চাঁদপুরে যথাযোগ্য মর্যাদায় আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত

বাংলা ভাষার বিকৃত ব্যবহার অবশ্যই বন্ধ করা উচিৎ
………ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক


স্টাফ রিপোর্টার
অমর একুশে ফেব্রুয়ারি মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস চাঁদপুরে যথাযোগ্য মর্যাদায় পালিত হয়েছে। একুশের প্রথম প্রহর ২০ ফেব্রুয়ারি দিবাগত রাত ১২টা ১ মিনিটে চাঁদপুর শহরের শহীদ মুক্তিযোদ্ধা সড়কস্থ কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার বেদীতে শহীদদের শ্রদ্ধা জানাতে মানুষের ঢল নামে। প্রশাসনিক কর্মকর্তা, জনপ্রতিনিধি ও রাজনীতিবিদ থেকে শুরু করে সব শ্রেণি ও পেশার মানুষ শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানায়। পরদিন ২১ ফেব্রুয়ারি সকালে শহরে প্রভাত ফেরী বের হয়।
একুশের সেই দেহ-মন শিহরিত গান ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি’ আকাশ-বাতাস মুখরিত করে সকলে খালি পায়ে প্রভাত ফেরীতে অংশ নেয়। আবারো সবার গন্তব্য হয় চাঁদপুর কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার। সবাই শহীদ মিনারে পুষ্পার্ঘ্য অর্পণ করে।
সকালে সূর্যোদয়ের সাথে সাথে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, ব্যাংক-বীমা, অফিস-আদালত এমনকি অনেকে নিজস্ব বাসা-বাড়িতে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতভাবে উত্তোলন করে। একইভাবে বিভিন্ন উপজেলায়ও মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস পালিত হয়। জেলা সদরে উদ্যাপন হয় জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে আর উপজেলাগুলোতে উদ্যাপন হয় উপজেলা প্রশাসনের উদ্যোগে।
চাঁদপুর শহরে শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও জেলা শিল্পকলা একাডেমীর আয়োজনে শুক্রবার সন্ধ্যায় কেন্দ্রিয় শহীদ মিনার প্রাঙ্গণে আলোচনা সভা, সাংস্কৃতিক ও পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠিত হয়েছে। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন ভারপ্রাপ্ত জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ আবদুল্লাহ আল মাহমুদ জামান।
তিনি তাঁর বক্তব্যে বলেন, শুরুতেই শ্রদ্ধার সাথে স্মরণ করছি হাজার বছরের শ্রেষ্ঠ বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে। আমি কৃতজ্ঞতা জানাই, ভাষা আন্দোলন ও মহান মুক্তিযুদ্ধে যারা জীবন দিয়েছিলেন তাদের। সমস্ত বাঙালি জাতিকেও কৃতজ্ঞতা জানাই। চাঁদপুরের সংসদ সদস্য শিক্ষা মন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপিকে কৃতজ্ঞতা জানাই। তিনি যেন, শিক্ষামন্ত্রী থেকে শিক্ষা খাতকে ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকে আরো অনেক দূর এগিয়ে নিয়ে যেতে পারেন।
তিনি আরো বলেন, আমরা বাঙালি জাতি, আমাদের মাতৃভাষা হচ্ছে বাংলা। তাই ২১ ফেব্রুয়ারি হচ্ছে আমাদের শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস। একুশে ফেব্রুয়ারি বাঙালি জাতির প্রথম এবং সবচেয়ে বড় আন্দোলন। বাঙালি বীরের জাতি। তারা মাথা নত করতে শিখেনি। এ দিনটিকে আমরা শ্রদ্ধার সাথে পালন করি। একুশ নিয়ে কথা বললে প্রথমে উঠে আসে ৫২-এর ভাষা আন্দোলনের কথা। ১৯৫২ সালের এ দিনে মাতৃভাষার জন্য সালাম, রফিক, জব্বার ও বরকতের মতো অসংখ্য শহীদের রক্তের বিনিময়ে অর্জিত এ বাংলা ভাষা। তাই আমরা এখন বাংলা ভাষায় কথা বলতে পারছি। একুশ হচ্ছে বাঙালি জাতির প্রাণের শব্দ। তাই এ দিনটিকে প্রতিটি ক্যালেন্ডারে লাল দাগ দিয়ে রাখা হয়। ভাষার জন্য জীবন দিতে হয়েছে এরকম দেশ আর দ্বিতীয়টি নেই। শুধুমাত্র আমরাই ভাষার জন্য জীবন দিয়েছি।
তিনি বলেন, শুরুতেই যদি ভাষা আন্দোলন না হতো, তাহলে হয়তবা আমাদের মহান স্বাধীনতার সংগ্রামও পিছিয়ে যেতো। ভাষা আন্দোলনের এত বছর পেরিয়ে গেলেও আমরা এখনো সর্বস্তরে বাংলা ভাষার যে চালুর যে আন্দোলন, এটি সফল হতে পরিনি। আমাদের উচ্চ আদালতে এখনো ইংরেজির ব্যবহার। আমাদের রাষ্ট্রীয় সংবিধানে বলা হয়েছে রাষ্ট্র ভাষা হবে বাংলা। সেই রাষ্ট্রভাষা বাংলা এখনো সর্বস্তরে ছড়িয়ে দিতে পারিনি।
তিনি আরো বলেন, ইদানিং আমাদের নতুন প্রজন্মের মাঝে বাংলার যে বিকৃতি দেখা দিয়েছে অর্থাৎ বাংলা ভাষার সাথে অন্য ভাষা মিশ্রিত করে ব্যবহার করা হচ্ছে, এটি অবশ্যই বন্ধ করা উচিৎ। আজকে আমি নতুন প্রজন্মের কাছে আহবান করবো। আমরা যখন বাংলা বলবো, তখন প্রকৃত বাংলা অর্থাৎ প্রমিত বাংলা বলবো। যখন ইংরেজি বলবো, তখন শুধুই ইংরেজি বলবো। কোন ভাষার প্রতিই আমাদের কোন বিদ্বেষ নেই। কিন্তু বাংলা ভাষাকে আমরা ভালোবেসে গ্রহণ করবো। আগে বাংলা ভাষা, তারপর অন্য ভাষা। বাংলিশ ভাষা বলা আমাদের বন্ধ করতে হবে। এটা অব্যাহত থাকলে আমি মনো করবে বাংলা ভাষার প্রতি অসম্মান করা।
মাহমুদ জামান বলেন, আমাদের দেশেও কিন্তু বাংলা ভাষার পাশাপাশি অন্য ভাষার মানুষ রয়েছে। অর্থাৎ ক্ষুদ্র-নৃৃগোষ্ঠীর ভাষা রয়েছে, সেই ভাষার প্রতিও আমরা সম্মান দেখাবো। আঞ্চলিক ও ক্ষুদ্র-নৃগোষ্ঠীর ভাষাগুলো টিকিয়ে রাখতে সরকারও পৃষ্ঠপোষকতা করছে, আপনারাও সহযোগিতা করবেন।
অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) এসএম জাকারিয়ার সভাপতিত্বে ও বিশিষ্ট ছড়াকার ডা. পীযুষ কান্তি বড়ুয়ার সঞ্চালনায় বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়র নাছির উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক মুক্তিযোদ্ধা আলহাজ আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল, পুরাণ বাজার ডিগ্রি কলেজের অধ্যক্ষ রতন মজুমদার, চাঁদপুর প্রেসক্লাবের সাধারণ সম্পাদক এএইচএম আহসান উল্যাহ।
পরে চাঁদপুর জেলা শিল্পকলা একাডেমীর ব্যবস্থাপনায় মনোজ্ঞ সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান পরিবেশিত হয়। এছাড়াও দিবস উপলক্ষে বিকাল ৩টায় একই স্থানে বাংলাদেশ শিশু একাডেমি চাঁদপুর জেলার আয়োজনে ছোটদের হাতের সুন্দর লেখা, চিত্রাংকন, ইচ্ছেমত/শহীদ মিনার জলরঙ/প্যাস্টেল, দেশাত্মবোধক সংগীত ও কবিতা আবৃত্তি প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হয়।
শিশু একাডেমি আয়োজিত অনুষ্ঠানের সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন জেলা শিশু বিষয়ক কর্মকর্তা কাউছার আহমেদ।
আবৃত্তি প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন- শিশু একাডেমির আবৃত্তি প্রশিক্ষক মো. আকরাম খান, অবসরপ্রাপ্ত জেলা শিক্ষা অফিসার আব্দুল জলিল, চরনিলক্ষ্মী সপ্রাবির প্রধান শিক্ষক নুরুন্নাহার।
সংগীত প্রতিযোগিতায় বিচারকের দায়িত্ব পালন করেন, শব্দ সৈনিক কৃষ্ণা সাহা, কণ্ঠশিল্পী ইতু চক্রবর্তী, শিশু একাডেমির সংগীত প্রশিক্ষক ফাতেমাতুজ্জান্নাত।
চিত্রাংকন প্রতিযোগিতায় বিচারক ছিলেন- শিশু একাডেমির চিত্রাংকন প্রশিক্ষক অজিৎ দত্ত। সবশেষে অনুষ্ঠানের অতিথিবৃন্দ এসব প্রতিযোগিতায় বিজয়ীদের হাতে পুরস্কার তুলে দেন।
এছাড়া মহান শহীদ দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস উপলক্ষে চাঁদপুর জেলার সব স্কুল, কলেজসহ ও অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের প্রধান, শিক্ষক/শিক্ষিকারা নিজ নিজ প্রতিষ্ঠানে উপস্থিতিসহ ছাত্র-ছাত্রীদের নিয়ে দিবসের প্রত্যুষে শহীদ দিবসের সাথে সঙ্গতিপূর্ণ সঙ্গীত পরিবেশন সহকারে শহরের প্রধান প্রধান সড়কে প্রভাতফেরী বের করা হয়। ঐ দিন শহীদের স্মরণে জেলার সব স্কুল-কলেজসহ শিক্ষা প্রতিষ্ঠান এবং সরকারি অধা-সরকারি ও স্বায়ত্বশাসিত প্রতিষ্ঠানসমূহের ভবনে সঠিক নিয়মে জাতীয় পতাকা অর্ধনমিতভাবে উত্তোলন করা হয়েছে।
সব স্কুল-কলেজসহ অন্যান্য শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বই পাঠ, স্মরচিত ছড়া ও কবিতা প্রতিযোগিতা এবং কলেজে সর্বসাধারণের জন্য ২১ সংক্রান্ত প্রবন্ধ প্রতিযোগিতার আয়োজন এবং আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। জেলার সব মসজিদে বাদ জোহর এবং মন্দির, গীর্জায় শহীদদের রুহের মাগফিরাত কামনা দোয়া কামনা করা হয়েছে।