আত্মগোপনে আ.লীগ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা
ইল্শেপাড় রিপোর্ট
সারাদেশের মতো চাঁদপুরেও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর বিশেষ অভিযান ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ শুরু হওয়ায় জেলাজুড়ে উদ্বেগ ও আতঙ্কের সৃষ্টি হয়েছে। বিশেষ করে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গ-সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা বিরাজ করছে। গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনের মুখে আওয়ামী লীগ, অঙ্গ ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা আত্মগোপনে চলে যায়।
গত শনিবার (৮ ফেব্রুয়ারি) রাত থেকে এই অভিযান পরিচালনা করছে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী। অভিযানটি মূলত দেশবিরোধী চক্র, সন্ত্রাসী এবং দুষ্কৃতকারীদের আইনের আওতায় আনতে পরিচালিত হচ্ছে। ‘ডেভিল’ অর্থ শয়তান এবং ‘হান্ট’ অর্থ শিকার অর্থাৎ অপরাধীদের চিহ্নিত করে শাস্তির মুখোমুখি করাই এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য।
‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ যৌথভাবে পরিচালনা করছে সেনাবাহিনী, পুলিশ ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবি।
ঢাকাসহ সারাদেশে শুরু হওয়া অপারেশন ডেভিল হান্টে এখন পর্যন্ত ১ হাজার ৩০৮ জনকে আটক করা হয়েছে। গত শনিবার রাত থেকে গতকাল রোববার পর্যন্ত অপারেশন পরিচালনা করে তাদের আটক করা হয়। রোববার সন্ধ্যায় পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর এ তথ্য জানান।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতা : চাঁদপুর জেলা পুলিশের সূত্রে জানা গেছে, অপারেশন ডেভিল হান্ট’ এর আওতায় বিভিন্ন এলাকায় বিশেষ অভিযান চালানো হচ্ছে। সন্দেহভাজন ব্যক্তিদের আটক, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের পাশাপাশি গুরুত্বপূর্ণ রাজনৈতিক ব্যক্তিদের গতিবিধিও নজরদারিতে রাখা হয়েছে।
একজন পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, অপরাধী যেই হোক না কেন, তাকে আইনের আওতায় আনা হবে। এটি কোনো নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে অভিযান নয়, বরং সমাজবিরোধী কর্মকাণ্ড দমনের একটি প্রচেষ্টা।
অভিযানের উদ্দেশ্য ও প্রভাব : সরকারের উচ্চপর্যায়ের নির্দেশে পরিচালিত এই অভিযানের মূল উদ্দেশ্য হলো সমাজবিরোধী ও রাষ্ট্রদ্রোহী কর্মকাণ্ডে জড়িতদের আইনের আওতায় আনা। বিশেষ করে, যেসব ব্যক্তি নাশকতা, সন্ত্রাস ও অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িত, তাদের চিহ্নিত করে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
নেতাকর্মীদের আতঙ্ক ও প্রতিক্রিয়া : অভিযানের খবর ছড়িয়ে পড়ার পর থেকেই চাঁদপুরে আওয়ামী লীগ ও এর অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীদের মধ্যে আতঙ্ক দেখা দিয়েছে। অনেকেই আত্মগোপনে চলে গেছেন বলে জানা গেছে। কেউ কেউ নিরাপদ আশ্রয়ের সন্ধানে অন্যত্র চলে গেছেন, আবার কেউ বাড়িতে অবস্থান করলেও প্রকাশ্যে আসছেন না।
এ বিষয়ে চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের একজন নেতা বলেন, আমরা আইন মান্যকারী নাগরিক, আমাদের ভয় পাওয়ার কিছু নেই। তবে কিছু গোষ্ঠী রাজনৈতিক প্রতিহিংসার শিকার হতে পারে, সেটাই আমাদের দুশ্চিন্তার কারণ।
সাধারণ মানুষের প্রতিক্রিয়া : সাধারণ জনগণের মধ্যে এ অভিযান নিয়ে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। কেউ কেউ অভিযানের প্রশংসা করে বলছেন, এতে সন্ত্রাস ও দুর্নীতি কমবে। কেউ কেউ অভিযানের প্রশংসা করছেন, কারণ এতে সন্ত্রাসীদের দৌরাত্ম্য কমবে বলে আশা করা হচ্ছে। আবার কেউ কেউ আশঙ্কা করছেন, এটি রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে পরিচালিত হতে পারে।
আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ চলমান থাকবে এবং অপরাধীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে। চাঁদপুরসহ সারাদেশে এ অভিযান আরও জোরদার করা হতে পারে বলে সূত্র জানিয়েছে।
অপারেশন ডেভিল হান্ট কী ও যে কারণে শুরু : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সূত্রে জানা যায়, অপারেশন ডেভিল হান্ট একটি বিশেষ অভিযান। যা ৮ ফেব্রুয়ারি সারা দেশে একযোগে শুরু হয়েছে। গত ৭ ফেব্রুয়ারি গাজীপুরে ছাত্র ও সাধারণ জনগণের ওপর সন্ত্রাসী হামলা করে আওয়ামী লীগের সন্ত্রাসীরা। এ হামলায় নেতৃত্ব দেয় ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত স্বৈরাচার শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগের কয়েকজন নেতাকর্মী। এ হামলায় বেশ কয়েকজন হতাহত হন এবং সার্বিক আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি ঘটে। ঘটনার পরপরই স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও অন্য নিরাপত্তা সংস্থার উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের বৈঠকে দেশের সামগ্রিক নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করার সিদ্ধান্ত হয়। এরই ধারাবাহিকতায় ৮ ফেব্রুয়ারি ‘অপারেশন ডেভিল হান্ট’ নামক বিশেষ অভিযান শুরু হয়।
যারা পরিচালনা করবে অপারেশন ডেভিল হান্ট : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, সন্ত্রাস নির্মূলের এ অপারেশন পরিচালনা করবে বিভিন্ন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। বাহিনীগুলো গোয়েন্দা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সারা দেশে একযোগে যৌথভাবে অভিযান পরিচালনা করবে। বাহিনীগুলোর মধ্যে রয়েছে পুলিশ, র্যাব, সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের গোয়েন্দা শাখা ডিবি।
সরকার এ অভিযানকে জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ হিসেবে উল্লেখ করেছে। স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি স্বাভাবিক রাখতে সরকার সব ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করবে। সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কতদিন পর্যন্ত চলবে অপারেশন ডেভিল হান্ট : স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা যায়, অপারেশন ডেভিল হান্টের প্রাথমিক ধাপে বেশ কয়েকজন সন্ত্রাসী গ্রেপ্তার হয়েছে এবং বেশ কিছু অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছে। আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জানিয়েছে, এ অভিযান দীর্ঘমেয়াদি হবে এবং সন্ত্রাসবাদের মূল উৎপত্তিস্থল চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
অপারেশন ডেভিল হান্ট নিয়ে যা বলছে বাহিনীগুলো : আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সূত্রে জানা যায়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে অপারেশন ডেভিল হান্ট ঘোষণার পর সবগুলো বাহিনী একসঙ্গে সমন্বিতভাবে সারা দেশে সাঁড়াশি অভিযান শুরু করেছে। সব গোয়েন্দা তথ্য একসঙ্গে বিচার-বিশ্লেষণ করে নির্দিষ্ট টার্গেটকে সামনে রেখে দেশের বিভিন্ন এলাকায় অভিযান পরিচালনা করা হচ্ছে।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সামনে রেখে অপারেশন ডেভিল হান্টের কার্যক্রম পরিচালনা করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (মিডিয়া অ্যান্ড পিআর) ইনামুল হক সাগর। তিনি বলেন, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে ইতোমধ্যে এ অভিযানের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য বলা হয়েছে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী পুলিশ এ অভিযানের কার্যক্রম পরিচালনা করছে। পুলিশের সব ইউনিক একযোগে সারা দেশে এ অভিযানে অংশগ্রহণ করেছে এবং কার্যক্রম পরিচালনা করছে।
অপারেশন ডেভিল হান্টে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য বাহিনীগুলোর সঙ্গে সমন্বিতভাবে কাজ করছে র্যাব। এ বিষয়ে র্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের উপ-পরিচালক (অতিরিক্ত দায়িত্বে পরিচালক) মেজর লুৎফুল হাদী বলেন, আমরা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী অন্য বাহিনীর সঙ্গে সমন্বয় করে যৌথভাবে অভিযানে কাজ করছি। আমরা গোয়েন্দা তথ্য সংগ্রহের পাশাপাশি সন্ত্রাসীদের গ্রেপ্তারের লক্ষ্যে যৌথভাবে কাজ করছি।
বিশেষ এ অপারেশনের বিষয়ে ডিএমপির অতিরিক্ত কমিশনার (ডিবি) রেজাউল করিম মল্লিক বলেন, ঢাকা শহরের মানুষজনকে নিরাপদ রাখতে আমরা প্রতিনিয়ত জোরালোভাবে অভিযান পরিচালনা করছি। অপারেশন ডেভিল হান্ট শুরু হয়েছে। আমাদের অভিযানও জোরালো হয়েছে। ঢাকা শহরের মানুষজন যেন নিরাপদে থাকতে পারে এবং স্থিতিশীল পরিবেশে থাকতে পারে, সেজন্য আমি যোগদান করার পর থেকে নিয়মিত সন্ত্রাসবিরোধী অভিযান পরিচালনা করছে ডিবি।
অপারেশন ডেভিল হান্টের বিষয়ে যা বলছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় : রোববার (৯ ফেব্রুয়ারি) রাজধানীর ফার্মগেটের মৃত্তিকা সম্পদ ইনস্টিটিউটের নতুন মৃত্তিকা ভবন উদ্বোধনী অনুষ্ঠান শেষে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্বরাষ্ট্র উপদেষ্টা লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মো. জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী বলেন, ডেভিল যতদিন শেষ না হবে ততদিন পর্যন্ত অপারেশন ডেভিল হান্ট চলবে। যারা দেশকে অস্থিতিশীল করবে তাদের টার্গেট করে ডেভিল হান্ট অপারেশন চলবে। গাজীপুরে যারা ছাত্র-জনতার ওপর হামলার ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের অনেককেই আইনের আওতায় আনা হয়েছে। তাড়াতাড়ি বাকিদেরও আনা হবে।
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সম্মেলন কক্ষে অপারেশন ডেভিল হান্ট সম্পর্কে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব নাসিমুল গনি বলেন, এটা পুলিশি অ্যাকশন। পুলিশ কাজ করবে এবং সেনাবাহিনী এতে সহায়তা করবে। যেসব দেশে বিপ্লব হয়েছে সেখানে পরাজিত শক্তিকে কেউ রাখেনি। এ সরকার অতটা অমানবিক হতে পারেনি। আমরা পুলিশকে রিফর্ম করেছি। পুলিশের কেউ ভয়ে এবং চাপে পড়ে অন্যায় করেছে। কিছু অতি উৎসাহী ছিল তারা পালিয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে অ্যাকশন নেওয়া হচ্ছে। একটা বাহিনীর মনোবল ভেঙে গেছে। পুলিশে কিছু পরিবর্তন আনার চেষ্টা করছি। আমরা চাই পুলিশ কোমর সোজা করে দাঁড়াক। এজন্য তাদের অ্যাকটিভলি কাউন্সেলিং করছি।
১০ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫।