ব্যাপক পুলিশি তৎপরতা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিজিবি-র্যাবের টহল
মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
হাজীগঞ্জ উপজেলায় গত বুধবার রাতে পুলিশ-জনতা সংঘর্ষের ঘটনায় প্রশাসন ও পুলিশের ব্যাপক তৎপরতা, নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেটের নেতৃত্বে বিজিবি, র্যাব ও গোয়েন্দা পুলিশের টহলে শান্তিপূর্ণ ও স্বাভাবিক পরিস্থিতি বিরাজ করছে। এ ঘটনায় শনিবার (১৬ অক্টোবর) থেকে কাজ শুরু করেছে জেলা প্রশাসন ও পুলিশের চট্টগ্রামের রেঞ্জের গঠিত তদন্ত কমিটি। এই দুই তদন্ত কমিটি আগামি ৭ দিনের মধ্যে রিপোর্ট প্রদান করবেন।
এ দিন (শনিবার) তদন্ত কমিটির সদস্যরা ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও সংশ্লিষ্ট লোকজনের সাথে কথা বলাসহ সিসি টিভির ফুটেজ ও বিভিন্ন মাধ্যম থেকে ভিডিও সংগ্রহ করেছেন। এছাড়া ওই দিনের ঘটনায় নিহত চারজনের মধ্যে হাজীগঞ্জের তিনজনের বাড়িতে গিয়ে তাদের পরিবারকে সমবেদনা জানিয়েছেন হাজীগঞ্জ থানার অফিসার ইনচার্জ মোহাম্মদ হারুনুর রশিদ ও পুলিশ পরিদর্শক (তদন্ত) মোহাম্মদ ইব্রাহিম খলিল।
এর আগে গত বুধবার রাতে জনতা-পুলিশ সংঘর্ষে গুলিবিদ্ধ হয়ে ৪ জন নিহতের ঘটনায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে ১৪৪ ধারা জারিসহ নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট ও হাজীগঞ্জ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মেহেদী হাসান মানিক ও জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মঞ্জুরুল মোর্শেদের নেতৃত্বে বিজিবি ও র্যাব টহলের পাশাপাশি উপজেলার প্রতিটি মন্দির ও পূজামন্ডপে ২ জন পুলিশসহ আনসার সদস্য মোতায়েন করা হয়।
এছাড়া হাজীগঞ্জ থানা পুলিশের পাশাপাশি অতিরিক্ত পুলিশ ও গোয়েন্দা পুলিশ আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে রাত-দিনব্যাপী দায়িত্ব পালন করছেন। বৃহস্পতিবার ময়নাতদন্ত শেষে পরিবারের মাঝে নিহত চারজনের মরদেহ হস্তান্তর করে পুলিশ। এ দিন রাতেই হাজীগঞ্জের নিহত তিনজনের মরদেহ জানাযা শেষে নিজ নিজ পারিবারিক কবরস্থানে দাফন এবং অপর নিহতের মরদেহ চাঁপাইনবাবগঞ্জে নিয়ে যায় তার পরিবার।
এ ঘটনায় পুলিশ বাদী হয়ে দুইটি এবং মুকুন্দসার মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক একটি মামলা দায়ের করেন। মামলায় ২ হাজারের বেশি আসামি করা হয়। ইতোমধ্যে ৭ জনকে আটক এবং আদালতের মাধ্যমে তাদের জেলহাজতে প্রেরণ করে পুলিশ। এছাড়া ঘটনার সাথে জড়িতদের চিহ্নিত ও সনাক্তকরণে পুলিশ সিসি টিভির ফুটেজ এবং সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকসহ বিভিন্ন মাধ্যমে থেকে ভিডিও সংগ্রহ করে।
গত বৃহস্পতিবার ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন জাতীয় সংসদের হুইপ ও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আবু সাঈদ আল মাহমুদ স্বপন এমপি এবং আওয়ামী লীগের তথ্য ও গবেষণা সম্পাদক ড. সেলিম মাহমুদ। তাঁদের সাথে ছিলেন পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি মো. আনোয়ার হোসেন, চাঁদপুরের জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ, জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আলহাজ মো. নাছির উদ্দিন ও সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল।
ওই দিন (বৃহস্পতিবার) জেলা প্রশাসন থেকে অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেটকে (এডিএম) আহ্বায়ক করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির অন্য সদস্যরা হলেন- হাজীগঞ্জের উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাজীগঞ্জ ও ফরিদগঞ্জ সার্কেল), উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি), ইসলামিক ফাউন্ডেশনের উপ-পরিচালক। এই কমিটি ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করবেন।
এছাড়া পুলিশের চট্টগ্রাম রেঞ্জের ডিআইজি তিন সদস্য বিশিষ্ট তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কমিটির আহ্বায়ক – চট্টগ্রাম রেঞ্জের অতিরিক্ত ডিআইজি (প্রশাসন ও অর্থ) মো. ইকবাল হোসেন, সদস্য পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন চাঁদপুরের পুলিশ সুপার খন্দকার নূর রেজওয়ানা পারভিন এবং জেলা পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (প্রশাসন ও অপরাধ) সুদীপ্ত রায়। এই কমিটিও ৭ দিনের মধ্যে তদন্ত রিপোর্ট প্রদান করবেন।
এ বিষয়ে অতিরিক্ত পুলিশ সুপার (হাজীগঞ্জ ও ফরিদগঞ্জ সার্কেল) মো. সোহেল মাহমুদ জানান, এই ঘটনায় ৩টি মামলা দায়ের ও ৭ জনকে আটক করা হয়েছে এবং সিসি টিভি, পুলিশ ও বিভিন্ন মাধ্যমে থেকে সংগ্রহকৃত ভিডিও দেখে জড়িতের সনাক্ত করা হচ্ছে। তিনি বলেন, ইতোমধ্যে যাদের চিহ্নিত করা হয়েছে তাদের আটকের অভিযান অব্যাহত আছে। প্রশাসন ও পুলিশের তৎপরতায় বর্তমানে পরিবেশ শান্ত রয়েছে বলে তিনি জানান।
সংবাদকর্মীদের মাধ্যমে গুজবে কান না দেওয়ার অনুরোধ জানিয়ে জনসাধারণের উদ্দেশে তিনি বলেন, যে বা যারাই কোন তথ্য পাবেন, তার সত্যতা নিশ্চিত করবেন। গুজবে কান না দিয়ে ফেসবুকে পোস্ট দিবেন না। নিজেকে অপরাধী করবেন না। কারণ গুজব সামাজিক বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করে। এতে করে মানুষের প্রাণ ও সম্পদহানী হয়। এসময় তিনি পুলিশকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার আহ্বান জানান।
উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোমেনা আক্তারের সাথে কথা হলে তিনি জানান, উপজেলায় যাতে নতুন করে কোনো ধরনের সহিংসতার ঘটনা না ঘটে এবং আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি না হয়, সেজন্য জেলা প্রশাসকের নির্দেশনায় ও পরামর্শক্রমে দুইজন নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নেতৃত্বে ভ্রাম্যমাণ আদালতের টিম সার্বক্ষণিক দায়িত্ব পালন করছেন। তাদের পাশাপাশি হাজীগঞ্জ থানা পুলিশ, অতিরিক্ত পুলিশ, বিজিবি ও র্যাব সদস্য মোতায়েন রয়েছে।
হাজীগঞ্জের পরিবেশ শান্ত ও স্বাভাবিক রয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টায় বর্তমানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক রয়েছে। তবে আমরা কেউ যেন গুজবে কান না দেই। কারো কাছে কোন তথ্য থাকলে প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে জানান। আমরা তাৎক্ষনিক ব্যবস্থাগ্রহণ এবং প্রশাসন, পুলিশ, জনপ্রতিনিধি, স্থানীয় ও এলাকাবাসীর সহযোগিতায় সমস্যার সমাধান করবো।
উল্লেখ্য, কুমিল্লা শহরের দিঘিরপাড়ের একটি দুর্গাপূজার মণ্ডপে হনুমান মূর্তির কোলে পবিত্র কোরআন শরিফ রাখার একটি ছবি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়ে। এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে বুধবার রাত আনুমানিক আটটার দিকে হাজীগঞ্জ-রামগঞ্জ সড়কের দিক থেকে হাজীগঞ্জ বাজারে দিকে একটি মিছিল আসে।
মিছিলটি বাজার প্রদক্ষিণ করে পশ্চিম বাজারস্থ রাজা লক্ষ্মী নারায়ন জিউর আখড়ায় অবস্থিত পূজামন্ডপে সামনে আসলে মিছিল থেকে কে বা কারা পূজামন্ডপের গেটের দিকে ইট-পাটকেল ছুড়ে মারে। এতে ঘটনাস্থলে থাকা পুলিশ মিছিলকারীদের প্রতিরোধের চেষ্টা করলে পুলিশের উপর ইট-পাটকেল ছুড়ে মারে মিছিলকারীরা।
এসময় মিছিলকারীর পুলিশের উপর ক্ষিপ্ত হয়ে হামলা চালালে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ার সৃষ্টি হয় এবং পুলিশ আত্মরক্ষার্থে গুলি ছুড়ে। এদিকে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়ায় এবং পুলিশের গুলিতে ৪ জন নিহত এবং ৪ জন আহত হয়। এছাড়া মিছিলকারীদের ইট-পাটকেলের আঘাতে ১৭ জন পুলিশসহ সাংবাদিক ও পথচারী আহত হয়েছেন।
১৭ অক্টোবর, ২০২১।