চাঁদপুরে বিএস খতিয়ানে করণিক ভুল সংশোধনে বিড়ম্বনা

সরকারি গেজেট সংশ্লিষ্টদের কাছে একটি ‘কাগজ’ মাত্র

ইলশেপাড় রিপোর্ট
চাঁদপুরে বিএস (বাংলাদেশ সার্ভে) খতিয়ানে করণিক ভুল সংশোধনের জন্য ভুক্তভোগীদের বিড়ম্বনার যেনো শেষ নেই। সংশ্লিষ্টদের সহযোগিতা কিংবা সঠিক পরামর্শ না পেয়ে মাসের পর মাস ভূমি অফিসগুলোতে ঘুরতে হচ্ছে ভুক্তভোগীদের। আর এমন অসহায়েত্বের সুযোগ নিচ্ছে ভূমি অফিসের কতিপয় অসাধু কমচারী। তারা ভুক্তভোগীদের বিভিন্ন প্রলোভন দিয়ে হাতিয়ে নেন হাজার-হাজার টাকা। অথচ ২০১৫ সালে সরকার গেজেট আকারে স্থানীয় বা স্ব-স্ব ভূমি অফিসকে করণিক ভুল সংশোধন করার ক্ষমতা প্রদান করেছে।
জানা গেছে, ‘৯০ দশকে দেশের বিভিন্ন জেলায় একযোগে বিএস সার্ভে হয়। এসময় অনেক খতিয়ানে বেশ কিছু করণিক ভুল থেকে যায়। ভূমি মন্ত্রণালয়ের আইন অধিশাখা ১ হতে ২০১৫ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর জারিকৃত পরিপত্রে উল্লেখ করা হয়, নিম্নলিখিত করণিক ভুলগুলো বহুলভাবে পরিলক্ষিত হয়: চূড়ান্ত বা প্রিন্ট খতিয়ানে। যার কারণে সাধারণ মানুষ তার নিজ সম্পত্তি হস্তান্তর কিংবা বিক্রয় বন্ধকসহ কোন চুক্তি সম্পাদন করতে পারে না। যা অল্প বা দ্রুত সময়ের মধ্যে স্ব-স্ব উপজেলা ভ‚মি কর্মকর্তা সংশোধন করে সর্বসাধারণের সমস্যা লাঘবে সহয়তা করবেন। কিন্তু জেলার ভ‚মি অফিসগুলোতে মাসের পর মাস ঘুরলেও মিলছে না কাঙ্ক্ষিত সেবা- এমন অভিযোগ সেবা প্রার্থীর অনেকের।
ভুক্তভোগী ফরিদগঞ্জ উপজেলার দেলোয়ার হোসেন জানান, তার খতিয়ানে মূল নামের স্থলে ডাক নাম চলে আসায় তা সংশোধনের জন্য গত এপ্রিল মাস হতে প্রতি সপ্তাহে উপজেলা ভূমি অফিসে সরাসরি যোগাযোগ করে সংশ্লিষ্টদের কাছ থেকে কোন সেবা পাচ্ছি না। বরং দিন দিন হয়রানি বাড়ছে। তার দাবি আমার আবেদনের প্রেক্ষিত স্থানীয় তহসিল অফিসের প্রতিবেদন চায় উপজেলা অফিস। স্থানীয় তহসিল অফিস সরজমিন ও স্থানীয়দের সাথে কথা বলে তাদের প্রতিবেদন দেয়। কিন্তু তারপরও অধিকতর নিশ্চয়তার জন্য কুমিল্লা জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে প্রেরণ করেন।
জোনাল সেটেলমেন্ট অফিসে যোগাযোগ করলে তারা জানান, মূল নামের স্থলে ডাক নাম চলে আসলে তা ভূমি মন্ত্রণালয়ের গেজেটমূলে উপজেলা ভূমি কমকর্তা তা স্বল্প সময়ের মধ্যে তা সংশোধন করে দিবেন। কিন্তু বিষয়টি উপজেলা ভূমি কর্মকর্তাকে জানালে তিনি তা আরো অধিকতর নিশ্চিত হওয়ার জন্য জেলা প্রশাসক বরাবর প্রেরণ করেন।
তার দাবি ১৯৯২ সালে তিনি সরেজমিন উপস্থিত না থাকায় স্থানীয়রা আমার ডাক নামে জরিপ কর্মকর্তাদের কাছে আমার জমিটি তালিকা করায়। ১৯৯৪ সালে আমি সাবকবলা মূলে স্থানীয় ব্যক্তির কাছে বিক্রি করি। বর্তমানে ক্রেতার ওয়ারিশরা নামের করণিক ভুলের জন্য তা খারিজ বা নামজারি করতে পারছেন না।
জানা গেছে, চাঁদপুর জেলার ৮ উপজেলায় প্রতি সপ্তাহে এমন সংশোধনী কেস নিয়ে আসছেন। কিন্তু করণিক ভুলের পরবর্তী গ্যাড়াকল থেকে ভুক্তভোগীদের বের হতে কষ্ট পেতে হচ্ছে। অথচ সংশ্লিষ্টরা আন্তরিক হলে দ্রুত সময়ের মধ্যে তা শুনানী করে নিষ্পত্তি করতে পারেন বলে ভুক্তভোগীরা মনে করেন।
এদিকে সরকারের গেজেটে উল্লেখ আছে উপজেলা নিম্নে উল্লেখিত করণিক ভুলগুলো সংশোধন করে দিবেন। ক. খতিয়ানে মালিকের নিজ নামে কিংবা পিতা বা মাতা বা স্বামীর নামে করণিক ভুল: যেমন-আব্দুর রহমানের স্থলে আব্দুল রাহমান, আঃ রেহমান, রহিম মিঞার স্থলে রহিম আলী বা মো: রহিম, হাজেরা বেগম স্থলে হাজিরা খাতুন, আসল নাম আরিফুল ইসলাম কিন্তু ডাক নাম সোনা মিয়া নামে রেকর্ড হওয়া ইত্যাদি;
খ. পিতা, পুত্র, কন্যা,স্বামী বা স্ত্রীর পদবি বা বংশ পরিচয়ে করণিক ভুল। যেমন-পিতা আওলাদ হাওলাদার, পুত্র আশফাক জমাদ্দার ইত্যাদি;
গ. পিং এবং জং এর ক্ষেত্রে ভুল: যেমন- জমিলা বেগমের পিতা জামাল উদ্দিন কিন্তু রেকড-এ পিং বা পিতা স্থলে জং বা স্বামী জামাল উদ্দিন লেখা হয়েছে বা এর বিপরীত হতে পারে;
ঘ. ঠিকানায় করণিক ভুল: যেমন- গ্রামের নাম রহিমপুর, কিন্তু লেখা হয়েছে করিমপুর বা এর বিপরীত। তেমনিভাবে মৌজার জেএল নম্বর ভুল, বিভাগ, জেলা এবং উপজেলার নামের ভুল, মৌজার নামের ভুল, মৌজার নাম মুরাদনগর, কিন্তু খতিয়ানে লেখা হয়েছে মুরাদপুর ইত্যাদি;
ড. খতিয়ানে অংশের গাণিতিক ভুল: যেমন- খতিয়ানে দুই জনের অংশ হওয়ার কথা ৫০:৫০, কিন্তু লেখা হয়েছে, ৬০:৫০ এবং এতে মোট ১ এর বেশি হয়ে যায় যা সম্ভব নয়। তাছাড়া, দুই জন উত্তরাধিকার বা ক্রয়মূলে পাওয়ার কথা ৫০:৫০, কিন্তু লেখা হয়েছে, ৬০:৪০ এবং দুই জনই ৫০:৫০-তে সম্মত;
চ. খতিয়ানে দাগ নম্বরে করণিক ভুল হওয়া বা কোনো দাগ ভুলক্রমে বাদ পড়ে যাওয়া: যেমন- (১) নক্সায় দাগ নম্বর আছে ৫১০, কিন্তু খতিয়ানে লেখা হয়েছে ৫০১, (২) খতিয়ানে দাগ নম্বর ৫১০ এর স্থলে ভুলক্রমে ৪১০ লেখা হয়েছে এবং ৪১০ নক্সায় পৃথক জায়গায় দেখানো আছে ; (৩) দাগস‚চিতে ৭৭ নম্বর দাগটি ১৩৭ নম্বর খতিয়ানে দেখানো হলেও প্রকাশিত ১৩৭ নম্বর খতিয়ানে ৭৭ নম্বর দাগটি ভুলক্রমে বাদ পড়ে গেল বা ভুলে ১৭৭ নম্বর হয়ে গেল।
গেজেটে উল্লেখিত করণিক ভুলগুলো সংশোধন করতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা প্রয়োজনে জোনাল সেটেলমেন্ট অফিস কিংবা জেলা প্রশাসকের মতামত নিতে পারবেন বলা আছে।
এ ব্যাপারে চাঁদপুরের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মোছাম্মৎ রাশেদা আক্তার জানান, এসব করণিক ভুল যা সংশোধনযোগ্য তা করা হচ্ছে। হয়রানি অর্থাৎ মাসের পর মাস কোনো বিষয় ঝুলে থাকার কথা নয়। তারপরও কারো কোনো জটিলতা যা জেলা প্রশাসনের নিয়মের মাঝে থাকে সেটি নিয়ে আসলে তা অবশ্যই সমাধান করে দেয়া হয়।

০৭ নভেম্বর, ২০২৩।