ফরিদগঞ্জে ধর্ষণের ভিডিও চিত্র নিয়ে তোলপাড়

জেল খাটতে হলো হতভাগ্য তরুণীকে

ফরিদগঞ্জ
কিশোর থেকে শুরু করে বৃদ্ধ সবাই আজ সামাজিক অবক্ষয়ের শিকার। গ্রামের নিভৃত এলাকা থেকে শুরু করে শহরের অভিজাত এলাকা সর্বত্রই এই অবস্থা। প্রযুক্তির অপব্যহার এই অব্যক্ষয়কে আরো তীব্রতর করেছে। কেউ অসম বয়সীদের সাথে জৈবিক প্রবৃত্তি মেটাচ্ছে, আবার সেই ঘটনার ভিডিও ধারণ করে কেউ কেউ প্রতারণা করে অর্থ হাতিয়ে নিচ্ছে, আবার কেউবা সেই ভিডিও দিয়েই কৌশলে অসম বয়সী তরুণীকে দিয়ে নিজের জৈবিক ক্রিয়া সম্পন্ন করেছেন। সর্বশেষ জৈবিক ক্রিয়ার ঘটনার ভিডিও অন্য একজন ধারণ করে প্রতারণা করছেন এমন ঘটনায় তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
এরকমই একটি ঘটনার জৈবিক কার্য করা দুই বৃদ্ধ নিজেদের অপকর্ম ঢাকতে ভিডিও পাইরেসী করে অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগ তুলে আদালতে মামলা দায়েরের পর হতভাগ্য এক তরুণীকে জেল খাটতে হয়। পরে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় সামাজিক লোকলজ্জ্বা ভুলে ধর্ষণ ও ভিডিও দিয়ে প্রতারণার অভিযোগে আদালতে মামলা করেছেন ওই তরুণী মা। ঘটনা দু’টি ফরিদগঞ্জ ও চাঁদপুর সদর উপজেলার। তরুণীর পক্ষের দায়েরকৃত মামলায় অভিযুক্ত দুই বৃদ্ধের মধ্যে একজন ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চর রাঘবরায় এলাকার পল্লী চিকিৎসক আ. কুদ্দুছ ও অপরজন চাঁদপুর সদর উপজেলার সাপদি গ্রামের গ্রাম্য মাতব্বর জুনাব আলী তালুকদার। এছাড়া তৃতীয়জন অশ্লীল ভিডিও ধারণ ও তা দিয়ে প্রতারণার ঘটনায় অভিযুক্ত ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চর রাঘবরায় এলাকার সুমন পাটওয়ারী।
অপরদিকে, ওই তরুণীসহ আরো কয়েকজনকে জড়িয়ে ওই দুই বৃদ্ধ ভিডিও পাইরেসী ও অর্থ হাতিয়ে নেয়ার অভিযোগে চাঁদপুর মডেল ও ফরিদগঞ্জ থানায় পৃথক দুটি মামলা করে। ওই দুটি মামলায় ২২দিন জেল খেটে জামিনে বেরিয়ে আসে ওই তরুণী। পরে তরুণীর মা মেয়েকে ধর্ষণ ও ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও চিত্র ধারন করে প্রতারণা করার অভিযোগে গত ১ মার্চ আদালতে মামলা দায়ের করেছে।
এদিকে দু’টি ঘটনার একে অপরের বিরুদ্ধে তিনটি মামলা, প্রতারণা, সামাজিক অবক্ষয় নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। আশ্চর্য্যের বিষয় হলো দুই বৃদ্ধের দায়ের করা মামলা ধরণ ও লেখা প্রায় হুবহু। একজন অপরজনের বন্ধু। একজন তাদের বন্ধুত্বের কথা স্বীকার করলেও অপরজন অস্বীকার করেছেন। সর্বশেষ দায়েরকৃত মামলায় একটি গণস্বাক্ষর যুক্ত করা হয়েছে। যাতে ফরিদগঞ্জ পৌরসভার একজন কাউন্সিলর ও ওই ইউনিয়নের চেয়ারম্যানসহ ইউপি সদস্যের স্বাক্ষর রয়েছে। ফলে পুরো ঘটনটিকে জটিল করে তুলেছে। তাই এসব ঘটনার জন্য প্রকৃত ভাবে কে দায়ী তা সঠিক তদন্ত হওয়ার প্রয়োজন বলে মনে করেন অনেকেই।
তরুণীর দায়েরকৃত মামলা সূত্র ও এলাকায় গিয়ে জানা যায়, ৫ বছর আগে বাবা মারা যাওয়ার পর মায়ের সাথে সঙ্গে নানার বাড়ি ফরিদগঞ্জ উপজেলার গোবিন্দপুর দক্ষিণ ইউনিয়নের চররাঘবরায় গ্রামে বসবাস করতো তরুণী (২০)। পড়ে লেখাপাড়ার জন্য সে খালার বাড়ি পাশর্^বর্তী হাইমচর উপজেলা চলে যায়। বর্তমানে কলেজে অধ্যয়নরত ওই তরুণীক করোনার কারণে গত এক বছর ধরে নানা বাড়ি মায়ের কাছেই থাকে। একই বাড়ির হোমিওপ্যাথী চিকিৎসক আ. কুদ্দুছ সম্পর্কে তার নানা হয়। বাবার পরিচয় সূত্র ধরে তাদের সম্পর্ক থাকলেও তার বাবার সাথে রাজনৈতিক দ্বন্দ্বের জের ধরে সম্পর্কের অবনতি হয়। পরে আবার তরুণীর বাবার মৃত্যুর কিছুদিন পর থেকে পুনরায় যোগাযোগ শুরু হয।
এরই মধ্যে ২০২০ সালের ৭ আগস্ট ওই তরুণীর মা বাড়িতে না থাকার সুযোগে কৌশলে আ. কুদ্দুছ রাতে ওই তরুণীর ঘরে ঢুকে নানা-নাতনির খুনসুটির এক পর্যায়ে তাকে বিয়ের প্রলোভনের ফাঁদে ফেলে ধর্ষণ করে। এসময় অনৈতিক ঘটনাটি ভিডিও ধারণ করা হয়। পরবর্তীতে ওই ভিডিও দেখিয়ে সেটি ফেরত দানের আশ^াসে তরুণীকে চাঁদপুর সদরের নাজির পাড়াস্থ একটি বাসায় নিয়ে আ. কুদ্দুছের বন্ধু জুনাব আলীও তার সাথে অনৈতিক কাজে লিপ্ত হয়। ওই ঘটনাটি সেখানে থাকা সুমন পাটওয়ারী তার মোবাইল ফোনে ভিডিও ধারণ করে। সেই ভিডিও দেখিয়ে আবার সুমন পাটওয়ারীসহ একটি চক্র অর্থ হাতিয়ে নেয়ার চেষ্টায় নামে।
সর্বশেষ ঘটনার আলোকে জুনাব আলী বাদী হয়ে ওই তরুণীকে প্রধান অভিযুক্ত করে এবং এরসাথে চররাঘবরায় গ্রামের আতিকুর রহমান রাজু ও সুমন পাটওয়ারী এবং তরুণীর নানা-নানীকে অভিযুক্ত করে চাঁদপুর মডেল থানায় একটি মামলা দায়ের করে। ওই মামলাটি পরে চাঁদপুর ডিবি পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়। ওই মামলার সূত্র ধরে গত ৪ জানুয়ারি ডিবি পুলিশ তরুণী ও আতিকুর রহমান রাজুকে আটক করে। এসময় ৬টি মুঠো ফোন জব্ধ করে। সে মামলায় ২২দিন জেল খাটার পর গত ২৫ জানুয়ারি জামিনে মুক্তি পায় তরুণী।
অপরদিকে, অপর অভিযুক্ত হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক আ. কুদ্দুছও বাদী হয়ে ওই তরুণীকে প্রধান অভিযুক্ত করে এর সাথে চররাঘররায় গ্রামের আতিকুর রহমান রাজু ও সুমন পাটওয়ারী এবং তরুণীর নানা-নানীকে অভিযুক্ত করে গত ২৪ জানুয়ারি ফরিদগঞ্জ থানায় অপর একটি মামলা দায়ের করে। এই মামলাটির বর্ণিত বিবরণ প্রায় অনুরূপ জুনাব আলী মামলার বিবরণ সাথে।
এরপর সর্বশেষ তরুণী মা বাদী হয়ে ঘটনার সাথে আ. কুদ্দুছ ও জুনাব আলী এবং সুমন পাটওয়ারীকে অভিযুক্ত করে গত ১ মার্চ চাঁদপুরের নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনাল আদালতে মামলা দায়ের করলে আদালত পিবিআইকে মামলাটি তদন্তের নির্দেশ দেয়।
মামলার বিষয়ে তরুণীর মা সাংবাদিকদের জানান, আমাদের অসহায়ত্বের সুযোগ নিয়ে প্রভাবশালী আ. কুদ্দুছ তার বন্ধু জুনাব আলী এবং সুমন পাটওয়ারী আমাদের সম্ভ্রম নষ্ট করেছে। ফলে লোকলজ্জা ভুলে নিজেদের অস্তিত্ব রক্ষায় আদালতের দ্বারস্থ হয়েছি। আমরা সঠিক তদন্ত ও ন্যায়বিচার কামনা করছি। তিনি জানান, প্রভাবাশালীদের আতংকে আমার মেয়েকে বর্তমানে আত্মগোপনে রাখতে বাধ্য হয়েছি। তার পরিবার বর্তমানে আতংকগ্রস্ত।
তরুণীর মামলায় অভিযুক্ত জুনাব আলী মুঠো ফোনে জানান, ওই তরুণী আমার স্ত্রীকে বোন বলে সম্বোধন করে সে সূত্রে আমাকে দুলাভাই বলে ডাকতো। একদিন আমি চাঁদপুরে যাওয়ার পর সে আমাকে চাঁদপুর সদরে পাটওয়ারী বাড়ির পাশে একটি বাড়িতে নিয়ে কৌশলে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করে। তাই আমি ওই তরুণীসহ প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা করেছি। এসময় তিনি চররাঘবরায় গ্রামের হোমিও চিকিৎসক আ. কুদ্দুছকে চিনেন না বলে জানান।
অপর অভিযুক্ত হোমিও চিকিৎসক আ. কুদ্দুছ জানান, ওই কিশোরী আমাকে তার ঘরে ডেকে নিয়ে সে আমাকে দিয়ে কৌশলে অনৈতিক কাজ করতে বাধ্য করেছে। আমার সাথে অনৈতিক ঘটনার ভিডিও দিয়ে আমার কাছ থেকে একটি চক্র অর্থ হাতিয়ে নিয়েছে। ফলে আমি আইনের আশ্রয় নিয়েছি। তিনি জানান, জুনাব আলী তার দোকানে আসা যাওয়ার সূত্র ধরে তাকে চিনেন ও পরিচয় রয়েছে।
চিকিৎসক আ. কুদ্দুছের মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা ফরিদগঞ্জ থানা পুলিশের এসআই আ. কুদ্দুস জানান, মামলার প্রধান অভিযুক্ত তরুণী ও ২নং আসামি আতিকুর রহমান রাজু জেলে থাকায় তাদের গ্রেফতার দেখিয়ে আদালতে পাঠানো হয়েছে। বর্তমানে মামলাটির তদন্ত চলছে। তিনি আরো জানান, বিচার সবার জন্য সমান। আইনকে কেউ যদি ফাঁকি দেয় তাহলে অবশ্যই তাদের আইনের আওতায় আসতে হবে।
জুনাব আলীর মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা চাঁদপুর ডিবি পুলিশের এসআই তৌফিকুল আফসার মুঠো ফোনে জানান, ঘটনার ব্যাপারে তিনি অনেকদূর এগিয়েছেন। শীঘ্রই মামলার চার্জশীট প্রদান করা হবে।
এদিকে তরুণীর আইনজীবী অ্যাড. সাইয়্যেদুল ইসলাম বাবু জানান, জুনাব আলীর দায়েরকৃত মামলার ভিডিওচিত্র পাইরেসী করা হয়েছে বলে যেই অভিযোগ করা হয়েছে, তা সঠিক নয়। ভিডিওটি পাইরেসী নয়, আদালত বিষয়টি পর্যবেক্ষণে এনেছে।
এ ব্যাপারে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক স্থানীয়রা জানায়, ভুক্তভোগী পরিবারটি অসহায় নিরীহ হওয়ার কারণে তারা উল্টো জেল খেটেছে। এসব ঘটনায় প্রকৃতভাবে কারা জড়িত এবং কিভাবে সংঘটিত হচ্ছে, তার একটি সঠিক তদন্ত হওয়া প্রয়োজন। আমাদের সমাজ ব্যবস্থা ও ধর্মীয় মূল্যবোধ ধরে রাখতে তা জরুরি।
০৯ মার্চ, ২০২১।