নিষিদ্ধ রঙ ও কেমিক্যাল ব্যবহারের অভিযোগ
মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
হাজীগঞ্জে নিম্নমানের বেকারী পণ্যে বাজার সয়লাব হয়ে গেছে। একদিকে উপজেলার বিভিন্ন বেকারিতে উৎপাদন, অপরদিকে দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে পাইকারি দরে আনা খোলা বিস্কুট, চানাচুর, কেক ও পাউরুটিসহ নিম্নমানের বেকারী পণ্য বিক্রি হচ্ছে। উৎপাদিত এসব বেকারী পণ্য তৈরিতে কাপড়ের রঙ, হাইড্রোজ ও কৃত্রিম সুগন্ধি ব্যবহারের অভিযোগ করেন ভোক্তারা। এরমধ্যে রঙয়ের বিষয়টি অনেকটা খালি চোখেই নজরে আসে।
অতি মুনাফার লোভে মানবদেহের জন্য এসব নিষিদ্ধ রঙ, হাইড্রোজ ও কৃত্রিম সুগন্ধি ব্যবহার করছেন বলে সচেতন ভোক্তা ও ক্রেতা সাধারণের অভিযোগ। নির্ধারিত গুণগত মান রক্ষা করে বেকারিতে তৈরি খাবার প্রস্তুত করা বাধ্যতামূলক হলেও হাতেগোনা কয়েকটি প্রতিষ্ঠান ছাড়া অধিকাংশ বেকারিতে এই মান রক্ষা করা হচ্ছে না।
ভ্রাম্যমাণ আদালত ও ভোক্তা অধিকারের অভিযানে স্থানীয় বা উপজেলা পর্যায়ে এসব বেকারিতে অভিযান হলেও তৈরিকৃত খাবারে ভেজাল রোধ করা যাচ্ছে না। বিশেষ করে স্থানীয় পর্যায়ের বেকারীগুলোতে এসব অভিযান পরিচালিত হলেও উপজেলা বা জেলার বাইরে থাকা আনা পণ্যের ক্ষেত্রে কোন তদারকি নেই।
যার ফলে খাদ্য আইন লঙ্ঘন করে অসাধু ব্যবসায়ীরা অতিরিক্ত মুনাফার লোভে নিষিদ্ধ রঙ, হাইড্রোজ ও কৃত্রিম সুগন্ধি ব্যবহার করছেন। তাছাড়া নিয়মানুযায়ী বেকারি শ্রমিকদের খাদ্য তৈরির সময় মুখে মাস্ক, গায়ে অ্যাপ্রোন ও হাতে গ্লাভস্ পরে খাবার বানানো উচিত। কিন্তু উপজেলার বেশিরভাগ বেকারীতে এই দৃশ্য চোখে পড়ে না। এছাড়া বেকারিতে খাবার সঠিকভাবে সংরক্ষণ না করায় খাবারে পচন ধরে এবং ফাঙ্গাস পড়ে।
বাজার ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন কনফেকশনারী, মুদি ও চা দোকানে এমনকি ভ্যানগাড়ি করে গ্রাম এলাকায় স্থানীয়ভাবে বেকারী কর্তৃক উৎপাদিত প্যাকেটজাত এবং খোলা প্যাকেটে কেক, বিস্কুট ও পাউরুটি, চানাচুরসহ বিভিন্ন ধরনের বেকারী পণ্য বিক্রি করা হচ্ছে। এসব পণ্যের মধ্যে বেশিরভাগ প্যাকেটে বাংলাদেশ স্ট্যান্ডার্স অ্যান্ড টেস্টিং ইনস্টিটিউশনের (বিএসটিআই) লোগো নেই। অর্থাৎ বিএসটিআই’র অনুমোদন নেই।
এছাড়া অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে নিম্নমানের বেকারি পণ্য তৈরি করার অভিযোগ রয়েছে। এই পণ্যগুলো অনেকটা কম দামেও বিক্রি করা হয়। এতে করে গ্রাহক চাহিদা বেশি হওয়ায় বাজার সয়লাব হচ্ছে নিম্নমানের বেকারী পণ্যগুলো। যা খেয়ে স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছেন ভোক্তারা। এতে করে পেটের পীড়াসহ পাকস্থলী, লিভার ও কিডনিতে জটিল রোগের সৃষ্টি এবং ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়।
‘বিশুদ্ধ খাদ্য আইন’ অধ্যাদেশের ২৪ নম্বর ধারার ৩ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, কনফেকশনারির ছাদ, মেঝে, জানালা, দরজা ও অন্যান্য অংশ অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। ৪ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, এসব স্থান কোনো মানুষের নিদ্রার স্থান হিসেবে ব্যবহার করা যাবে না। ৫ নম্বর উপধারায় বলা হয়েছে, বেকারি-কনফেকশনারিতে অবশ্যই প্রয়োজনীয় আলো-বাতাসের ব্যবস্থা থাকতে হবে।
এছাড়া অধ্যাদেশের ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, এই কাজে নিয়োজিতদের অবশ্যই পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন বস্ত্র পরিধান করতে হবে। ২৫ নম্বর ধারায় বলা হয়েছে, কুষ্ঠ, টিউমার, চর্মরোগে আক্রান্ত কোনো ব্যক্তি বেকারির খাদ্য প্রস্তুত বা স্পর্শ করতে পারবে না। কিন্তু বাস্তবে এই আইনের কোনো প্রয়োগ নেই বা তা প্রমাণেরও কোন সুযোগ নেই।
খোরশেদ আলম মিয়াজী নামের একজন ভোক্তার সাথে কথা হলে তিনি বলেন, খাদ্যদ্রব্যে হাইড্রোজ আছে তা তাৎক্ষণিক শনাক্ত করার কোনো ব্যবস্থা নেই। তবে পরীক্ষা করলে খাদ্যে নিষিদ্ধ হাইড্রোজ ব্যবহারের অস্তিত্ব পাওয়া যাবে বলে জানান তিনি। এসময় তিনি খোলা পণ্যের বিষয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নজরদারি বৃদ্ধি ও নিয়মিত অভিযান পরিচালনা এবং ক্রেতাদের সচেতন হওয়ার আহবান জানান।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার-পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. গোলাম মাওলা নঈম বলেন, খাদ্যপণ্যে নিষিদ্ধ রঙ বা কেমিক্যাল ব্যবহারের কারণে পেটের পীড়া, এসিডিটি, আমাশয়, পাকস্থলী, লিভার ও কিডনিতে জটিল রোগের সৃষ্টি হয়। এছাড়া মানবদেহে ক্যানসারের মতো মারাত্মক রোগে আক্রান্ত হওয়ার আশঙ্কা বেড়ে যায়। তিনি ভোক্তাদের নিরাপদ ও স্বাস্থ্যসম্মত খাদ্যগ্রহণের আহবান জানান।
ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর চাঁদপুরের সহকারী পরিচালক নুর হোসেন রুবেল জানান, ভোক্তা অধিকার রক্ষায় নিয়মিত অভিযান পরিচালনা ও কোন ভোক্তার লিখিত অভিযোগ থাকলে, তা দ্রুত নিস্পত্তি করা হচ্ছে। অভিযান অব্যাহত থাকবে উল্লেখ করে তিনি ভোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আপনারা আমাদের তথ্য দিন, আমরা আইন অনুযায়ী কঠোর ব্যবস্থাগ্রহণ করবো। এসময় তিনি সবাইকে সচেতন হওয়ার অনুরোধ জানান।
সচেতনতার বিকল্প নেই উল্লেখ করে এ ব্যাপারে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা তাপস শীল বলেন, নিরাপদ, মানসম্পন্ন, স্বাস্থ্যসম্মত পণ্য ও সেবা পাওয়া প্রত্যেক ভোক্তার অধিকার। আর আমরা সবাই ভোক্তা। যিনি খাদ্যপণ্য উৎপাদন ও বিক্রি করছেন তিনিও ভোক্তা। একজন ভোক্তার অধিকার রক্ষায় আমাদের সবাইকে নিজ নিজ অবস্থান থেকে কাজ করতে হবে।
এদিকে ভোক্তাদের অধিকার সংরক্ষণে ‘ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন, ২০০৯’ প্রণয়ন করা হয় এবং ২০১০ সালে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের অধীনে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর প্রতিষ্ঠিত হয়।
আইন অনুযায়ী একজন ভোক্তা পণ্য কিনে যদি ওজনে কম, মেয়াদোত্তীর্ণ ও ভেজাল পণ্য, নকল পণ্য, মিথ্যে বিজ্ঞাপন দিয়ে প্রতারণা, অতিরিক্ত দাম নেয়া, অবৈধ উপায়ে পণ্য উৎপাদন, পণ্যের মোড়কে বিস্তারিত বিবরণ না লেখা থাকে এগুলোর শিকার হন, তাহলে ভোক্তা হিসেবে তিনি ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদফতরে অথবা জেলা ম্যাজিস্ট্রেটের কাছে উপযুক্ত প্রমাণসহ (পণ্য ক্রয়ের রসিদ কিংবা উপযুক্ত দলিল) লিখিত অভিযোগ করতে পারবেন।
আইনের অন্যতম দিক হলো, যদি বিক্রেতা দোষী প্রমাণ হয় তবে বিক্রেতার ওপর জরিমানা করা অর্থের শতকরা ২৫ ভাগ ভোক্তাকে দেয়া হবে। এই আইনের মাধ্যমে জনগণকে অনেকখানি ক্ষমতায়িত করা হয়েছে। ভোক্তাদের অধিকার নিশ্চিত করা একটি ত্রিপক্ষীয় বিষয়, যার সাথে জড়িত রয়েছে উৎপাদনকারী, বিক্রেতা এবং ভোক্তা বা ক্রেতা। শুধু জেল-জরিমানা বা শাস্তিমূলক ব্যবস্থাগ্রহণের মাধ্যমে ভোক্তার অধিকার নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।
এজন্য ভোক্তা তথা সাধারণ জনগণকে যেমন সচেতন হতে হবে একইভাবে উৎপাদনকারী ও বিক্রেতাকেও সচেতন হতে হবে। কারণ, আমরা সবাই ভোক্তা। উৎপাদনকারী বা বিক্রেতা এবং ভোক্তার সমন্বিত আন্তরিক প্রচেষ্টাই ভোক্তা অধিকার নিশ্চিত করতে পারে। এ কারণে বাজার মনিটরিংয়ের পাশাপাশি সাধারণ জনগণ তথা ভোক্তা এবং উৎপাদনকারী ও ব্যবসায়ীদের সচেতন করার বিষয়টিকে বর্তমানে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে।
০১ অক্টোবর, ২০২৪।