হাজীগঞ্জে পানিতে ডুবে মৃত্যুর হার আশংকাজনক

৩ মাসে অর্ধ-শতাধিক মৃত্যু

মোহাম্মদ হাবীব উল্যাহ্
হাজীগঞ্জে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার আশঙ্কাজনক হারে বেড়েছে। গত ২ মাসে অর্ধ শতাধিক শিশু পানিতে ডুবে মারা গেছে। এর মধ্যে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে ২৮ জনের মৃত্যুর বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। বিশেষ করে উপজেলার প্রত্যন্ত অঞ্চলে এবং যারা মৃত্যুর বিষয়টি স্থানীয়ভাবে নিশ্চিত হয়ে থাকেন তারা উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আসেন না। সে হিসেবে এই শিশু মৃত্যুর হার অর্ধশতাধিক হতে পারে বলে মনে করেন সচেতনমহল।
দেশে শিশু মৃত্যুর অন্যতম প্রধান কারণ হচ্ছে পানিতে ডুবে মারা যাওয়া। অর্থাৎ অন্য যেকোনো কারণে মৃত্যুর চেয়ে পানিতে ডুবে শিশুমৃত্যুর হার সবচেয়ে বেশি। এক গবেষণা সূত্রে জানা গেছে, দেশে প্রতিদিন ৪০ শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়। সারা বছর পানিতে ডুবে মারা যাওয়ার ঘটনা ঘটলেও সাধারণত বর্ষা মৌসুমে বেশি দুর্ঘটনা হয়ে থাকে। সাধারণত যেসব শিশু পানিতে ডুবে মারা যায় তাদের বয়স ১ থেকে ৫/৭ বছরের মধ্যে।
আর চাঁদপুর জেলার মধ্যে হাজীগঞ্জ উপজেলায় পানিতে ডুবে শিশুর মৃত্যুর হার বেশি। এ বছর বর্ষায় হাসপাতাল ও সংবাদকর্মীদের পাওয়া তথ্যমতে জুন মাসে ১৬ জন, জুলাই মাসে ৭ জন, আগস্ট মাসে ১১ জন ও সেপ্টেম্বরের ১৫ তারিখ পর্যন্ত ৩ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। এর মধ্যে ২ জন বয়স্ক নারীও রয়েছেন। বিশেষ করে আপন দুই ভাই-বোন ও মামাতো-ফুফাতো দুই ভাই এবং বালতির পানিতে ডুবে শিশু মারা যাওয়ার বিষয়টি মানুষের হৃদয়ের গভীরে দাগ কেটেছে।
উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স সূত্রে জানা গেছে, বর্ষার শুরুতেই জুন মাসে উপজেলার জাকনি গ্রামের ফাতেমা আক্তার (৫), সন্না গ্রামের আবুল হোসাইন (৩), বেলঘর গ্রামের আড়াই বছর বয়সি সাইমুন, পয়ালযোশ গ্রামের সাড়ে তিন বছর বয়সি আব্দুল্লাহ, বাসারা গ্রামের মরিয়ম, কীত্তণখোলা গ্রামের ভাই-বোন ওমর ফারুক (৫) ও ফাইজা ইসলাম (৮), শোল্লা গ্রামের জাহিন ও কালচোঁ গ্রামের জাহিন পানিতে ডুবে মারা যায়।
সিদলা গ্রামের দেড় বছর বয়সি হাফসা, দেবিপুর গ্রামের জান্নাতুল ফেরদৌস, কালচোঁ (ডুমুরিয়া) গ্রামের সায়েম (৩), সুরুঙ্গচাইল গ্রামের সোহেব (১৭ মাস), রান্ধুনীমূড়া গ্রামের আরিশা (২) পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া ২৭ জুন সুহিলপুর গ্রামে মামাতো-ফুফাতো ভাই ওমর ফারুক ও মানিক হোসেন পানিতে ডুবে মারা যায়। পুকুরে জাল বেড় দিয়ে তাদের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। তাই তাদের মরদেহ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়নি।
জুলাই মাসে দেশগাঁও গ্রামের নাহিদুল ইসলাম (১৮ মাস), মহেষপুর গ্রামের নিয়াজ আহমেদ (২), মনতলা গ্রামের আদনান (১), বলিয়া গ্রামে সালমান (৬), ওয়ারুক গ্রামের রাহাত পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া দেশগাঁও গ্রামের বৃদ্ধা তফুরের নেছা ও পালিশারা গ্রামের কইতরের নেছা (৮৫) পানিতে ডুবে মারা যায়। তাদের মরদেহ পানিতে ভেসে উঠায় এবং মৃতের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়নি।
আগস্ট মাসে মোহাম্মদপুর গ্রামের আব্দুল্লাহ (৫), কালচোঁ (ডুমুরিয়া) গ্রামের তানিশা (১৮ মাস), বাকিলা গ্রামের আব্দুর রহমান (৩), কুড়ুলি গ্রামের জান্নাতুল ফেরদৌস (১৪ মাস), গৌড়েশ^র গ্রামের নিয়াজ আহমেদ (৩), সিহিরচোঁ গ্রামের আয়ান (১৮ মাস), পাতানিশ গ্রামের মেহরাজ ও হাড়িয়াইন গ্রামের সাড়ে ৪ বছর বয়সি শাকিল পানিতে ডুবে মারা যায়।
এছাড়া মাতৈন গ্রামের আবির হোসেন (৬), গৌড়েশ^র গ্রামের মাহাদি হাছান (২) ও সাকছিপাড়া গ্রামের সাড়ে ৩ বছর বয়সি হাছান মাহমুদ পানিতে ডুবে মারা যায়। তাদের মরদেহ পানিতে ভেসে উঠায় এবং মৃতের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়নি।
এদিকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত বলাখাল গ্রামের ফারিয়া (১৩ মাস) পানিতে ডুবে মারা যায়। এছাড়া কীত্তনখোলা গ্রামের দেড় বছর বয়সি শিশু আলিফা এবং বালতির পানিতে ডুবে মুনতাহা (১) মারা যায়। তাদের মৃতের বিষয়টি নিশ্চিত হওয়ায় উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়নি। অপরদিকে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আনা হয়নি এবং সংবাদকর্মীদের দৃষ্টিগোচর হয়নি এমন খবরও নেহায়েত কম নয়।
উপজেলায় আশংকাজনক হারে শিশু মৃত্যু বৃদ্ধির কারণ হিসেবে সচেতনমহল মনে করেন চারদিকে বিভিন্ন ধরনের জলাশয় (পুকুর, নদী, ডোবা, খাল ও বিল) এবং বসতঘরের ২০ মিটারের মধ্যে পুকুর বা জলাশয় থাকা, বড় বাচ্চাদের ক্ষেত্রে সাঁতার না জানা, তাৎক্ষণিক প্রাথমিক চিকিৎসা জ্ঞান না থাকা এবং পানি থেকে উঠানোর পর কী করা, তা না জানার কারণে অনেক শিশু পানিতে ডুবে মারা যায়।
এছাড়া অভিভাবকদের সন্তানদের প্রতি ঠিকমতো নজর না রাখা। বাবারা কাজে ঘরের বাইরে থাকার কারণে মায়েরাই মূলতঃ সন্তান দেখাশোনার কাজটি করে থাকেন। কিন্তু পারিবারিক ও সাংসারিক কাজে তাদের ব্যস্ত থাকতে হয় বলে সন্তানকে সব সময় চোখে চোখে রাখা মায়েদের জন্য কঠিন হয়ে পড়ে। যার ফলে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে শিশুরা পানিতে ডুবে মারা যায়।
পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধ করতে হলে বর্ষার সময়কে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। বাবা ও মায়ের পাশাপাশি পরিবারের অন্য সদস্যদেরও শিশুদের প্রতি মনোযোগ বাড়াতে হবে। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব শিশুদের সাঁতার শেখাতে হবে। কমিউনিটি বা সামাজিক সচেতনতা বাড়াতে হবে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ের থেকে শিক্ষার্থীদের অভিভাবকদের সাঁতার শেখানোর তাগিদ দিতে হবে। তারপরও দুর্ঘটনার আশঙ্কা থেকেই যায়। এজন্য বাবা ও মায়ের বাড়তি সতর্কতা থাকা দরকার বলে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা মনে করেন।
হাজীগঞ্জে পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যুর হার আশংকাজনক উল্লেখ করে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. গোলাম মাওলা নঈম জানান, পানিতে ডুবে শিশু মৃত্যু প্রতিরোধে ৫ বছরের বেশি বয়সী শিশুদের সাঁতার শেখানো এবং ৫ বছরের কম বয়সী শিশুদের চোখে চোখে রাখতে হবে। বাবা-মাকে আরো বেশি সচেতন ও সতর্ক হতে হবে। এক্ষেত্রে পারিবারিকভাবে সচেতনতা জরুরি।
তিনি বলেন, বিশেষ করে বর্ষাকালীন সময়ে প্রতি গুরুত্ব দিতে হবে। এসময় চারদিকে পানি আর পানি। তাই, যেসব পরিবারের ছোট ও সাঁতার না জানা শিশু আছে, সেসব পরিবারের লোকজনকে আরও বেশি সচেতন ও সতর্ক হতে হবে।

১৬ সেপ্টেম্বর, ২০২৪।