একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে শংকা…

মো. মিজানুর রহমান

মো. মিজানুর রহমান

একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জনমনে শংকা দেখা দিয়েছে। একদিকে সংলাপ, অপরদিকে নির্বাচন কমিশনের ছক অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানের নানা পদক্ষেপের পরও সাধারণ মানুষের মধ্যে নানা আশঙ্কা তৈরি হচ্ছে। এর মাঝে বিএনপিসহ সম্প্রতি গঠিত জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নির্বাচন কমিশনের কাছে তফসিল পিছিয়ে দেয়ার আহ্বান এবং গত ৫ নভেম্বর ঐক্যফ্রন্টে বঙ্গবীর কাদের সিদ্দিকীর যোগদান বিষয়টিকে আরো জটিল সমীকরণে ফেলে দিয়েছে। ফলে সঠিক সময়ে নির্বাচন হবে কিনা তা নিয়ে জনমনে সন্দেহ দেখা দিয়েছে।
কেউ কেউ বলছেন, নিয়মানুযায়ী বা সাংবিধানিকভাবে যেভাবে নির্বাচন হওয়ার কথা তাতে সরকারের বাইরের দলগুলো চাচ্ছে না। তারা চান সম্মিলিতভাবে বা সবার ঐক্যের ভিত্তিতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ। ইতোমধ্যে তারা তাদের দাবিগুলো ক্ষমতাশীন দল আওয়ামী লীগের সভাপতি মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কাছে তুলে ধরেছেন। এ ব্যাপারে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের সাথে থাকা দলসহ বিএনপি ও বিরোধী দলগুলোর সাথে সংলাপ করে যাচ্ছেন।
অপরদিকে নির্বাচন কমিশন বলছে, তারা তাদের নির্ধারিত ছক অনুযায়ী নির্বাচন অনুষ্ঠানে যাবতীয় কার্যক্রম সম্পন্ন করছেন। ইতোমধ্যে মহামান্য রাষ্ট্রপতির সাথে এ নিয়ে আলোচনা হয়েছে। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সাথে নির্বাচন নিয়ে তাদের মতামতও তারা শুনেছেন। আগামি ৮ নভেম্বর নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার সম্ভাবনার কথাও তারা বলছেন।
এদিকে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কে এম নূরুল হুদা বলেছেন, জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল পেছানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। তবে সব রাজনৈতিক দল একমত হলে নির্বাচন (ভোটের তারিখ) পেছানো হবে।
গতকাল মঙ্গলবার সকালে আগারগাঁওয়ের নির্বাচন কমিশনের (ইসি) ইটিআই ভবনে নির্বাচনে ইভিএম ব্যবহারসংক্রান্ত প্রশিক্ষকদের প্রশিক্ষণ অনুষ্ঠানের উদ্বোধন শেষে সাংবাদিকদের কাছে সিইসি এ কথা বলেন। নির্বাচনে ইলেক্ট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) ব্যবহার করার সিদ্ধান্তের বিষয়ে সিইসি তাঁর উদ্বোধনী বক্তব্যে বলেন, ভোটারদের ভোটের স্বার্থ সুরক্ষিত রাখার জন্য ইভিএমের বিকল্প নেই। ব্যালটে পেপারে নানা অসুবিধা রয়েছে। সেগুলো এড়িয়ে চলার জন্য ইভিএম চালু করা হবে। ইভিএমে ভোট কারচুপি করার সুযোগ নেই।
অপরদিকে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের নেতা ড. কামাল হোসেনের প্রথম চিঠির মতো দ্বিতীয় চিঠির জবাবেও মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগের সভাপতি শেখ হাসিনা দ্রুত বৈঠকে বসার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। আজ বুধবার দুই পক্ষের মধ্যে কাক্সিক্ষত বৈঠকটি হওয়ার কথা। প্রথম বৈঠকে আগামি জাতীয় নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট জটিলতা নিরসনে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট উপস্থাপিত সাত দফার বিষয়ে বিস্তৃত আলোচনা হলেও কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। এই প্রেক্ষাপটে কামাল হোসেন ‘অসমাপ্ত আলোচনা’ সমাপ্ত করার তাগিদ দিয়েছেন। তিনি আরও বলেছিলেন যে জটিল সাংবিধানিক বিষয়ের সমাধান পেতে ছোট পরিসরে আলোচনা প্রয়োজন। মাননীয় প্রধানমন্ত্রীও তাঁর প্রস্তাবে সম্মতি দিয়েছেন।
ইতোমধ্যে জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের পক্ষ থেকে সংলাপ শেষ হওয়ার আগে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা না করার জন্য নির্বাচন কমিশনকে অনুরোধ জানানো হয়েছে। যদিও ইসি ৮ নভেম্বর তফসিল ঘোষণা করবে বলে জানিয়েছে। নির্বাচন কমিশন সাধারণত ৪৫ দিন হাতে রেখে জাতীয় নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে থাকে। এই অবস্থায় ২৩ ডিসেম্বর নির্বাচন হতে পারে বলেও কোনো কোনো গণমাধ্যমে খবর এসেছে। তফসিল ঘোষণা নিয়ে নির্বাচন কমিশনের যে আগ্রহ দেখা যাচ্ছে, সে তুলনায় একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে তাদের আন্তরিকতা কতটুকু, তা নিয়ে সন্দেহ করার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। কারণ, একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন নিশ্চিত করতে বর্তমানে চলমান সরকার ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের সংলাপের সফল পরিসমাপ্তির বিষয়টি খুবই জরুরি।
সংবিধান অনুযায়ী, জাতীয় সংসদের মেয়াদ শেষ হওয়ার ৯০ দিনের মধ্যে নির্বাচন করার সুযোগ রয়েছে। চলতি সংসদের মেয়াদ শেষ হবে আগামি ২৮ জানুয়ারি। নির্বাচন কমিশন যদি ডিসেম্বরের মধ্যেও নির্বাচন করতে চায়, তাদের হাতে সময় আছে। অনন্তকাল ধরে নিশ্চয়ই সংলাপ চলবে না। ফলে সংলাপের দিকে কোনো নজর না রেখে শুধু তফসিল ঘোষণা নিয়ে তোড়জোড় কোনো কাজের কথা হতে পারে না।
আবার আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের যে বলেছেন, ৮ তারিখের পর আর সংলাপ হবে না, তা’ও গ্রহণযোগ্য নয়। সংলাপের বিষয়ে এভাবে দিনক্ষণ বেঁধে দেয়া ঠিক নয়। ৮ তারিখের মধ্যে সমাধান হলে ভালো, কিন্তু না হলে পরেও সংলাপের দরজা খোলা রাখতে হবে।
আওয়ামী লীগের সঙ্গে সংলাপের আগে (মঙ্গলবার) সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট সমাবেশ আহ্বান করেছে। আমরা আশা করব, তারা এমন কোনো কর্মসূচি দেবে না, যা সংলাপকে বাধাগ্রস্ত করতে পারে। তাদের এ কথাও মনে রাখতে হবে যে ক্ষমতাসীন দল থেকে সংলাপ ও আন্দোলনের কর্মসূচি একসঙ্গে চলতে পারে না বলে তির্যক মন্তব্য করা হয়েছে। কামাল হোসেন বলেছেন, সংবিধানের মধ্যে সমস্যার সমাধান সম্ভব। সরকারি দলেরও দাবি, তারা সংবিধানের বাইরে যাবে না।
আমরা মনে করি, যদি উভয় পক্ষ আন্তরিক হয়, তাহলে নির্বাচন নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান কঠিন নয়। সংলাপের অর্থই হলো উভয় পক্ষের প্রস্তাব বা দাবিগুলো গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করে একটি সমঝোতায় পৌঁছানোর চেষ্টা করা। এখানে কোনো পক্ষ অনড় থাকলে সংলাপ সফল হবে না।
আমরা মনে করি সব দলের অংশগ্রহণে একটি অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অনুষ্ঠানের ব্যাপারে দুই পক্ষকে দ্রুতই সমঝোতায় আসতে হবে। ঐক্যফ্রন্টের দাবি মেনে নির্বাচন কমিশন তফসিল ঘোষণার তারিখ পেছাক বা না পেছাক- সবকিছু মিলিয়ে হাতে সময় খুব বেশি নেই। ১ নভেম্বরের আলোচনা ‘অসমাপ্ত’ ছিল বলেই ৭ নভেম্বর ফের সংলাপ হতে যাচ্ছে। জনগণ এই সংলাপ থেকে কার্যকর ফল আশা করে, যাতে একটি অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন নিয়ে সব ধরনের বিভ্রান্তি কেটে যায়।
গত শনিবার জাতীয় নির্বাচনের তফসিল পেছাতে ইসিকে চিঠি দেয় জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট। একই দিন নির্বাচন কমিশনের বৈঠক শেষে নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার জন্য ৮ নভেম্বর দিন ধার্য করে নির্বাচন কমিশন। ওইদিন সিইসি কেএম নূরুল হুদা জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ দিয়ে জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবেন।
বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির মধ্যে একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বাধ্যবাধকতা রয়েছে।
আজ বুধবার (৭ নভেম্বর) জাতীয় ঐক্যফ্রন্টের সাথে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার চূড়ান্ত সংলাপ হবে বলে নির্ধারণ করা হয়েছে। এই সংলাপে জাতীয় ঐক্যফ্রন্ট নেতৃবৃন্দ এবং মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সমঝোতা হলে একটি অবাধ ও স্বতঃস্ফূর্ত নির্বাচন অনুষ্ঠিত হতে পারে বলে অনেকে মনে করছেন।