হাজীগঞ্জে পানিবন্দি অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষের চরম দুর্ভোগ

মাছের ঘের ভেসে কয়েকটি কোটি টাকার ক্ষতি

মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
আষাঢ়ের শেষের দিকে খাল, বিল, নদী, নালাসহ চারিদিকে এমনিতেই পানি থাকে। তার উপর ভাদ্রের শুরুতেই দেশের কুমিল্লা, ফেনী, লক্ষ্মিপুর ও নোয়াখালী এলাকা বন্যার পানিতে নিমজ্জিত। বর্ষা আর বান ও টানা বৃষ্টির পানিতে প্লাবিত হচ্ছে হাজীগঞ্জ উপজেলা। বন্যা না হলেও হাজীগঞ্জের প্রায় অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। এতে উপজেলার বিভিন্ন আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছেন ৫ শতাধিক মানুষ।
এর মধ্যে ভারতের বিহারের গঙ্গায় পানির স্তর অস্বাভাবিক বেড়ে যাওয়ায় পশ্চিমবঙ্গের মুর্শিদাবাদ জেলার ফারাক্কা ব্যারেজের ১০৯টি গেটের সবগুলো খুলে দেওয়ায় বেড়েছে পদ্মা নদীর পানি। এর প্রভাবে চাঁদপুর জেলার বিভিন্ন অঞ্চলসহ হাজীগঞ্জেও নতুন করে প্লাবিত হচ্ছে বিভিন্ন এলাকা। পানিতে তলিয়ে যাচ্ছে বাড়ির পথঘাটসহ গ্রামীণ সড়ক। তবে কারো বসতঘরে পানি না উঠলে অনেকের বাড়ির উঠান পানিতে টইটম্বুর।
হাজীগঞ্জ পৌরসভা ও ১২টি ইউনিয়নসহ উপজেলায় ৫ লক্ষাধিক জনসংখ্যা রয়েছে। এর মধ্যে অর্ধ-লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দি। তবে সরকারি হিসেবে গতকাল পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি। এর মধ্যে আশ্রয় কেন্দ্রে আছেন ৫ শতাধিক মানুষ। এর মধ্যে গন্ধর্ব্যপুর উত্তর, গন্ধর্ব্যপুর দক্ষিণ ও বড়কুল পূর্ব ইউনিয়নের সবচে বেশি মানুষ পানিবন্দি হয়ে পড়েছেন। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ফসলি ও শাকসবজির জমিসহ বিভিন্ন মাছের ঘের।
গত দুই দিন বিভিন্ন এলাকা পরিদর্শনে দেখা যায়, ইউনিয়ন পর্যায়ে অনেক গ্রামীণ সড়ক পানির নিচে। পথঘাট, মানুষের ঘর-দুয়ার, বাড়ির আঙিনায় পানি থৈথৈ করছে। হাঁস-মুরগি ও গবাদি পশু নিয়ে মানুষ বিপাকে। কেউ কেউ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিলেও অনেকেই বাড়ি ফেলে আসতে চাননি। তারা পানির মধ্যেই বসবাস করছেন। পথঘাট ও সড়কের বিভিন্ন অংশ পানিতে তলিয়ে যাওয়ার ফলে ঝুঁকি নিয়ে চলাচল করছে লোকজন।
এবারের পানিতে কৃষি ক্ষেত্রে তেমন কোনো ক্ষতি না হলেও নিঃস্ব হয়েছেন প্লাবিত এলাকার মৎস্য ও পোনা চাষিরা। বর্ষায় স্বাভাবিক পানি বৃদ্ধির কথা মাথায় রেখে পুকুরসহ ঘেরের চারপাশে নেট জাল দিয়ে মাছ রক্ষার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু অস্বাভাবিক পানি বৃদ্ধি বৃদ্ধি ও স্রোতের তোড়ে সেই জাল ছিঁড়ে মাছ ভেসে গেছে। চাষীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, এতে কয়েক কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে এবং অনেকে হয়েছেন নিঃস্ব।
গত এক সপ্তাহ ধরে এমন অবস্থা চললেও পরিস্থিতি এখন পর্যন্ত কোনো উন্নতি হয়নি। বরং নতুন করে কিছু এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। মঙ্গলবার ও গতকাল বুধবার উপজেলার রাজারগাঁও ও দ্বাদশগ্রাম ইউনিয়নসহ কালচোঁ উত্তর ইউনিয়নের কয়েকটি গ্রাম প্লাবিত হয়েছে। এছাড়াও হাজীগঞ্জ পৌরসভাসহ কালচোঁ দক্ষিণ, সদর, বড়কুল পশ্চিম, হাটিলা পূর্ব, হাটিলা পশ্চিম ও বাকিলা ইউনিয়নের কিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে গেছে।
এদিকে পানিবন্দি এলাকায় ত্রাণ বিতরণ অব্যাহত রয়েছে। উপজেলা প্রশাসন, বিভিন্ন রাজনৈতিক দল, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন ও স্বেচ্ছাসেবকসহ ব্যক্তিবিশেষ পানিবন্দি মানুষকে সহায়তা করে যাচ্ছেন। কেউ চাল, ডাল, আলু, তেল ও পেঁয়াজসহ শুকনো খাবার, কেউ আবার রান্না করা খাবার, বিশুদ্ধ পানি, খাবার স্যালাইন, পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেট ও দিয়াশলাই বিভিন্ন উপকরণ নিয়ে দুর্গত মানুষের সেবায় কাজ করছেন।
এর মধ্যে গত কয়েকদিন ধরে বিএনপি, জামায়াত, ইসলামী আন্দোলনের নেতৃবৃন্দকে ত্রাণ সামগ্রী বিতরণ করতে দেখা গেছে। এছাড়া ছাত্রসমাজ, রোটারী ক্লাব অব বাংলাদেশ ও লাল-সবুজ স্বেচ্ছাসেবী টিমসহ বিভিন্ন সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন এবং ব্যক্তি ও দলগত উদ্যোগে প্লাবিত এলাকার মানুষের পাশে দাঁড়িয়েছেন।
মুন্সী মোহাম্মদ মনির নামের হাজীগঞ্জের একজন মৎস্য চাষি এবং পোনা উৎপাদনকারীর সাথে কথা হয়। তিনি জানান, তাঁর ২০/২২টি পুকুর রয়েছে। এরমধ্যে সবগুলো পুকুর তিনি লিজ (ভাড়া) নিয়ে মাছ চাষ ও পোনা উৎপাদন করে থাকেন। দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের বন্যা এবং বর্ষা ও অতিরিক্ত বৃষ্টির কারণে তারসহ শত শত মৎস্য চাষি ও পোনা উৎপাদনকারীর পুকুর ভেসে গেছে। এতে তিনি প্রায় কোটি টাকার ক্ষতির শিকার হয়েছেন।
পানিবন্দি মানুষের জন্য খাদ্য সহায়তা করা হচ্ছে উল্লেখ করে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাপস শীল বলেন, গতকাল বুধবার পর্যন্ত প্রায় ৪০ হাজার মানুষ পানিবন্দি অবস্থায় আছেন। এর মধ্যে ৪০৭ জন মানুষ আশ্রয় কেন্দ্রে অবস্থান নিয়েছে। উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এ পর্যন্ত ৩৮.৫০ মেট্রিক টান চাল ও ১ লাখ ৭০ হাজার টাকার শুকনো খাবার বিতরণ করেছি এবং আমাদের ত্রাণ কার্যক্রম চলমান রয়েছে।

২৯ আগস্ট, ২০২৪।