা, নিহতদের ব্যবহৃত পাঁচটি মোবাইলসহ মোট সাতটি মোবাইল এবং রক্তমাখা নীল রঙের একটি জিন্সের প্যান্ট উদ্ধার করা হয়।
আটক আকাশ মন্ডলের বরাত দিয়ে মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন বলেন, ৮ মাস ধরে এমভি আল বাখেরা জাহাজে চাকরি করে আসছেন আকাশ মন্ডল। জাহাজের কর্মচারীরা ছুটি ও বেতন-বোনাস সময়মতো পেতো না এবং বিভিন্ন ধরনের বিল কর্মচারীদের না দিয়ে জাহাজের মাস্টার একাই ভোগ করতেন। জাহাজের মাস্টার সব কর্মচারীর ওপর বিনা কারণে রাগারাগি করতেন এবং কারও ওপর নাখোশ হলে কোনো বিচার-বিবেচনা ছাড়াই তাকে জাহাজ থেকে নামিয়ে দিতেন। এমনকি তাদের বকেয়া বেতনও দেওয়া হতো না।
এ ব্যাপারে আকাশ জাহাজের সবাইকে প্রতিবাদ করতে বললে কেউ ভয়ে প্রতিবাদ করতো না। ফলে আকাশের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি হয় এবং এই ক্ষোভ থেকে তাকে উচিত শিক্ষা দেওয়ার পরিকল্পনা করেন তিনি। সেই অনুযায়ী ১৮ ডিসেম্বর তিন পাতা ঘুমের ওষুধ কিনে নিজের কাছে রেখে দেন।
ঘটনার দিন সন্ধ্যায় জাহাজে রাতের খাবারের তরকারির মধ্যে তিন পাতা ঘুমের ওষুধ মিশিয়ে দেন। শুধু সুকানি জুয়েল এবং আটক আকাশ ছাড়া সবাই রাতের খাবার খেয়ে তাদের নিজ কেবিনে ঘুমিয়ে পড়েন। রাত আনুমানিক ২টায় ৮-১০টি জাহাজের সঙ্গে সুকানি জুয়েল এবং আটক আকাশ তাদের জাহাজটি নোঙর করেন। পরে সুকানি জুয়েল রাতের খাবার খেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে আকাশ তার পরিকল্পনা মোতাবেক আনুমানিক রাত সাড়ে ৩টায় প্রথমে মাস্টারকে জাহাজে থাকা চাইনিজ কুড়াল দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করেন। পরে চিন্তা করেন, জাহাজে থাকা বাকিরা জেনে গেলে তিনি আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী কর্তৃক ধরা পড়বেন। ফলে একে একে সবাইকে কুপিয়ে হত্যার চেষ্টা করেন।
আনুমানিক ভোর সাড়ে ৫টায় সব জাহাজ তাদের গন্তব্যের উদ্দেশে ছেড়ে গেলে তিনি নিজে জাহাজ চালাতে থাকেন এবং এক পর্যায়ে মাঝিরচর এলাকায় জাহাজটি আটকা পড়লে পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া ট্রলারে বাজার করার কথা বলে ওঠে পালিয়ে যান।
পরে তিনি গ্রেফতার এড়াতে বাগেরহাটের চিতলমারি এলাকায় আত্মগোপনে চলে যান। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করে র‌্যাব ওই এলাকা থেকে তাকে আটক করে।
প্রাথমিকভাবে জিজ্ঞাসাবাদে ওই ঘটনায় তিনি একাই জড়িত বলে জানা যায়। পরে অধিকতর তদন্তের মাধ্যমে বিষয়টি আরও নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে মেজর মোহাম্মদ সাকিব হোসেন জানান।
এদিকে মঙ্গলবার (২৪ ডিসেম্বর) রাতে জাহাজ মালিকের পক্ষে মো. মাহবুব মোরশেদ বাদী হয়ে হাইমচর থানায় মামলা করেন। মাহবুব মোরশেদের বাড়ি ঢাকার দোহার এলাকায়। এতে খুন ও ডাকাতির অভিযোগ এনে অজ্ঞাত ৮ থেকে ১০ জনকে অজ্ঞাত আসামি করা হয়।
উল্লেখ্য, গত সোমবার দুপুরে হাইমচরে মেঘনা নদীতে এমভি আল বাখেরা জাহাজ থেকে সাতজনের রক্তাক্ত মরদেহ উদ্ধার করা হয়। এ ঘটনায় গতকাল রাতে হাইমচর থানায় হত্যা ও ডাকাতির অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে জাহাজটির মালিক মাহবুব মোর্শেদ মামলা করেন। নিহতরা হলেন- জাহাজের মাস্টার ফরিদপুরের সদর উপজেলার মো. গোলাম কিবরিয়া (৬৫), তার ভাগনে জাহাজের লস্কর শেখ সবুজ (৩৫), সুকানী নড়াইলের লোহাগড়ার আমিনুল মুন্সী (৪০), লস্কর মাগুরার মোহাম্মদপুরের মো. মাজেদুল ইসলাম (১৭), একই এলাকার লস্কর সজিবুল ইসলাম (২৬), নড়াইলের লোহাগড়ার ইঞ্জিনচালক মো. সালাউদ্দিন মোল্লা (৪০) ও মুন্সিগঞ্জ শ্রীনগর থানার জাহাজের বাবুর্চি রানা (২০)।
এ ঘটনায় গত মঙ্গলবার রাতে হাইমচর থানায় হত্যা ও ডাকাতির অভিযোগে অজ্ঞাতনামা ব্যক্তিদের আসামি করে মামলা করেন জাহাজটির মালিক মাহবুব মোর্শেদ।

২৬ ডিসেম্বর, ২০২৪।