অনলাইনে বিক্রিকৃত রসের মান নিয়ে প্রশ্ন!
মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
এক সময় গ্রামের মাঠে আর মেঠো-পথের ধারে সারি সারি খেজুর গাছ দাঁড়িয়ে থাকতো। এতে দৃষ্টিনন্দন ও সৌন্দয্যবর্ধনের পাশাপাশি শীতকালে খেজুরের রস সংগ্রহ ও রসের তৈরি পিঠা-পায়েস, গুঁড় আর মুড়ি-মুড়কিতে উৎসব আনন্দে ভরে উঠতো গ্রামাঞ্চলের প্রতিটি বাড়ি-ঘর। কিন্তু কালের আবর্তে হারিয়ে যাচ্ছে সেই দিনগুলো। অনেকটা বিলুপ্তির পথে সেই খেজুর গাছ ও খেজুরের রস। অনেকটা নেই বললেই চলে।
এর কারণ হিসেবে স্থানীয়রা প্রাকৃতিক কারণ, জ্বালানির জন্য নির্বিচারে গাছ কাটা, গ্রামীণ রাস্তা প্রশস্তকরণ, আবাদি জমি এবং রাস্তার পাশে বসতভিটা ও দোকানঘর নির্মাণ, আবার এখনো যে কটি গাছ রয়েছে, তার রক্ষণাবেক্ষণ ও গাছি না পাওয়া, গাছ থেকে রস চুরি করে নিয়ে যাওয়ার কারণেও অনেকে খেজুর গাছ কেটে অন্য গাছ রোপণ ও নতুন করে খেজুর গাছের চারা রোপণ না করাকে দায়ী করছেন।
এদিকে নিজ উপজেলা খেজুর গাছ ও রস বিলুপ্তি দেখা দিলেও হাট-বাজারে রসের কিন্তু অভাব নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকের কল্যাণে চাইলে অহরহ রস হাতের কাছে পাওয়া যায়। উপজেলার বেশ কয়েকজন ব্যক্তি খেজুর রস বিক্রি করতে দেখা গেছে। কথা হয়, অনলাইনে রস বিক্রেতা একাধিক ব্যক্তির সাথে। তারা জানান, উত্তরবঙ্গ থেকে খেজুর রস এনে বিক্রি করেন। তবে মান নিয়ে রয়েছে প্রশ্ন!
সম্প্রতি উপজেলার বিভিন্ন অঞ্চল ঘুরে দেখা গেছে, প্রত্যন্ত অঞ্চলে গ্রামের মাঠে আর মেঠোপথের ধারে এখনো কিছু গাছ দাঁড়িয়ে আছে কালের সাক্ষী হয়ে। এর মধ্যে রাজারগাঁও, বাকিলা, কালচোঁ উত্তর, কালচোঁ দক্ষিণ, বড়কুল পূর্ব, বড়কুল পশ্চিম, হাটিলা পূর্ব, হাটিলা পশ্চিম, গন্ধর্ব্যপুর উত্তর, গর্ন্ধব্যপুর দক্ষিণ ইউনিয়ন দ্বাদশগ্রাম ইউনিয়নে কিছু কিছু রয়েছে। তবে হাজীগঞ্জ সদর ইউনিয়ন ও পৌর এলাকায় নেই বললেই চলে।
স্থানীয়রা জানান, গাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। তারপরও যে কয়টা গাছ রয়েছে, তার মধ্যে কিছু গাছের পরিচর্যা করে হারিয়ে যাওয়া ঐতিহ্যকে ধরে রাখার চেষ্টা করে যাচ্ছে অনেকে। দেখা গেছে, যে কয়টা গাছ আছে তার মধ্যে কিছু গাছ রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা হয়েছে। কিছু গাছ পরিচর্যাহীন অবস্থায় পড়ে আছে। আবার গাছির অভাবে কিছু গাছ রস সংগ্রহের জন্য প্রস্তুত করা যায়নি।
দ্বাদশগ্রাম ইউনিয়নের আবুল কালাম নামের সত্তরোর্ধ্ব একজন বৃদ্ধ বলেন, কাঁচা রসের পায়েস খাওয়ার কথা এখনো মনে পড়ে। আমাদের নাতি-নাতনীরা তো আর সেই খেজুরের রস, রসের তৈরি গুড়, পিঠা-পুলি ও পায়েস, দুধ-চিতই খেতেই পায় না। তারপরেও বছরে অন্তত একবার হলেও রসের তৈরি পায়েস রান্নার চেষ্টা করি।
পৌরসভাধীন টোরাগড় গ্রামের ষাটোর্ধ্ব আনোয়ার হোসেন আনু জানান, এক সময় এক হাড়ি খেজুর রস কিনতাম ২০ টাকা দিয়ে। ৫/৭ বছর আগেও ২০০ টাকা দিয়ে কিনেছি। কিন্তু এখন খেজুর গাছ না থাকায় সে রসের দাম বেড়ে ৬০০ টাকা হয়েছে।
বাকিলা ইউনিয়নের দিঘই গ্রামের গাছি মো. সফি উল্যাহ জানান, আশপাশে গ্রামের গাছগুলো রসের জন্য তিনিই প্রস্তুত করে থাকেন। বিনিময়ে একদিন পর-পর তিনি ও গাছের মালিক পক্ষ রস নিয়ে থাকেন। অর্থাৎ মাসের পনের রস তিনি নেন এবং পনের দিন গাছের মালিক পক্ষ নিয়ে থাকেন। তিনি বলেন, এক হাঁড়ি রস ৬শ’ টাকা বিক্রি হয়। আর এক হাঁড়িতে ৫ লিটার রস থাকে বলে তিনি জানান।
অপরদিকে অনলাইনে রস ক্রেতা ফারুক হোসেন নামের এক ব্যক্তি জানান, আমরা তো নিজ চোখে দেখি না এবং কোন এলাকার রস, তাও জানি না। যার কারণে, মান নিয়ে কিছুটা দ্বিধাবোধ থেকে যায়। তারপরও কি করবো, যেহেতু আমাদের এলাকায় খেজুর রস পাওয়া যায় না, তাই অনলাইন থেকে কিনতে হয়।
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক এক বিক্রেতা বলেন, আমরা বিশ^াসের উপর রস ও গুড় কিনে আনি। আবার মানুষও বিশ^াসের উপর আমাদের কাছ থেকে কিনে নেয়। এসময় তিনি জানান, গত কয়েকদিনে তিনি ১ হাজার লিটারের বেশি রস বিক্রি করেছেন।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. আহমেদ তানভীর হাসান বলেন, খেজুরের রসে গ্লকোজ ও ফ্রুক্টোজ সমৃদ্ধ, যা তাৎক্ষণিক শক্তি জোগায়। এতে আয়রন, পটাশিয়াম, ম্যাগনেসিয়াম এবং ভিটামিন বি থাকে, যা উপকারী। এছাড়া খেজুরের রসে প্রাকৃতিক এনজাইম রয়েছে, যা হজম প্রক্রিয়াকে সহজ করে।
তিনি বলেন, তবে খেজুরের রস দ্রুত ফরমেন্টেড হয়ে টডি (অ্যালকোহলিক পানীয়) এ পরিণত হয়। তাই দীর্ঘ সময় রেখে দিলে এটি পান করলে ক্ষতি হতে পারে। ডায়াবেটিক রোগীদের এটি সাবধানে খেতে হবে, কারণ রসে প্রাকৃতিক চিনি থাকে। তাছাড়া খেজুরের রস ভালোভাবে ফুটিয়ে খেতে হবে। এতে নিপাহ ভাইরাস মরে যায়। কিন্তু না ফুটিয়ে কাঁচা রস পান করলে, নিপাহ ভাইরাস এনসেফালাইটিস হওয়ার ঝুঁকি রয়ে যায়।
ভেজালের বিষয়ে ডা. আহমেদ তানভীর হাসান বলেন, খেজুর রসের সঙ্গে চিনি মিশিয়ে জ্বাল দিলে মিশ্রণটি বিষক্রিয়ার সৃষ্টি করে এবং খাদ্যদ্রব্য তৈরি করে খেলে তা থেকে পেটের পীড়াজনিত নানা সমস্যা দেখা দিতে পারে।
৩০ ডিসেম্বর, ২০২৪।