হাজীগঞ্জে বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষাহীন মাদ্রাসা শিক্ষা

পিছিয়ে পড়ছে শিক্ষার্থীরা

মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
বর্তমান যুগ বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার যুগ। বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষা মানুষকে দিয়েছে অভাবনীয় গতি। সভ্যতার অগ্রযাত্রাকে করেছে দ্রুততর ও বহুমাত্রিক। বিজ্ঞানের নব নব আবিস্কারে এবং তথ্য প্রযুক্তির যাদুকরী স্পর্শে মানবজীবনের সর্বত্র এসেছে বৈপ্লবিক পরিবর্তন। সর্বক্ষেত্রে পরিলক্ষিত হচ্ছে বিজ্ঞান ও তথ্য প্রযুক্তির জয়যাত্রা।
উন্নত বিশ্ব থেকে যদিও আমরা পিছিয়ে রয়েছি। তবে গত এক দশকে আমরা আর পিছিয়ে নেই। বঙ্গবন্ধুর সুযোগ্য কন্যা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশ দুর্বার গতিতে এগিয়ে যাচ্ছে। সমতালে এগিয়ে যাচ্ছে দেশের প্রতিটি সেক্টর বা বিভাগ। সরকার ভিশন ২১ ও ৪১ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে আমাদের উন্নত বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখিয়েছেন।
সরকারের ভিশন বাস্তবায়নের লক্ষ্যে পরিকল্পনা অনুযায়ী কাজ চলমান রয়েছে। ইতোমধ্যে আমরা উন্নয়নশীল দেশে উন্নীত হয়েছি। এগিয়ে যাচ্ছি মধ্যম আয়ের দেশের পথে এবং ধাপে ধাপে উন্নীত হবো উন্নত বাংলাদেশে। আজকের প্রজন্মকে উন্নত বাংলাদেশের কান্ডারি হতে হবে। এজন্য প্রয়োজন দক্ষ ও যোগ্যতাসম্পন্ন মানবসম্পদ। তাই সরকার গুরুত্ব দিয়েছে বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি।
ইতোমধ্যে দেশের সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের অবকাঠামোগত উন্নয়নসহ বিজ্ঞান, তথ্য-প্রযুক্তি প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদী বিতরণ করা হয়েছে। যা এখনো চলমান রয়েছে। হাজীগঞ্জের মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে বিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও সব প্রতিষ্ঠানে নেই কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা।
এ ক্ষেত্রে একেবারেই পিছিয়ে রয়েছে হাজীগঞ্জের মাদ্রাসাভিত্তিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো। উপজেলার ২৩টি মাদ্রাসার মধ্যে ২০টি মাদ্রাসায় নেই বিজ্ঞান বিভাগ। মাত্র ৩টি মাদ্রাসা বিজ্ঞান বিভাগ থাকলেও ২৩টি মধ্যে কোনটিতেই নেই কারিগরি শিক্ষা ব্যবস্থা। যার ফলে একপ্রকার বাধ্য হয়ে মানবিক বিভাগ পড়তে হয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের।
অথচ ইতোমধ্যে সরকার সব মাদ্রাসায় ল্যাপটপ, প্রজেক্টরসহ বেশ কয়েকটি মাদ্রাসায় বিজ্ঞানের সরঞ্জাম বিতরণ করেছে। কিন্তু বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায়, এসব সরঞ্জামাদী অব্যবহৃত রয়ে গেছে। এতে একদিকে বঞ্চিত হয়েছে শিক্ষার্থীরা, অন্যদিকে এসব সরঞ্জামাদী অব্যবহৃতের ফলে একসময় নষ্ট হয়ে যাবে।
উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তার কার্যালয়ের সূত্রে জানা যায়, উপজেলার ২৩টি মাদ্রাসার মধ্যে ১টি কামিল (¯œাতকোত্তর) মাদ্রাসা ১টি, ফাজিল (ডিগ্রি) ৯টি, আলিম ৩টি এবং দাখিল মাদ্রাসা রয়েছে ১০টি। এর মধ্যে শুধু বিজ্ঞান বিভাগ রয়েছে হাজীগঞ্জ আহমাদিয়া কামিল মাদ্রাসা, রাজারগাঁও ফাজিল মাদ্রাসা ও বেলচোঁ কারিমাবাদ ফাজিল মাদ্রাসায়।
আবার এই ২৩টি মাদ্রাসার মধ্যে কোনটিতে কারিগরি বিভাগ নেই। মাদ্রাসাগুলোর মধ্যে হাজেরা আলী ক্যাডেট দাখিল মাদরাাসা ও আলী আহমেদ ইসলামিয়া একাডেমিক দাখিল মাদ্রাসা ছাড়া বাকি ২১ টি মাদ্রাসা এমপিওভূক্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান।
এ ব্যাপারে কয়েকজন সচেতন অভিভাবকের সাথে কথা হলে তারা জানান, বিজ্ঞানের এই চরম উৎকর্ষতার যুগে মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিভাগ নেই তা হতাশাজনক। তারা বলেন, সরকার যেখানে বিজ্ঞান, তথ্য প্রযুক্তি ও কারিগরি শিক্ষার প্রতি গুরুত্বরোপ করেছে, সেখানে মাদ্রাসাগুলো কেন পিছিয়ে থাকবে। এ ক্ষেত্রে মাদ্রাসাগুলোর সদিচ্ছার অভাব বলে তারা মনে করেন।
তারা আরো বলেন, শহর কেন্দ্রিক মাদ্রাসাগুলোর শিক্ষার্থীরা মেডিকেল, বুয়েট, চুয়েট কিংবা ঢাবির বিশ্ববিদ্যালয়সহ অন্যান্য পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে অনেক ভালো করছে। উপজেলা পর্যায়ে কেন এমন হবে, তা বোধগম্য নয়। আমরা আশা করি, সরকার মাদ্রাসাগুলো বিজ্ঞান ও কারিগরি শিক্ষা বাধ্যতামূলক করে দিবে।
নাম প্রকাশ অনিচ্ছুক ফাজিল মাদ্রাসার একজন অধ্যক্ষ জানান, মফস্বলের মাদ্রাসাগুলোতে গরিব আর অপেক্ষকৃত কম মেধাবীরা পড়তে আসে। এখানে বিজ্ঞান বিভাগ না থাকায়, তারা (শিক্ষার্থীরা) মানবিকে ভর্তি হয়ে যায়। আবার অনেকে বিজ্ঞান বিভাগের প্রতি নিরোৎসাহীত করে। তিনি বলেন, মাঝে মধ্যে অনেক শিক্ষার্থী বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হতে না পারলে অন্যত্র চলে যায়, এমন রেকর্ড আমাদের রয়েছে।
বাকিলা ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. ওমর ফারুক বলেন, আমরা মন্ত্রণালায়ে গিয়েছি, আমাদের বলা হয়েছে একটা অধ্যাদেশের মাধ্যমে তা হবে যাবে। অপর এক প্রশ্নে তিনি বলেন, বছরে শুরুতে বিজ্ঞানে ভর্তির জন্য যারাই আসে, তাদের বলে কয়ে আমরা মানবিকে ভর্তি করিয়ে দেই।
সাদ্রা হামিদিয়া ফাজিল (ডিগ্রি) মাদ্রাসার অধ্যক্ষ মো. আবু বকর জানান, আমাদের এখানে একাডেমিক ভবন এবং পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী না থাকায় বিজ্ঞান বিভাগ খুলতে সমস্যা হচ্ছে। সম্প্রতি সময় স্থানীয় সংসদ সদস্য মেজর অব. রফিকুল ইসলাম বীর উত্তম এমপি নতুন ভবনের জন্য ডিউ লেটার দিয়েছেন। সেই ভবনের কাজ শেষ হলেই আমরা বিজ্ঞান বিভাগ চালু করবো।
বাংলাদেশ মাদ্রাসা জেনারেল টিচার্স অ্যাসোসিয়েশন হাজীগঞ্জ উপজেলা শাখার সভাপতি আরিফ ইমাম মিন্টু জানান, এক্ষেত্রে মুখ্য ভূমিকা রাখবেন মাদ্রাসা প্রধান। তিনি বলেন, অধিকাংশ প্রধানই বিজ্ঞানমনষ্ক নন এবং অনেকে এ ব্যাপারে আগ্রহী নয়। অথচ সরকার মাদ্রাসা শিক্ষাকে আধুনিকায়ন করেছে। স্কুল কলেজের অনুরুপ পাঠক্রমে ও নম্বর বিভাজনে পরীক্ষায় সমান নম্বরে অবতীর্ণ হতে হয় মাদ্রাসা শিক্ষার্থীদের। সরকারের এই উদ্যোগ কার্যকর করতে হলে মাদ্রাসায় বিজ্ঞান বিভাগ চালু করা জরুরি। প্রশাসনিক পদে জেনারেল শিক্ষকদের সুযোগ দেয়া হলে এ দুরাবস্থার অবসান ঘটবে বলে তিনি মত প্রকাশ করেন।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন মাদ্রাসা শিক্ষক বলেন, বিজ্ঞান শিক্ষায় গুরুত্ব দেয়া হলে, শিক্ষার্থীরা ফাজিল, কামিল নাও পড়তে পারে। তাতে করে মাদ্রাসায় আলেম সৃষ্টিতে বিঘœ ঘটবে। তাছাড়া বিজ্ঞান বিভাগ চালু থাকলে জেনারেল শিক্ষকের সংখ্যা বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা থেকেও তাঁরা বিজ্ঞান শিক্ষার ব্যাপারে আগ্রহ খুবই কম।
এ ব্যাপারে উপজেলা মাধ্যমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মো. মোস্তাফিজুর রহমান মিন্টু জানান, মাদ্রাসাগুলোতে বিজ্ঞান ও কারিগরি বিভাগ খুলতে চাইলে শিক্ষাবোর্ডে আবেদন করতে হবে। বোর্ড বিবেচনা সাপেক্ষে অনুমোদন দিবে এবং শিক্ষকসহ প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। তারা (মাদ্রাসা কর্তৃপক্ষ) উদ্যোগ নিলে, আমরা দাপ্তরিক পূর্ণাঙ্গ সহযোগিতা করবো। এক্ষেত্রে তাদের সদিচ্ছা প্রয়োজন।