ইল্শেপাড় রিপোর্ট
বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে দেশব্যাপী ৪৮ ঘণ্টার পরিবহন ধর্মঘটে দুর্ভোগের শিকার হয়েছেন দেশের সাধারণ মানুষ। সুনামগঞ্জে মৃত্যু হয়েছে এক নবজাতকের। বিভিন্ন স্থানে আটকা পরেছে লাখ-লাখ মানুষ। ঘর থেকে বের হয়ে নিজ নিজ গন্তব্য যেতে না পারায় সাধারণ মানুষ অনেকটাই বিপাকে পরে গত ২৮ ও ২৯ অক্টোবর। তারা ঐ সময় হুমকি দেয়, তাদের দাবি না মানা হলে আবারো ধর্মঘটসহ নানা কর্মসূচি দেবে। এতে সাধারণ মানুষ আবারো চরম বিপাকে পড়বে।
শ্রমিকদের এ ধরনের ধর্মঘটে সাধারণ মানুষের মনে সরকারের সক্ষমতা নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন কেউ কেউ। তারা বলছেন, দেশের অন্যান্য রাজনৈতিক দল যেখানে ঠিকমতো সভা-সমাবেশ করতে পারে না সেখানে শ্রমিকরা হঠাৎ করে অরাজকতা শুরু করলো, মানুষকে জিম্মি করে মারমুখী অবস্থান নিলো- এটা কার ইঙ্গিতে? তাহলে কি সরকার শ্রমিকদের অন্যায্য দাবির প্রতি দুর্বল ছিলো। কেউ বলছেন, সরকারের ভেতরে বাস করা শ্রমিক নেতা’ই এসব অরাজকতা করতে নির্দেশ দিয়েছে। কিন্তু তাকে সরকারের মন্ত্রী রেখে মানুষকে হয়রানী করার মানে কি?
পাশাপাশি সড়কে শ্রমিকরা সংগঠিত হয়ে অ্যাম্বুলেন্স, ব্যক্তিচালিত প্রাইভেট কার, সিএনজি, অটোর মতো যানবাহনে বাধা ও ভাঙচুর করায় দুর্ভোগের মাত্রা সীমা অতিক্রম করে। ফলে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে কার ইঙ্গিতে শ্রমিকরা এতটা আগ্রাসী মনোভাব দেখিয়েছে। আর সুনামগঞ্জে মৃত্যু হওয়া শিশুটির দায় দায়িত্ব কে নেবে?
জানা গেছে, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলার পাথারিয়া ইউনিয়নের গনিগঞ্জ গ্রামের মইনুল ইসলামের দু’দিনের নবজাতক হাসপাতালে নিতে না পারায় বাবার কোলেই মারা গেছে। স্থানীয়রা বলছে, মইনুল ইসলামের স্ত্রী শেলিনা বেগম রোববার রাতে বাড়িতেই পুত্র সন্ত্রান জন্ম দেন। সোমবার সকালে ঠান্ডাজনিত কারণে ওই নবজাতক অসুস্থ হয়ে পড়ে। স্থানীয় পল্লী চিকিৎসক শিশুটিকে সুনামগঞ্জ হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পরামর্শ দেন। নবজাতকের বাবা মইনুল ইসলাম সিএনজিসহ বিভিন্ন পরিবহন চালকদের অনুরোধ জানালেও তারা হাসপাতালে নিয়ে যেতে অপারগতা প্রকাশ করেন। দুপুর সাড়ে ১২টার দিকে এক পর্যায়ে বাবার কোলেই নবজাতকের মৃত্যু হয়।
শ্রমিকদের এমন আচরণ কতটা অমানবিক- তা নিয়েই এখন চলছে প্রশ্ন। ধর্মঘটের নামে এমন নৈরাজ্য কার ইঙ্গিতে হচ্ছে তা খুঁজে দেখতে সাধারণ মানুষ দাবি করছে। সামনে যাতে এমন নৈরাজ্য না হয় তা রোধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থাগ্রহণেরও দাবি উঠেছে।
তবে শিক্ষার্থীদের নিরাপদ সড়কের দাবির প্রেক্ষিতে গত ১৯ সেপ্টেম্বর ‘সড়ক পরিবহন আইন ২০১৮’ জাতীয় সংসদে পাস হয়। শ্রমিক ফেডারেশন দীর্ঘদিন ধরে যুগোপযোগী আধুনিক ও উন্নত সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের দাবি করে আসছে। সেই দাবি গুরুত্ব বিবেচনায় নিয়ে সরকার আইন পাস করলেও বেশকিছু ধারা শ্রমিক স্বার্থের বিরুদ্ধে করা হয়েছে বলে দাবি উঠেছে শ্রমিক সংগঠনের পক্ষ থেকে।
যার কারণে পরিবহন শ্রমিকদের জন্য আইনটি তাদের জন্য অনিশ্চয়তা হিসেবে দেখা দিয়েছে। শ্রমিকরা দাবি করছে আইনে সড়ক দুর্ঘটনাকে দুর্ঘটনা হিসেবে গণ্য না করে অপরাধ হিসেবে গণ্য করে জামিন অযোগ্য করা হয়েছে। তাদের দাবি, দুর্ঘটনা পরিকল্পিতভাবে ঘটে না, কিন্তু অপরাধ পরিকল্পিতভাবেই ঘটে। আর এমন দাবিকেই সামনে রেখে পাস হওয়া আইনের ৮ ধারায় সংশোধনের জন্য তারা ধর্মঘটের ডাক দেয় আর চরম দুর্ভোগে পরে সারা দেশের মানুষ।
শ্রমিকদের ৮টি দাবি হলো- ১. সড়ক দুর্ঘটনায় মামলা জামিনযোগ্য করতে হবে; ২. শ্রমিকদের অর্থদ- ৫ লাখ টাকা করা যাবে না; ৩. সড়ক দুর্ঘটনা তদন্ত কমিটিতে শ্রমিক প্রতিনিধি রাখতে হবে; ৪. ড্রাইভিং লাইসেন্সে শিক্ষাগত যোগ্যতা পঞ্চম শ্রেণি করতে হবে; ৫. ওয়েটস্কেলে (ট্রাক ওজন স্কেল) জরিমানা কমানোসহ শাস্তি বাতিল করতে হবে; ৬. সড়কে পুলিশের হয়রানি বন্ধ করতে হবে; ৭. গাড়ির রেজিস্ট্রেশনের সময় শ্রমিকদের নিয়োগপত্র সংশ্লিষ্ট ইউনিয়নের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদকের সত্যায়িত স্বাক্ষর থাকার ব্যবস্থা করতে হবে; ৮. সব জেলায় শ্রমিকদের ব্যাপক হারে প্রশিক্ষণ দিয়ে ড্রাইভিং লাইসেন্স ইস্যু করতে হবে এবং লাইসেন্স ইস্যুর ক্ষেত্রে দুর্নীতি ও অনিয়ম বন্ধ করতে হবে।
শ্রমিক ফেডারেশন যখন এমন দাবি করছে তখন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, এই মুহূর্তে আইন পরিবর্তন করার কোনো সুযোগ নেই। ফলে শ্রমিকরা তাদের দাবির প্রতি আরো অনড়। আর এ কারণেই আরো দুর্ভোগ বাড়ছে বলে বিশ্লেষকরা মনে করে।
তবে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ডাকে দেশব্যাপী শেষ হওয়া ৪৮ ঘণ্টার এই পরিবহন ধর্মঘট নিয়ে সর্বমহলের নানা প্রশ্ন শেষ হচ্ছে না। চরম দুর্ভোগের শিকার সাধারণ মানুষ বলছে এমনটি হয়েছে পূর্ব পরিকল্পিতভাবেই। তাদের দাবি সরকারের নৌ-পরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খান এ আন্দোলনের জন্য অনেকাংশেই দায়ী।
কারণ হিসেবে তারা বলছে ইতোপূর্বে নৌপরিবহনমন্ত্রী গণমাধ্যমে বলেছেন, বাস্তবতা হলো দেশে চালকের সংকট আছে। আর এই বাস্তবতার ভিত্তিতে অশিক্ষিত চালকদেরও লাইসেন্স দেয়া দরকার। কারণ, তারা সিগনাল চেনে, গরু-ছাগল চেনে, মানুষ চিনে। সুতরাং অশিক্ষিত চালকদেরও লাইসেন্স দেয়া দরকার।
নৌ-পরিবহনমন্ত্রীর এমন বক্তব্যর পর থেকেই শ্রমিকরা তাদের বাস্তবতার গুরুত্ব দিতে শুরু করে এবং বেপরোয়া হতে শুরু করে। পরবর্তী নিরাপদ সড়কের জন্য ছাত্র আন্দোলন শুরু হলে তোপের মুখে পরেন মন্ত্রী শাজাহান খান। নৌমন্ত্রীর এহেন আচরণে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাকে আরো সংযত হয়ে কথা বলতে নির্দেশ দেন।