চাঁদপুরে উন্নয়ন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নদী খনন করে নৌযান চলাচল স্বাভাবিক রাখায় ব্যবস্থা নেয়া হবে

গতকাল বৃহস্পতিবার চাঁদপুর স্টেডিয়ামে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ৩ দিনব্যাপী উন্নয়ন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিডিও কন্ফারেন্সে বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। -ইল্শেপাড়

এস এম সোহেল :
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, চাঁদপুর দেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ স্থান। এ জেলার পদ্মা ও মেঘনা নদী দিয়ে দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ লঞ্চে যাতায়াত করেন। তাই এসব নদীগুলো খনন করে নৌযান চলাচল স্বাভাবিক করার জন্য ব্যবস্থা নেয়া হবে। ইতোমধ্যে নদী খননের কয়েকটি প্রকল্প চালু হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সবগুলো নদীই খনন করা হবে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুর ১২টায় চাঁদপুর স্টেডিয়াম মাঠে জেলা প্রশাসনের আয়োজনে ৩ দিনব্যাপী উন্নয়ন মেলার উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে ভিডিও কনফারেন্সে তিনি এসব কথা বলেন।
এ সময় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সবুর মন্ডল, মৎস্যজীবী নেতা মানিক দেওয়ান ও কৃষক মিজানুর রহমানের বক্তব্য শুনেন।
প্রধানমন্ত্রী আরো বলেন, জেলে ও কৃষকদের বক্তব্যের মাধ্যমে আমি অনেক কিছু জানতে পেরেছি। কারেন্টজাল যারা তৈরি করেন তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়া হবে। জেলে পরিবারের পুনর্বাসনের জন্য সরকার কাজ করছে। তাদের সন্তানদের শিক্ষিত করে আধুনিক পদ্ধতিতে মাছ শিকার করার জন্য গড়ে তুলতে হবে। কারণ আমরা এখন প্রাইমারি থেকে পিএইচডি পর্যন্ত বৃত্তির ব্যবস্থা রেখেছি। আর এসব বৃত্তির টাকা সরাসরি তাদের মোবাইলে চলে যাচ্ছে। বছরের শুরুতে বিনামূল্যে বই দেয়া হচ্ছে। এতে করে জেলেদের সন্তান শিক্ষিত হওয়ার জন্য কোন সমস্যা নেই।
প্রাকৃতিক দুর্যোগ, বন্যায় ফসলের ক্ষতি, আলু সংরক্ষণের অভাবে ও ন্যায্যমূল্য পাওয়ার দাবিতে কৃষক মিজানুর রহমানের বক্তব্যের জবাবে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আলু সংরক্ষণ থেকে প্রক্রিয়াকরণের ব্যবস্থা নিতে হবে। আলু দিয়ে অনেক কিছু তৈরি করা যায়। এসব পণ্য দেশীয় বাজারে বিক্রি করা যাবে। আমরা এখন প্রক্রিয়াকরণের প্রতি দৃষ্টি দেবো। ১০ টাকায় ১ কোটি কৃষক ব্যাংকে একাউন্ট খোলার সুযোগ করে দেয়া হয়েছে। ২ কোটি ৮ লাখ ৯৩ হাজার ৪শ’ ৭৭টা কৃষি উপকরণ দিয়েছি। যাতে করে কৃষকরা চাষাবাদ সহজে করতে পারেন। ভোগান্তিতে না পড়তে হয়।
তিনি বলেন, আমরা রপ্তানির বিষয়ে ব্যবস্থা নিচ্ছি। কোন কোন দেশে কোন কোন ফসল চাহিদা রয়েছে সেদিকে আমরা দৃষ্টি দেবো। তাহলে আর কৃষকরা বঞ্চিত হবে না। উন্নয়ন মেলার মাধ্যমে আমরা জনগণের কাছ থেকে অনেক নতুন নতুন ধারণা নিতে পারি এবং সেভাবে কাজ করতে পারি। যারা কারেন্ট জাল তৈরি বা বিক্রি করে তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। এখন আধুনিক যুগ উন্নত পদ্ধতিতে মাছ ধরার প্রক্রিয়া চালু করতে হবে। আমাদের যার যার পেশা ঠিক রাখতে হবে। নদী খনন করা একান্ত গুরুত্বপূর্ণ। নদী খনন করা হবে।

চাঁদপুরে ৩ দিনব্যাপী উন্নয়ন মেলা উপলক্ষে সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি’র নেতৃত্বে শহরে একটি র‌্যালি বের হয়। -ইল্শেপাড়
প্রধানমন্ত্রী বলেন, পহেলা জানুয়ারি ৩৫ কোটি ৪১ লাখ ৯০ হাজার ১শ’ ৬২ বই বিনা পয়সায় ছেলে-মেয়েদের দেয়া হয়েছে। কারো বই কিনতে হচ্ছে না। স্কুলগুলোতে উন্নয়ন হচ্ছে। আমরা বৃত্তি দিচ্ছি। প্রায় ২ কোটি ৩ লাখ শিক্ষার্থীর বৃত্তি এবং ১ কোটি ৩০ লাখ প্রাইমারী শিক্ষার্থীর মায়ের নামে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে টাকা চলে যাচ্ছে। চাঁদপুরের জেলেদের ঘর-বাড়ি আছে কি-না তার খোঁজ-খবর নেয়ার জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশ দেন তিনি।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, চাঁদপুরে ভিক্ষুক মুক্তকরণে উদ্যোগ নেয়ায় ধন্যবাদ জানাচ্ছি। বাংলাদেশে পর্যটন শিল্প অনেক সম্ভাবনাময়। চাঁদপুরে পরিকল্পিতভাবে পর্যটন শিল্প গড়ে তুলতে পারেন। কারণ পর্যটন শিল্পে নৌ-ভ্রমণ খুবই আনন্দদায়ক। ইচ্ছে করলে জাহাজে করে পরিবারসহ এসে ভ্রমণ করে সহজেই গন্তব্যে চলে যেতে পারবেন। চাঁদপুরে যে পদ্মা-মেঘনার মিলনস্থল তা দেখার জন্য আমরা ছোট বেলায় আগ্রহসহ অপেক্ষায় থাকতাম। চাঁদপুর ঘাটে জাহাজ আসলে হাড়িতে করে মিষ্টি আনা হতো। পেট চুক্তি খাবার ছিলো। তবে জাহাজের হুইসাল দিলে খাবারে রেখে অনেকে চলে যেতো বলে যোগ করেন প্রধানমন্ত্রী।
চাঁদপুরের সার্বিক উন্নয়নের মধ্যে উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন তুলে ধরে বক্তব্য রাখেন জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সবুর মন্ডল। প্রধানমন্ত্রী উন্নয়নের বিবরণ শুনে প্রশংসা করেন এবং বলেন চাঁদপুরে চাঁদের হাট বসেছে।
জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সবুর মন্ডল বলেন, জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর স্বপ্ন বাস্তবায়নে প্রধানমন্ত্রী আপনার নেতৃত্বে বর্তমান সরকার নিরলসভাবে কাজ করে যাচ্ছে। উন্নয়নের ধারাবাহিকতার দিক থেকে চাঁদপুর পিছিয়ে নেই। চাঁদপুরের প্রধান সমস্য ছিলো নদী ভাঙন। দু’টি প্রজেক্টে ১৪ কিলোমিটার মেঘনার পাড় বাঁধের কাজ করা হয়েছে। বিদ্যুতের ক্ষেত্রেও চাঁদপুরের উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি রয়েছে। ১৫০ মেগাওয়াট একটি বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট নির্মাণ করা হয়েছে। ২ লাখ ৩১ হাজার পরিবারকে কয়েক বছরে বিদ্যুৎ সংযোগ দেয়া হয়েছে। ২১৮টি কমিউনিটি ক্লিনিক নির্মাণ করা হয়েছে। ৩০৩টি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একাডেমী ভবন নির্মাণ করা হয়েছে। ৬৯১ কিলোমিটার পাকা রাস্তা নির্মাণ করা হয়েছে। ১৪৮ কিলোমিটার পাকা রাস্তা নির্মাণাধীন রয়েছে। সরকারিভাবে ৩৪টি আশ্রয়ন প্রকল্প করা হয়েছে। ২৩টি আশ্রয়ন প্রকল্পে ৩ হাজার পরিবারকে পূনর্বাসন করা হয়েছে। আগামি ৬ মাসের মধ্যে ১১টি আশ্রয়ন প্রকল্পে ২ হাজার পরিবারকে পূনর্বাসন করা হবে।
জেলা প্রশাসক আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী আপনি দারিদ্র্যতা বিমোচনের যে যুদ্ধ ঘোষণা এবং ভিক্ষুক মুক্তকরণের যে নির্দেশনা দিয়েছেন চাঁদপুরে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১ দিনের বেতন ১ কোটি ২৩ লাখ টাকা জেলা প্রশাসকের তহবিলে জমা হয়েছে। আগামি ১ মাসের মধ্যে চাঁদপুর সদর উপজেলা ভিক্ষুক মুক্ত হবে। চাঁদপুরের অনেক সম্ভাবনা রয়েছে। একটি সম্ভবনা হলো পর্যটন। মেঘনা নদী আমাদের বিশাল সম্পদ। মেঘনা নদীকে ঘিরে আমরা জেলাকে ব্র্যান্ডিং করেছি ‘ইলিশের বাড়ি চাঁদপুর’। গত ৩ বছরে আপনার নেতৃত্বে গোটা দেশের মানুষ ইলিশের স্বাদ গ্রহণ করতে পেরেছে।
মৎস্যজীবী মানিক দেওয়ান বলেন, আপনার মতো প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি বলে আমরা মৎস্যজীবী অনেক কিছু পেয়েছি। আমাদের আইডি কার্ড, চাউল, পুনর্বাসন করে দিয়েছেন। আমাদের সৌভাগ্য যে আপনার মতো প্রধানমন্ত্রী পেয়েছি। আমরা আপনার দেয়া অভিযান মেনেছি বলেই আজ নদীতে অনেক মাছ ধরতে পারছি।
তিনি আরো বলেন, কারেন্ট জাল হচ্ছে ইলিশ মাছ ধ্বংস করার একমাত্র জাল। এ জালের উৎপাদন বন্ধ হচ্ছে না। জাল যারা তৈরি বা বিক্রি করে তাদের জেলে দেয়া হয় না, জেলে দেয়া হয় জেলেদের। কারেন্ট জাল উৎপাদন ও বিক্রি বন্ধ করার আহ্বান জানানো হলো। আপনার কাছে দাবি- নদী খনন করে মাছ স্বয়ংসম্পূর্ণ করে নদী শাসন করে বাঁচাতে পারলে সোনার বাংলা থেকে ৪১ সাল পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হবে না, তার আগে সোনার বাংলা হয়ে যাবে। আমরা মৎস্যজীবীরা আপনার কাছে ঋণী। তাই এ ঋণ শোধ করতে আগামিতেও আমরা আপনাকে ভোট দেব।
কৃষক মিজানুর রহমানের বলেন, কৃষি কাজে কৃষকদের যে সুযোগ করে দিয়েছেন সেজন্য চাঁদপুরের কৃষদের পক্ষ থেকে আন্তরিক ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা। কৃষি যন্ত্রাংশ ৫০% ছাড়ে কৃষকরা ক্রয় করতে পারছে। আপনার কাছে অনুরোধ কৃষকরা ফসলের ন্যায্যমূল্য যাতে পায়।
তিনি বলেন, চাঁদপুর জেলায় কোন সব্জি’র কোল্ড স্টোরেজ নেই। চাঁদপুরের যেন অন্তঃত একটি সব্জি’র কোল্ডস্টোরেজ স্থাপন করা হয়। কৃষি পণ্য যাতে দেশের বাইরে রপ্তানি করতে পারে- সে ব্যবস্থা করে দিতে হবে।
এসময় উপস্থিত ছিলেন বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক ও চাঁদপুর-৩ আসনের সংসদ সদস্য ডা. দীপু মনি, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের ত্রাণ ও সমাজকল্যাণ বিষয়ক সম্পাদক সুজিত রায় নন্দী, চাঁদপুর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি ও পৌর মেয়ার নাছির উদ্দিন আহমেদ, সাধারণ সম্পাদক আবু নঈম পাটওয়ারী দুলাল, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান আলহাজ ওচমান গণি পাটওয়ারী, অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, প্রেসক্লাব সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটওয়ারী, সাধারণ সম্পাদক মির্জা জাকিরসহ সরকারি দপ্তর প্রধান, শিক্ষক, আইনজীবী ও বিভিন্ন পেশার ব্যক্তিবর্গ।
ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে ৩ দিনব্যাপী উন্নয়ন মেলার উদ্বোধন শেষে মেলার প্রতিটি স্টল পরিদর্শন করেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপিসহ অতিথিরা।
সরকারি সব দপ্তর ও বিভাগের অংশগ্রহণে মেলায় ৭৫টি স্টল বসেছে। স্টলগুলোতে সরকারের উন্নয়ন ও নিজেদের সাফল্য জনসম্মুখে তুলে ধরা হচ্ছে। মেলায় দর্শক উপস্থিতি ছিল লক্ষণীয়। আগামি ১৩ জানুয়ারি পর্যন্ত মেলা চলবে। সমাপনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম এমপি।
স্টল পরিদর্শন শেষে উন্নয়ন মেলার তাৎপর্য নিয়ে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্য রাখেন সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডা. দীপু মনি এমপি। জেলা প্রশাসক মো. আব্দুস সবুর মন্ডলের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. মিজানুর রহমান, প্রেসক্লাব সভাপতি ইকবাল হোসেন পাটওয়ারী, সাধারণ সম্পাদক মির্জা জাকির প্রমুখ।