চাঁদপুরে অক্সিজেন সেবায় প্রশিক্ষণহীন ৬ শতাধিক স্বেচ্ছাসেবক

আছে দুর্ঘটনার আশঙ্কা, সবার আগে মানবতা

ইল্শেপাড় রিপোর্ট
মহামারি করোনায় চাঁদপুরের সর্বত্র যখন ভয়াবহ রুপ নিয়েছে তখন চাঁদপুরের ৬ শতাধিক তরুণ নানাভাবে মানুষের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছে। তাদের কেউ ত্রাণ নিয়ে, আবার কেউ সুরক্ষা সামগ্রী নিয়ে নিজ-নিজ এলাকায় কাজ করেছেন।
সচেতনতামূলক প্রচারণার পাশাপাশি করোনায় মৃত ব্যক্তির লাশের সৎকারেও কিছু তরুণের রয়েছে প্রশংসনীয় ভূমিকা। জুলাই মাসের প্রথম থেকেই চাঁদপুরে হঠাৎ করেই বাড়তে থাকে করোনা সংক্রমণ। শনাক্তের হার ওঠানামা করছিলো চল্লিশ থেকে পঞ্চাশের ঘরে। হাসপাতালে যখন রোগীর উপচেপড়া ভিড়, অক্সিজেনের তীব্র সংকট, বাড়ছে মৃত্যুর সংখ্যা, তখন এখানকার এসব তরুণ শুরু করেছে ফ্রি অক্সিজেন সেবা সার্ভিস।
অক্সিজেনের অভাবে শ্বাসকষ্টে যেন চাঁদপুরের কোনো রোগী প্রাণ না হারায় তাই নিজেদের সঞ্চিত অর্থে কিংবা অনুদানে কিনে নেয় অক্সিজেন সিলিন্ডার। বাসা-বাড়িতে কেউ শ্বাসকষ্টে ভুগলেই ফোন আসে তরুণদের কাছে। দিনে তো বটেই গভীর রাতেও মানবতার টানে ছুটে যান স্বেচ্ছাসেবীরা।
গভীর রাতে অসুস্থ ব্যক্তির বাড়িতে স্বেচ্ছাসেবীরা যখন অক্সিজেন নিয়ে যান তখন সেখানে কোনো বিশেষজ্ঞ ডাক্তার উপস্থিত থাকেন না। রোগীর পালস না বুঝে ওই মুহূর্তে রোগীকে কত লিটার অক্সিজেন দিতে হবে তা-ই বা নির্ধারণ করার ক্ষেত্রে মিলে না সঠিক জবাবও।
স্বেচ্ছাসেবীদের সাথে কথা বলে জানা যায়, কোনো চিকিৎসকের মাধ্যমে নয়, তারা নিজেরাই পালস অক্সিমিটারের মাধ্যমে রোগীর পালস্ নির্ণয় করে অক্সিজেন দিয়ে থাকেন। স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরা কি প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত? প্রতিউত্তরে ‘না’ ছাড়া ‘হ্যাঁ’ বলতে শোনা যায়নি কাউকে।
তবে স্বেচ্ছাসেবীরা বলছে, দুর্ঘটনার আশঙ্কা আছে জানি, কিন্তু মানবতা সবার আগে। আমরা মানবতার সেবায় এগিয়ে এসেছি। বিপন্ন মানবতার পাশে দাঁড়িয়েছি। সরকারি উদ্যোগে আমাদের প্রশিক্ষিত করলে আমরা হয়তো আরো ভালো সেবা দিতে পারবো।
যদিও উদ্বেগ আছে। কিন্তু এখন আমাদের অক্সিজেন সেবায় জেলার কোখাও কোন মৃত্যুর সংবাদ আসেনি। এটাই শান্তনা, দাবি স্বেচ্ছাসেবকদের।
চাঁদপুর সিভিল সার্জন কার্যালয়ের দেয়া তথ্যমতে, জেলার ৬৭টি স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের মধ্যে চাঁদপুর রেড ক্রিসেন্ট ছাড়া আর কোনো সংগঠনই রোগীকে অক্সিজেন সরবরাহের প্রশিক্ষণ নেয়নি। বাকিরা কীভাবে, কোন প্রক্রিয়ায় রোগীকে অক্সিজেন দিচ্ছেন সে বিষয়ে তিনি জানেন না।
বিস্ময় প্রকাশ করেন চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. হাবিব-উল-করিম। তিনি বলেন, অক্সিজেন একজন রোগীকে তখনই দেয়া হয় যখন রোগীর জীবন সংকটাপন্ন হয়। এমন সময় রোগীকে কী করা উচিত তা কেবল একজন বিশেষায়িত ডাক্তারই নির্ধারণ করবেন।
চাঁদপুরের করোনার ঊর্ধ্বগতিতে প্রাথমিকভাবে বিনামূল্যে অক্সিজেন সেবা কাজটি দু’একটি সংগঠন শুরু করলেও পর্যায়ক্রমে বাড়তে বাড়তে জেলায় অক্সিজেন সেবা দেওয়া সংগঠনের সংখ্যা বর্তমানে ৬৭টি। এর মধ্যে চাঁদপুর রোটারী ক্লাব এর সমন্বয়ের দায়িত্ব নেয়। ক্লাবের সভাপতি তরুণ সমাজসেবক রোটারিয়ান শাহেদুল হক মোর্শেদের নেতৃত্বে রোটারিয়ান, রোটার‌্যাক্টর ও ইন্টার‌্যাক্টররা দিন-রাত সেবা দিতে থাকেন। অক্সিজেন মুমুর্ষু রোগীদের বাড়ি পৌঁছে দেয়া থেকে শুরু করে অক্সিজেন সিলিন্ডার রিফিলও করে আনতে থাকেন তারা। পরবর্তীতে চাঁদপুর পৌর মেয়রের সাথে সমন্বয়ের কাজটিও করেন চাঁদপুর রোটারী ক্লাব নেতৃবৃন্দ।
অক্সিজেন সেবা দেয়ার মধ্যে চাঁদপুর সদর উপজেলায় ১২টি, ফরিদগঞ্জ উপজেলায় ২১টি, হাজীগঞ্জ উপজেলায় ১৩টি, মতলব উত্তর উপজেলায় ৬টি, মতলব দক্ষিণ উপজেলায় ৫টি, কচুয়া উপজেলায় ৪টি, শাহরাস্তি ও হাইমচর উপজেলায় রয়েছে ৩টি করে সংগঠন বা সেবা সংস্থা। প্রতিটি সংগঠনেই যুক্ত রয়েছেন গড়ে ১০ জন করে স্বেচ্ছাসেবী। যারা একেকজন একেক সময় রোগীর বাড়িতে অক্সিজেন সিলিন্ডার নিয়ে যান।
সব মিলিয়ে পুরো জেলায় অক্সিজেন সার্ভিস সেবায় জড়িত সদস্য ৬ শতাধিক। সংগঠনগুলোর অধিকাংশের কাছে সিলিন্ডার মজুদ রয়েছে ১০-১৫টি। ২০টি সিলিন্ডার নিয়ে কাজ করছেন এমন সংগঠনের সংখ্যা ১১টি। খুব কমসংখ্যক সংগঠনই রয়েছে যাদের কাছে সিলিন্ডার আছে পাঁচের নিচে। সব মিলিয়ে পুরো চাঁদপুর জেলায় বাড়ি বাড়ি ঘুরছে ৮ শতাধিক অক্সিজেন সিলিন্ডার।
বিশেষজ্ঞ চিকিসৎক ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ডা. জেআর ওয়াদুদ টিপু জানান, এই ৮শ’ সিলিন্ডারই ৮শ’ বোমা। ব্যবহারবিধি না জানা গ্রামের মানুষদের ঘরে অক্সিজেন সিলিন্ডার ঘটাতে পারে যে কোনো দুর্ঘটনা। রাসায়নিক পদার্থ হিসেবে বিস্ফোরণের সম্ভাবনা তো আছেই, তার পাশাপাশি নির্ভরযোগ্য চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী কোন্ পর্যায়ে কতটুকু অক্সিজেন পরিমাণে দিতে হবে বা আদৌ রোগীর অক্সিজেন সাপোর্ট লাগবে কি-না জানতে হবে তাও। অন্যথায় জীবন বাঁচাতে গিয়ে জীবন পড়তে পারে সংকটে।
ফ্রি অক্সিজেন সেবা নিয়ে কাজ করা হাইমচর উপজেলার নীলকমল এলাকার ‘আলোকিত ভবিষ্যৎ’ নামক সংগঠনের ফয়সাল মিয়া বলেন, সাধারণত আমরা বাসায় অক্সিজেন পৌঁছাই না। রোগীর স্বজনরা এসে নিয়ে যায়। নিয়ে গিয়ে তারা রোগীকে কিভাবে অক্সিজেন দেন, কোন্ প্রক্রিয়ায় দেন তা তারাই ভালো জানেন।
তবে অক্সিজেন সিলিন্ডার নেয়ার সময় রোগীর স্বজনকে একটি কন্ট্রাক্ট পেপারে সাইন করতে হয়। যেখানে উল্লেখ থাকে যদি এই সিলিন্ডার হারিয়ে যায় তবে তার দায় রোগীর পরিবারের। বাজার মূল্য পরিশোধ করতে হবে তাদের। অথচ ‘অক্সিজেন সিলিন্ডার হারালে দায় পরিবারের, যদি এই অক্সিজেন অপব্যবহারের কারণে রোগীর জীবন হারিয়ে যায় তবে তার দায় কার?’ -এমন প্রশ্নে নিশ্চুপ ছিলেন তিনি।
হাজীগঞ্জের ধেররা এলাকার করোনাকালীন অক্সিজেন সেবাদানকারী দল ‘হ্যালো সেবা সেন্টার’-এর সুমন তালুকদার জানান, আমরা রোগীর প্রয়োজনে অক্সিজেন সিলিন্ডার বাসায় গিয়ে দিয়ে আসি। সারা রাত রোগীর পাশে থেকে সেবা দেয়া সম্ভব নয়।
চাঁদপুর সিভিল সার্জন ডা. মো. সাখাওয়াত উল্যাহ বলেন, আমরা বহু পর্যবেক্ষণের পর একজন রোগীকে অক্সিজেন দেই। দিলেও কিছু সময় পর রোগী অক্সিজেন পাবেন কি-না তা নির্ণয় করে লেভেল কমানো বাড়ানো হয়। কিন্তু গ্রামে বহু বাড়িতে রোগীর মুখে দীর্ঘ সময় ধরে অক্সিজেন লাগিয়ে রাখার কথা শোনা যাচ্ছে অহরহ। এতে রোগীর ফুসফুসজনিত বিভিন্ন রোগ দেখা দিতে পারে।
চাঁদপুর সরকারি জেনারেল হাসপাতালের তত্ত্বাবধায়ক ডা. মো. হাবিব-উল-করিম বলেন, নির্দিষ্ট লেভেলের বাইরে অক্সিজেন পেলে রোগীর দেহের অভ্যন্তরীণ অঙ্গের সমস্যা হবে। মেডিকেলের ভাষায় যাকে বলে ইন্টারনাল হোমিও স্ট্যাসিস। এতে ফুসফুসসহ যে কোনো অঙ্গের বড় ধরণের ক্ষতি হতে পারে। অতি মাত্রায় লেভেল ক্রস করলে মৃত্যুঝুঁকিও রয়েছে। রোগীর অক্সিজেন লাগবে কি-না তা বিশেষজ্ঞ ডাক্তার ছাড়া অন্য কেউ নির্ধারণের সুযোগ নেই।
জেলা প্রশাসক অঞ্জনা খান মজলিশ বলেন, খুব বড় ধরনের ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছে এসব তরুণরা। তিনি শংকা প্রকাশ করে বলেন, তরুণদের মানবিক প্রচেষ্টাকে স্বাগত জানাই। তবে তাদের কাজ করার আরো সেক্টর রয়েছে। যে সেক্টরে মৃত্যুঝুঁকি রয়েছে, সে সেক্টরে কাজ না করাই ভালো।
২৩ আগস্ট, ২০২১।